শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

শিশু হত্যা রুখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শিশুর হাসিতে কোনো উদ্দেশ্য, বিধেয় ও কপটতা থাকে না। তার হাসি সরল, নির্মল, পবিত্র এবং প্রাণখোলা ও স্বর্গীয়। যে কোনো পাষাণ হৃদয়ের মানুষও শিশুর হাসিতে মুগ্ধ হয়। একইভাবে শিশুর কান্নায়ও কোনো দুর্বোধ্যতা থাকে না। এ কান্না বড়দের কান্নার মতো নয়। সরল রেখার মতো। তার কান্নায় মানবহৃদয় ব্যথিত ও ব্যাকুল হয়ে উঠে। অনেকে শিশুর কান্না সহ্য করতে পারেন না। ব্যাকুল হয়ে বলেন, ওর কান্না থামাও। সেটা নিজ সন্তানই হোক বা অপরের সন্তান হোকÑ হৃদয়বান মানুষমাত্রই তা করে। শিশুর ক্ষেত্রে ভেদাভেদ খুব কমই থাকে। যে সত্যিকার অর্থে মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন তার কাছে আপন সন্তান-পরের সন্তান বলে কিছু নেই। সব শিশুকেই নিজের সন্তান মনে করে। অন্যের সন্তানের দুঃখ-কষ্ট দেখলে তার জায়গায় নিজ সন্তানের কথা কল্পনা করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। অতি মায়া-মমতায় হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। এটাই মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র। তবে অতি দুঃখের কথা, ইদানীং শিশুর প্রতি আমাদের সমাজের কিছু মানুষের নির্মম আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট ও নিষ্ঠুর। আমরা গত বছর দেখেছি, শিশু রাজন ও রাজীবকে কিভাবে কিছু মানুষরূপী পশু নির্মম ও নির্দয় এবং বিকৃত আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে হত্যা করেছে। ভয়ঙ্কর পেশীবহুল পশু অতি দুর্বল এই শিশু দুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত সপ্তাহে আবারও শিশু নির্যাতন এবং একই পরিবারের চার শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। রাজন ও রাকিবের হত্যাকা-ের ঘটনা নিয়ে আমরা নীরবে-নিভৃতে চোখের পানি ফেললেও তার কোনো প্রভাব সমাজের কিছু নরপশুর উপর একেবারেই পড়েনি। এমনকি তাদের হত্যাকারীদের ফাঁসির শাস্তিও পিশাচ শ্রেণীর মধ্যে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারেনি। এরা আমাদের সমাজে, আমাদের মাঝেই বিচরণ করছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। এর কারণ হচ্ছে, কার মধ্যে বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও পশুত্ব লুকিয়ে আছে তা দেখা যায় না। হয়তো পাশের জনের মধ্যেই এ আচরণ সুপ্ত হয়ে আছে। আমরা মাঝে মাঝে তার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা দেখে চমকিত হই। এমনকি বাবা-মায়ের কাছেও অনেক সময় সন্তানকে নিরাপদ থাকতে দেখা যায় না। বাবা কর্তৃক সন্তান হত্যার খবর প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এমনকি গর্ভধারীনী মাকেও সন্তান হত্যা করতে দেখা যায়। এসব ঘটনাকে আমরা অনেকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং শতাব্দীতে এক-দুটি ঘটে বা দুর্লভ ঘটনা বলে সান্তÍÍ¡না পেতে চাই। তবে বিগত কয়েক বছরে এই দুর্লভ ঘটনা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তা এখন যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। শিশু নির্যাতন ও হত্যা যেন মামুলি ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ ঘটনা গা-সহার দিকে মোড় নিচ্ছে। এ প্রবণতা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, একেকটি নির্মম ঘটনা আঘাত দিতে দিতে আমাদের অনেকের হৃদয়কে ভোঁতা করে তুলছে। আমাদের হৃদয় অবশ ও অনুভূতিহীন হয়ে উঠছে। নির্মম কোনো ঘটনা ঘটলে এক-দুই দিন এ নিয়ে খুব বেদনার্ত হই, তারপর ভুলে যাই। ভুলে যেতেই হয়। কারণ প্রকৃতির এটাই নিয়ম। দুঃখ নিয়ে সারাজীবন চলা যায় না। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, সৃষ্টিকূলের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার শোক সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হয়। এই শোক সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। অতিশোক হলে পনের দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সবচেয়ে কম শোক স্থায়ী হয় বিড়ালের। বিড়ালের বাচ্চা হারিয়ে গেলে বা মারা গেলে মা বিড়াল চব্বিশ ঘণ্টা মিউ মিউ করে স্বাভাবিক হয়ে যায়। শোক স্থায়ী-অস্থায়ীর বিষয় নয়, আমরা যেসব অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক ঘটনায় শোকাভিভূত হই, এ ধরনের ঘটনা যাতে আর একটিও না ঘটে, সেভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছি না। প্রতিরোধও গড়ে তুলছি না।
দুই.
প্রিয় পাঠক দেখুন, কত তুচ্ছ ঘটনা। এক. হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাগাল ও তালুকদার বংশের লোকজনের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। মাসখানেক আগেও আব্দুল আলী বাগাল ও আব্দাল মিয়া তালুকদারের নেতৃত্বে দুই পঞ্চায়েতের লোকজনের মধ্যে সীমানা বিরোধ এবং একটি বরইগাছ কাটা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি সালিশে নিষ্পত্তি হলেও এর রেশ থেকে যায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তালুকদার বংশের চার শিশু পাশের গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের সন্ধান পায়নি। থানায় জিডি-মামলাও করা হয়। কেউ মুক্তিপণ দাবি করেও ফোন করেনি। স্বজনরা মুষড়ে পড়ে। অবশেষে ১৭ ফেব্রুয়ারি করাঙ্গী নদীর পাশ থেকে মাটিচাপা দেয়া চার শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। দুই. ঠাকুরগাঁও শিবগঞ্জে এক লোকের বাগান থেকে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রী কিছু ফুল নেয়ায় লোকটি তাকে খুবই অপমান করে। এই অপমান সইতে না পেরে ছাত্রীটি আত্মহত্যা করে। তিন. সাভারে বচসার জের ধরে সহপাঠী কর্তৃক কলেজ ছত্র খুন। চার. মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে বিরোধের জের ধরে ভাগ্নে কর্তৃক দুই মামা খুন। এমন আরও অনেক তুচ্ছ ঘটনায় শিশু-কিশোর, তরুণ প্রায় প্রতিদিনই খুন হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, অসহায় ও দুর্বল শিশুরাই বেশি নির্যাতিত ও খুনের শিকার হচ্ছে। অবলীলায় খুন করা হচ্ছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতেই ২৯টি শিশুকে খুন করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ঘটনা রয়েছে যা পত্র-পত্রিকায় আসেনি। অর্থাৎ প্রায় প্রতিদিনই একটি করে শিশু খুন করা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি? আমাদের সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে? ঘুনে ধরা সমাজের কথা বলতে বলতে এখন তো দেখা যাচ্ছে, এটা আর এখন কথার কথা নয়, সত্যি সত্যিই ঘুনপোকা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগতও গ্রাস করে ফেলছে। আমরা কেউ বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছি, কেউ হিং¯্র হয়ে উঠছি, কেউ বুঝেও নিশ্চুপ, কেউ আপন প্রাণ বাঁচানো নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। অথচ বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শিক সমাজ আমাদের। বিদেশিরা যখনই বাংলাদেশে এসেছে, আমাদের যুথবদ্ধ সামাজিক কাঠামো, পারিবারিক মূল্যবোধ, একের প্রতি অপরের কোমল মনোভাব, আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হয়েছে। তারা অবাক হয়েছে, পৃথিবীতে এমন সমাজ ও মানুষও কি আছে! যারা পুলিশের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই পারস্পরিক সহমর্মিতা, যুক্তিবোধ, নীতি-নৈতিকতাকে ঊর্ধ্বে রেখে সামাজিক সব সমস্যার সমাধান করতে পারে! চেনা হোক, অচেনা হোক-মানুষের বিপদে আগ-পিছ না ভেবে নিঃস্বার্থভাবে ছুটে যায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজের এই চরিত্র এখন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। পারিবারিক ও সামাজিক শাসন-বারণ মৃয়মান হয়ে পড়েছে। আমরা দেখেছি, গ্রাম হোক আর শহর হোকÑ সর্বত্রই মুরব্বী শ্রেণী সমাজের যে কোনো অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখতেন। পাড়া-মহল্লায় শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ শ্রেণীর চলাফেরায় কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা দেখলে নিজেরাই অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শাসন করতেন। এতে যে পরিবারের সন্তানকে শাসন করা হতো, সে পরিবারের পিতা-মাতা ও অভিভাবকও সন্তোষ প্রকাশ করতেন। সিনিয়র-জুনিয়রের মধ্যকার যে ব্যবধান এবং মযার্দাবোধ তা খুবই মান্য করা হতো। এখন এসব মূল্যবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এক ধরনের বেয়াদবি মনোভাব সম্পন্ন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। সামাজিক রীতি-নীতি ও নৈতিকতা মৃয়মান হয়ে পড়ছে। কোনো অন্যায় ঘটতে দেখলেও না দেখার ভান করার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ক্রমবর্ধমান এ প্রবণতাই আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে শিথীল করে তুলছে। সময়ের সাথে সাথে সমাজের ধরন বদলানোর বিষয়টি অস্বীকারের উপায় নেই। এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম এবং নতুন চিন্তাপ্রবাহের আগমন ও গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই সমাজ পরিবর্তিত হয়। তবে সমাজের যে চিরায়ত আদর্শিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা অক্ষুণœ রেখেই পরিবর্তন সাধিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর একেবারে আমূল পরিবর্তন বা সমূলে উৎপাটন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরকম হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ এক ধরনের উগ্র মানসিকতা অবধারিতভাবেই জন্ম নেবে। যার নমুনা শিশু হত্যাসহ, গুম, খুন, অপহরণ, মাস্তানি, হুমকি-ধমকি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
তিন.
সাধারণত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যে সরকার থাকে, তার নীতি-আদর্শ প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজ ও পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে। যাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচিত করা হয়, মানুষ মনে করে তারাই পারবে রাষ্ট্র ও সমাজের শৃঙ্খলাবোধ ও মূল্যবোধ অটুট রাখতে। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের পরিবার ও সমাজের মধ্য থেকেই তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এখন ক্ষমতাসীন হয়ে যদি ক্ষমতাপ্রাপ্তরা এ বিষয়গুলো ভুলে যায়, তখন সমাজ ও পরিবার উপেক্ষার শিকার হবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের মধ্যে যদি তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের প্রটেকশন দিয়ে নিরাপদ করা এবং নিজস্ব ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, তবে সে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যেও এক ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করে। আবার একটি শ্রেণী নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ক্ষমতাসীন দলের কাছাকাছি যেতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ শ্রেণীটি আনুকূল্য ও প্রশ্রয় পায়। সমাজের এ শ্রেণীটি তখন ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতার দোহাই দিয়ে লাগামহীন হয়ে পড়ে। একে ধমক দেয় তো ওকে ধমক দেয়। একে মারে তো ওকে মারে। সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করে একধরনের ক্ষমতার রাজত্ব কায়েম করে। এ এলাকা আমার এবং তা আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবেÑ এ মনোভাব প্রদর্শন করে চলে। সাধারণ মানুষও দেখে এ শ্রেণীটি নীতি-নৈতিকতার ধার ধারছে না, পেশীশক্তিই তাদের মূল শক্তি এবং রাষ্ট্রেরই ক্ষমতাবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত। সেখানে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি শ্রেণীকে দেখা যায়, তাদের তোয়াজ করতে। সমাজে যখন এরকম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন সে সমাজ ভাল থাকে কী করে! সমাজের দুষ্টুচক্র তো তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। কারণ তারা তো চায়-ই সমাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় তাদের মতো একদল খারাপ মানুষ থাকুক। এতে তাদের বিচরণও অবারিত হবে। এ পরিস্থিতি হলে, সমাজ শিষ্টের দমন, দুষ্টের লালনে পরিণত হওয়াই স্বাভাবিক। শিষ্টরা নিরীহ হয়ে পড়বে, দুষ্টরা সবল হবে। আমরা কি আমাদের সমাজের দিকে তাকালে এ চিত্র দেখছি না? আর যে দেশে জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ ত্রাসের বরপুত্র হয়ে উঠে, রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, সে দেশে জনগণের নিরাপত্তা আশা করা তো অতি দুরাশা ছাড়া কিছু নয়। আমরা কি দেখিনি, গাইবান্ধার এক এমপিকে তার ক্ষমতা দেখাতে শিশুর পায়ে গুলি করতে? ময়মনসিংহের এক এমপির এইটটি (আশি) বাহিনীর তা-বে এলাকার মানুষ ত্রস্ত হয়ে বসবাস করতে? এরা তো এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। এখনও তারা আমাদের সমাজেই বিরাজ করছে। রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, একটি ফুলের টোকাও দেয়নি। অথচ একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও স্বাভাবিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণের দ্বারা যে প্রতিনিধি নির্বাচিত, সে যদি জনগণের সেবার পরিবর্তে গুলি করে বা ত্রাস সৃষ্টি করে, তাকে কোনো অবস্থাতেই জনগণের প্রতিনিধি না রাখা। দুঃখের বিষয়, জনগণের প্রতি যে ব্যক্তি অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাকেই রাষ্ট্র রেখে দিয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে কি মেসেজ যায়? বলাবাহুল্য, ‘তোমাদেরকে এভাবেই শাসন ও শায়েস্তা করা হবে’, এই মেসেজই পৌঁছে। এতে সমাজের দুষ্টলোকের আনন্দের সীমা থাকে না। তারা ঐ জনপ্রতিনিধির ভক্ত হবে এবং অপকর্ম করে বেড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তখন হাত শানানোর জন্য অতি দুর্বল শ্রেণী শিশুরাই তাদের অনুশীলনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। কারণ শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। তাদের মুখ চেপে কোলে করে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। সহজে গলা টিপে ধরা যায়। শুধু শিশু কেন বড়দেরও অপহরণ, মারধর এমনকি খুন করে ফেলা যায়। অথচ রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যাদের উপর, তাদের মূল কাজই হচ্ছে, আগে মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা। নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নির্যাস সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। রাজনীতি হবে, তবে সে রাজনীতির মূল সুর হওয়া উচিত সামাজিক মূল্যবোধের ধারাবাহিকতায়। রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে সার্বিক রাজনীতির কাছ থেকে কি আমরা নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন কোনো বক্তব্য পাই? পাই না। এর কারণ হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের কূপম-ূকতা। তারা নিজেদের আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছে। যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। তাদের নিজস্ব সমাজের বাইরে যারা রয়েছে, তাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করার মানসিকতা খুব একটা নেই। অথচ তারাই আবার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের দাবি করছেন। আমরা কখনো দেখি না, একজন জনপ্রতিনিধিকে তার নিজ এলাকার মানুষের কাছে নিয়মিত যেতে, বৈঠক করে তাদের খোঁজ খবর নিতে। এলাকার মুরুব্বিদের সাথে মিটিং করে এলাকায় কী ধরনের সামাজিক সমস্যা বিরাজমান তা নিয়ে আলাপ করতে। তরুণ শ্রেণীকে সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে, সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করতে। অন্তত লোক দেখানোর জন্য হলেও তো তারা এ কাজটি করতে পারেন। কারণ রাষ্ট্রের ও জনগণের প্রতিনিধির কথা মানুষ শোনে।
চার.
শিশু নির্যাতন ও হত্যা একটি জাতির অগ্রসর হওয়াকে রুদ্ধ করে দেয়। কারণ আজকের শিশু জাতির ভবিষ্যৎ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেই এই প্রক্রিয়া চলছে, চলবে। শিশু জন্মানোর পর বা বৃদ্ধির সময় তাকে যদি মেরে ফেলা হয়, তবে কোনো জাতিই টিকে থাকতে পারে না। যে কোনো বিচারেই শিশু হত্যা একটি জাতীয় অপরাধ। জাতিবিনাশী এ ধরনের অপরাধের সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসনের কথা যদি তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়, তবে তা অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তাদের উচিত অন্তত নিজ নিজ এলাকায় সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে রাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। সমাজের নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে অনুপ্রাণিত করা। অভিভাবকদের মধ্যেও এ বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে, শুধু নিজের সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হবে না, অন্যের সন্তানের দিকেও নজর দিতে হবে। নিজ সন্তানের প্রতি যতটুকু মমত্ববোধ রয়েছে, অন্যের সন্তানের প্রতিও ততটুকু মমত্ববোধ প্রদর্শন করা উচিত। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, অন্যের সন্তান বিপন্ন হলে বা বিপথে গেলে নিজের সন্তানও তার প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না। কাজেই শিশু নির্যাতন ও হত্যা রুখতে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন