মো. সোহেল রানা খান, সাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) থেকে : সবজির নাম স্কোয়াশ। মূলত এটি বিদেশি সবজি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই সবজির আবাদ হয়ে থাকে। বিদেশি চাইনিজ রেস্টুডেন্টে সবজি ও সালাত হিসেবে স্কোয়াশের জুড়ি মেলাভার। তাইতো সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে মানিকগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার কৃষকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্কোয়াশ নামের এই সবজি। স্বল্প সময় ও অল্প খরচে ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় এই সবজি আবাদে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে মানিকগঞ্জের কৃষকদের মধ্যে। ভালো বীজের নিশ্চিয়তা ও চাষের প্রয়োজনীয় পরামর্শ মিললে এটি এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হতে পারে বলে মনে করছে চাষিরা। দিন দিন স্কোয়াশের আবাদের পরিমাণ বেড়েই চলছে জেলার ঘিওর, সিংগাইর, সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার মাঠ প্রান্তÍরে। স্কোয়াশ দেখতে লাউ আকৃতির, খেতে সুস্বাদু। একেকটি স্কোয়াশের ওজন ৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। উচ্চ ফলনশীল এ জাতের সবজি ভাজি, মাছ ও মাংসে রান্না উভয়ভাবেই খাওয়ার উপযোগী। সরেজমিন জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, স্কোয়াশ চাষে ব্যাপক সফলতা অর্জনের কথা। ঘিওর উপজেলার পুরানগ্রামের মো. জয়নাল আবেদীন ঝন্টু। তিনি এবার তার সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে আবাদ করেছে স্কোয়াশ। ঝন্টু জানালেন কিভাবে তিনি স্কোয়াশ চাষে ঝুঁকছেন সে কথা। পেশায় কাঁচামাল ব্যবসায়ী ও কৃষক ঝন্টু প্রথম ঝুঁকি নিয়েই এবার তার সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে আবাদ করেছে স্কোয়াশ। আর এই চাষে প্রথমেই তিনি লাভের মুখ দেখেছে। সে জানায়, কাঁচামাল ব্যবসায়ী হিসেবে আমাকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়। অনেক জেলায় স্কোয়াশ চাষে, চাষিরা লাভবান হওয়ায় আমার মধ্যেও আগ্রহ জাগে। তখন এলাকায় এসে ভাইদের সঙ্গে বসে সিদ্ধাস্ত নেই জমিতে স্কোয়াশ চাষ করবো। এবারই সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে স্কোয়াশের চারা রোপণ করি। প্রতি বিঘায় ২০ হাজার টাকা করে খরচ হয়। বর্তমানে এক কেজি স্কোয়াশের দাম ২৫ থেকে ২০ টাকা। এক সপ্তাহ পর পর ট্রাক ভর্তি স্কোয়াশ ঢাকার কাওরান বাজারে পাঠিয়ে থাকি। ৫ দফায় বিক্রি হয়েছে ২ লাখ টাকার ওপরে। তার টার্গেট খরচ বাদ দিয়ে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ হবে। ঝন্টুর ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা শুনেছি স্কোয়াশ চাষ মূলত বিদেশে হয়। নামও বিদেশি। বড় ভাইয়ের উদ্যোগেই আমরা এর চাষ করে লাভ হচ্ছি। আশা করি আগামী বছর আরও বেশি জমিতে এই চাষ করবো। কাটিগ্রাম এলাকার কৃষক ইয়াকুব আলী বলেন, স্কোয়াশ ২৫-৩০ দিনে ফুল থেকে সবজি ধরতে শুরু করে। ৪০-৪৫ দিনের মাথায় ক্ষেত থেকে সবজি তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। বাজারের প্রথম দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, নতুন সবজি পেয়ে ক্রেতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজার ও বাইপাইল সবজি আড়তে তিনি পাইকারি মণ প্রতি ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি করে। কৃষক মো. ফরমান মিয়া জানান, অল্প সময়ে অন্যান্য ফসলের চেয়ে কম খরচে স্কোয়াশ উৎপাদন করা যায়। এছাড়া এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ কুমড়া লাগানো যায় তার চেয়ে দ্বিগুণ এ সবজি আবাদ করা সম্ভব। গাছের একেকটি গোড়ায় ৮ থেকে ১২টি পর্যন্তÍ স্কোয়াশ বের হয়। শুধু এই গ্রামে ঝন্টু কিংবা ইয়াকুব আলীই নয় গ্রামের খেরু মিয়া, ফরমান মিয়া, সিংগাইর উপজেলার বড় কালিয়াকৈর গ্রামের আনোয়ার, বাংগালা গ্রামের কবির হোসেন, মানিকগঞ্জ সদরের কাটিগ্রাম এলাকার শফিক মিয়ার মতো অর্ধশত কৃষক স্কোয়াশ চাষে ব্যাপক সাফলতা পেয়েছে। চলতি বছরে খরচ বাদে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় করার টার্গেট নিয়ে ৮ বিঘা জমিতে স্কোয়াশ আবাদ করেছেন সিংগাইর উপজেলার বড় কালিয়াকৈরের আনোয়ার। দেশের উচ্চ ফলনশীল ফসলের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি উৎপাদন করে সাড়া ফেলে দিয়েছে এ কৃষক। স্কোয়াশ চাষে তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি এলাকার প্রায় ২০ জন শ্রমিককেও স্বাবলম্বী করেছে। তার দেখা দেখি স্কোয়াশ চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এ জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক। স্কোয়াশ চাষি আনোয়ার জানায়, স্কোয়াশ আবাদের সুবিধা হচ্ছে অল্প সময়ে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ফসল উৎপাদন করা যায়। এছাড়া এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ কুমড়া লাগানো যায় তার চেয়ে দ্বিগুণ স্কোয়াশ লাগানো সম্ভব। পূর্ণবয়স্ক একটি স্কোয়াশ গাছ অল্প জায়গা দখল করে। স্কোয়াশের একেকটি গাছের গোড়া থেকে ৮-১২টি ফল বের হয় আর কয়েকদিনের মধ্যেই খাওয়ার উপযোগী হয় তা। তিন মাসে এ ফসল আবাদ করে তিনি খরচ বাদে ১০ লাখ টাকা আয় করার আশা করছে। ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ে একটি চালানে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলীমুজ্জামান মিয়া বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের আবাদ হওয়া স্কোয়াশ আমাদের দেশে দিন দিন জনপ্রিয় সবজি হিসেবে পরিচিত পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে মানিকগঞ্জের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে প্রায় ৬০ একর জমিতে স্কোয়াশের আবাদ হয়েছে। স্বল্প পরিশ্রমে এই চাষে অধিক ফলন পাচ্ছেন এসব কৃষক। তাদের দেখে অন্য কৃষকরাও এ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ফলে প্রতি বছর স্কোয়াশের আবাদের পরিমাণ বেড়েই চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন