সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

দুর্ঘটনায় অঙ্গহানিতেও হার মানেনি জীবনযুদ্ধে

| প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে : সুস্থ স্বাভাবিক দেহের অধিকারী এমন অনেক মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন অজুহাতে ভিক্ষাবৃত্তি করে থাকেন। আবার এমন মানুষও আছেন যাদের ভিক্ষা করার যথার্থ কারণ থাকা সত্তে¡ও এ পেশায় না গিয়ে আত্মসম্মানের সাথে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে জীবিকানির্বাহ করছেন। কুমিল্লা সদর উপজেলার চম্পকনগর সাতোরা গ্রামের ইজিবাইক চালক রাসেল মিয়া উনিশ বছর এমনই একজন তরুণ যার দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হয়েও ভিক্ষাবৃত্তিতে না নেমে তিন চাকার বাহন নিয়ে পথেঘাটে চালাচ্ছে জীবন সংগ্রামের কঠিন চাকা। কুমিল্লার রাসেল এখন দারিদ্র্য আর পঙ্গুত্বের কাছে হার না মানা এক অপ্রতিরোধ্য তরুণের নাম। সংসারের অভাব-অনটনের ভিড়েও গ্রামের হিমেল বাতাস গায়ে মেখে বেড়ে ওঠার পাঁচ বছর বয়সেই বাবা-মায়ের হাত ধরে ২০০৫ সালে রাসেল ও তার ভাইবোনেরা চলে আসে কুমিল্লায়। বাড়ি ভাড়া নেয় শহরতলির চম্পকনগর সাতোরা গ্রামে। রাসেলের পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার চিতৈষীর নরহরিপুর গ্রামে। তার বাবা আবুল বাশার নিজ গ্রামে চা দোকানধারি করতেন। কুমিল্লা শহরে আসার পর রেলস্টেশনে পিঠা এবং তেলেভাজা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে সংসার চালাতেন। চার ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে আবুল বাশারের সংসার। গ্রামে থাকতেই বড় মেয়ে শারমিনকে বিয়ে দেন। শহরে আসার পর বড় ছেলে রহিমকে অটোরিকশা মেরামতের দোকানে কাজে দেন। রাসেল ও তার অপর দুই ভাইকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ছোট দুই মেয়ে ঘরে তাদের মায়ের কাছেই থাকে। স্কুল থেকে আসার পর অবসরে রাসেল তার বাবার সাথে রেলস্টেশনে পিঠা বিক্রি করার কাজে সাহায্য করত। ২০০৭ সালে কুমিল্লা রেলস্টেশনে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে শিশু রাসেলের বাম হাত ও দুটি পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চিকিৎসার পর পঙ্গুত্ব নিয়ে পড়ে থাকে ঘরে। আবুল বাশারের অভাবের সংসার। তার মধ্যে ছোট চার ছেলে মেয়ে স্কুল ও মাদরাসায় পড়ে। ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রায় পাঁচটি বছর কাটে রাসেলের। এলাকার অনেকেই রাসেলের বাবা-মাকে বলত পঙ্গু ছেলেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে দেয়ার জন্য। কিন্তু রাসেলের একই কথা সে ভিক্ষা করবে না। না খেয়ে মরে যাবে তবু ভিক্ষার থালা নিয়ে কারো কাছে হাত পাতবে না। এদিকে পিঠাপুলির পেশা ছেড়ে ২০১২ সালে আবুল বাশার ইজিবাইকের চালক হয়ে ওঠেন। নিজের সঞ্চয়ী টাকাতেই ইজিবাইকটি কেনেন। কিশোর রাসেল পঙ্গুত্ব নিয়ে ঘরে বসে থাকতে চায়নি। বায়না ধরে সে ইজিবাইক চালানো শিখবে। আবুল বাশার ছেলেকে বললেন এক হাতে চালানো অনেক কঠিন কাজ। যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে। তিনি ছেলেকে এ কাজে না আসার জন্য বললে রাসেল তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকে। হাত-পা হারানো ছেলের এরকম অদম্য সাহস আর আগ্রহের কথা শুনে আবুল বাশার মনের ভেতর ভয় নিয়েও খুশি হন। ব্যাস, পঙ্গু ছেলেকে তার পাশে বসিয়ে রাখতেন। এভাবে একবছর ছেলেকে নিজের সাথে রেখে ইজিবাইক চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের ইজিবাইকের চালকের আসনে বসিয়ে অবসরে যান আবদুল কাদের। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় এক হাতের সাহায্যে ইজিবাইক চালিয়ে জীবন সংগ্রামের স্বপ্নযাত্রা। দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হয়েও জীবিকার জন্য লড়াই সংগ্রামের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তকে চ্যালেঞ্জ আর অদম্য সাহসকে পুঁজি করে ইজিবাইক নিয়ে কুমিল্লার রাজপথসহ প্রতিটি অলিগলিতে ছুটছে রাসেল। হারানো হাত-পা তাকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখেতে পারেনি। জীবন-জীবিকার অন্বেষণে এক হাতের জাদুতে সবাইকে অবাক করে দেয়া ১৯ বছর বয়সী অদম্য সাহসী তরুণ রাসেল বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি দুর্ঘটনায় এভাবে আমার অঙ্গহানি ঘটবে। কিন্তু ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। ভিক্ষাবৃত্তি পৃথিবীর সব থেকে নিচুমানের কাজ। আর এমন জীবন চাইনি বলেই বাবা আমাকে জীবিকার পথ দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাবা মারা গেছেন। বাবার ইজিবাইক এখনো যতœ করে রেখেছি। এটা আমার ছোট ভাই রাশেদ চালায়। সে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। বাবার মৃত্যুর পর আর পড়েনি। আরেক ছোট ভাই রাকিব মাদরাসায় পড়ত। সেও এখন ইজিবাইক চালায়। ছোট দুই বোন সুরাইয়া ও সুমিকে পড়ালেখা করাচ্ছি। ওরা কুমিল্লা রেলওয়ে স্কুলে সপ্তম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বাবার হাত ধরে যখন আমি ইজিবাইক চালানো শিখি, তখন থেকে আমি কখনই মনে করিনি আমার দুটি পা, একটি হাত নেই। কখনো মনোবল হারাইনি। সব সময় ভেবেছি দুর্ঘটনার পর যে একটি হাত রয়েছে তা দিয়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব। আর এটা দিয়েই জীবিকার সংগ্রামে পথ চলছে। ইজিবাইক চালিয়ে প্রতিদিন ৭/৮শ’ টাকা রোজগার হচ্ছে। মা, ভাই-বোন নিয়ে আল্লাহতায়ালা অনেক ভালো রেখেছেন।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন