মোবায়েদুর রহমান : গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে পার হয়ে গেছে। প্রতি বছরই দিবসটি আসে একটি হুজুগ নিয়ে। এবার সেই ট্রাডিশন ধরে হুজুগ নিয়েই এসেছিল। সারা বিশ্বের তরুণ-তরুণীরা যখন তাদের প্রেম প্রকাশের জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিকে অর্থাৎ একটি বিশেষ দিবসকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করছিল তখন পৃথিবীর অন্তত তিনটি দেশের বেশ কিছু সংখ্যক তরুণ-তরুণী বিপরীত পথে হেঁটেছিল। এই তিনটি দেশ হলো: ২২ কোটি লোকের দেশ ইন্দোনেশিয়া, ১৮ কোটি লোকের দেশ পাকিস্তান, ৩ কোটি ১৩ লাখ লোকের দেশ মালয়েশিয়া। গত মঙ্গলবার ইন্দোনেশিয়ার সোরাবায়া নামক শহরে ভ্যালেন্টাইনস দিবস পালনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে সেখানকার তরুণ-তরুণীরা। তারা আওয়াজ তুলেছে, তথাকথিত ভালোবাসা দিবস পালন মুসলিম সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছে, ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন অবৈধ শারীরিক সম্পর্ককে উৎসাহিত করে। তরুণদের সাথে তরুণীরাও মাথায় স্কার্ফ পরে রাস্তায় নেমে আসে। তারা যে বিশাল শোভাযাত্রা বের করে সেই শোভাযাত্রার প্লাকার্ডে লেখা ছিল- ‘নো টু ভ্যালেন্টাইনস ডে’। এই আন্দোলনের সংগঠক পান্ডু স্যাট্রিয়া বলেন, আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে অবাধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। এ ঘটনা আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই বিক্ষোভে অংশ নেয় সেই স্কুলের হেডমাস্টার আইদা ইন্দায়াতি ওয়ালিয়ালি তরুণ-তরুণীদের এই ভ্যালেন্টাইনস বিরোধী বিক্ষোভের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একটি গৌরবের বিষয়। সমগ্র জাতির জন্য এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৫ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়ার মুসলিম ধর্মীয় নেতারা ভ্যালেন্টাইনস ডে পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এবার ইন্দোনেশিয়াতেও দিবসটি পালনের বিরুদ্ধে শুধু বিক্ষোভই হয়নি, কনডম বিক্রিতেও বাধা দেওয়া হয়েছে।
ওইদিকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ভ্যালেন্টাইনস দিবস পালনের একদিন আগে অর্থাৎ সোমবার সর্ব সাধারণের চলাচলের স্থান ও সরকারি অফিসে ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন নিষিদ্ধ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা সারা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে বলে আদালতের ওই আদেশে বলা হয়েছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে পালনের একদিন আগে পাকিস্তানের উচ্চ আদালত এই আদেশটি জারি করলেন। আদেশদাতা বিচারপতি শওকত আজিজ এই আদেশটি অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রণালয়, পাকিস্তান ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া রেগুলেটরি অথরিটি (পিইএমআরএ) এবং ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়েছে যে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকেও এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। পিইএমআরএকে এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতেও বলা হয়েছে।
আবদুল ওয়াহিদ নামক পাকিস্তানের একজন নাগরিক এ ব্যাপারে একটি মামলা করলে আদালত এ আদেশ জারি করেন। আবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্যালেন্টাইনস দিবসের যে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় সেটি সম্পূর্ণরূপে ইসলামী শিক্ষা বহিভর্‚ত এবং অবিলম্বে এটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা প্রয়োজন। আবেদনে আরো বলা হয়, এই দিবসটি যাতে কোনোক্রমেই জনসাধারণের চলাচলের পথে পালিত না হতে পারে সে জন্যও আদালতের নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন রয়েছে। মাননীয় আদালত আবেদনটির শুনানি করেন এবং ভ্যালেন্টাইনস দিবস ও রাস্তাঘাটে এর পালনের ওপর উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
!! দুই !!
এর মধ্যে বাংলাদেশে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এখনো বড় ধরনের হৈচৈ শুরু হয়নি সত্যিই, কিন্তু বিষয়টির সাথে সামাজিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ জড়িত বলে এটির কিছুটা বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ঘটনাটি হলো, সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে স্থাপিত ফোয়ারায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করেছেন মৃণাল হক। ভাস্কর্যটিতে দেখা যায় যে, একজন নারী ডান হাতে তলোয়ার এবং বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরে দন্ডায়মান। তার হাতে ধরা তলোয়ারটি নিচের দিকে নামানো এবং দাঁড়িপাল্লা উপরের দিকে। এই ভাস্কর্য স্থাপনের পর থেকেই বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন এটি অপসারণের জন্য দাবি করে আসছে। এই ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে গত ২ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এটি অপসারণের দাবি করে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ও জাতীয় ঈদগাহ থেকে এই মূর্তি অপসারণের জন্য আবেদন করেন জাতীয় ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলহাজ মোহাম্মদ আবুল হাসান। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার এই ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে প্রধান বিচারপতির কাছে দ্বিতীয় স্মারকলিপি পেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার অফিসের তরফ থেকে স্মারকলিপিটি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ। হেফাজতের স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৪৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ছিল দাঁড়িপাল্লা। বিগত ৬৮ বছর ধরেই দাঁড়িপাল্লা শোভা পাচ্ছিল সুপ্রিম কোর্টে। কেউ এর বিরুদ্ধে এই ৬৮ বছর ধরে একটি প্রতিবাদও করেনি। ৬৮ বছর পর হঠাৎ করে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লার জায়গায় গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হলো কেন? গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন করে তারা কোন ধরনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন সেটি জনগণের কাছে বোধগম্য নয়। তাহলে কি বিগত ৬৮ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে কি কোনো ন্যায়বিচার হয়নি?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়টির প্রতিবাদে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ যে নারী মূর্তিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে তিনি হলেন গ্রিক দেবী থেমিস। তাকে সাদা শাড়ি পরিয়ে দন্ডায়মান করা হয়েছে। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে রয়েছে পানি। আর ওই পানির মধ্যে ফুটে আছে শাপলা। তার মধ্যে দন্ডায়মান দেবী থেমিস। মৃণাল হক কি বোঝাতে চাচ্ছেন যে, আমাদের উচ্চ আদালত শাড়ি পরিহিতা গ্রিক দেবী থেমিসের অনুসারী? আমাদের এই আদালত চলবে গ্রিক দেবীর স্বর্গীয় আদেশের মাধ্যমে? এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে কি বাংলাদেশের আইন আদালত এবং বিচার ব্যবস্থাকে গ্রিক দেবীর অধীনস্থ করা হচ্ছে না? তারা কি চাচ্ছেন, বাংলাদেশের মানুষ দেবী থেমিসের অনুরক্ত হন এবং তার প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা দিনের পর দিন বাড়তে থাকুক?
গ্রিক পুরানে আছে ১২ জন টাইটান। এর মধ্যে ৬ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী। পুরুষ টাইটানদের নাম হলো ওসানাস, হাইপেরিয়ন, কৈয়াস, ক্রনাস, ক্রিয়াম ও ল্যাপেটাস। নারী টাইটানদের নাম হলো- মেনেমোসাইন, টেথিস, থিয়া, ফোয়েবে রিয়া ও থেমিস। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গ্রিক পুরানের ১২ জন দেব-দেবীর মধ্যে থেমিস অন্যতম।
এখন থেমিস সম্পর্কে দুটো কথা। হিন্দু পুরানের দেব-দেবীরা বাংলাদেশে যত পরিচিত গ্রিক পুরানের দেব-দেবীরা তত পরিচিত নন। সে জন্য গ্রিক দেবী থেমিসের কিছুটা পরিচয় দেওয়া দরকার। ১২ জন গ্রিক দেব-দেবীর মধ্যে থেমিস আইনশৃঙ্খলার দেবী। দেব-দেবীরা সেই জমানায় যেসব সনাতনী আচার-আচরণ প্রবর্তন করেন তার মধ্যে থেমিসের আইনকানুনগুলোই সর্বপ্রথম প্রবর্তিত হয়। এসবই পৌরাণিক কাহিনী। তবুও সেই কাহিনী মতে, থেমিস ছিলেন ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন দেবী, যার ছিল ভবিষ্যৎ বাণী করার ক্ষমতা। গ্রিক পুরানে তাকে বলা হয়েছে একজন ওরাকল। ওরাকল হলেন এক ধরনের ধর্মগুরু। তারা বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হন। কোনো একটি বিষয়ে তাদের অগাধ বুৎপত্তি থাকে। ওরাকল জনগণকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ওরাকল হলেন তিনি, যিনি যখন যে পরামর্শ দেন ও ভবিষ্যৎ বাণী করেন সেগুলো সরাসরি ঐশ্বরিকভাবে প্রাপ্ত হন। ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর মাঝে মাঝে ওরাকলের মাধ্যমে মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলেন।
গ্রিক পুরানে বলা হয়েছে দেবী থেমিস এমন একজন ওরাকল। তিনি ওরাকলদের ওরাকল অর্থাৎ দেবীদের দেবী, যিনি দেবীদের সভায় সভাপতিত্ব করতেন। এই ভ‚মিকায় তার কণ্ঠ দিয়ে যেসব বাণী নিঃসৃত হতো সেগুলো স্বর্গীয় সূত্রে পাওয়া যেত বলে গ্রিক পুরানে বলা হয়েছে। এই ভ‚মিকায় তিনি মানব জাতিকে ন্যায়বিচার করা এবং নৈতিকতা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশ ও পরামর্শের মধ্যে রয়েছে মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন, অতিথির সৎকার, সুশাসন, সভা-সমাবেশ পরিচালনা করা ইত্যাদি। গ্রিক ভাষায় থেমিস শব্দের অর্থ হলো ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় আইন। এগুলো হলো সেই আইন, যেগুলো যুগের পর যুগ ধরে প্রথা হিসেবে চলে আসছে। মানুষের আচার-আচরণ এবং সৎগুণ থেমিসের পরামর্শ ও নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেবী থেমিস ছিলেন গ্রিক দেবতা জিউসের প্রথম পত্মী। স্ত্রীর ভ‚মিকা ছাড়াও তিনি দেবতা জিউসের ছিলেন মন্ত্রণাদাতা। জিউস যখন দেব সভায় বসতেন তখন থেমিস তার পাশে আসন গ্রহণ করতেন। সেই আসনে বসে তিনি জিউসকে স্বর্গীয় আইন এবং ললাট লিখন সম্পর্কে পরামর্শ দিতেন।
আমরা আগেই বলেছি যে, থেমিস বা টাইটানদের কাহিনী হলো পৌরাণিক। বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব কোনোকালে ছিল না। সেই পৌরাণিক কাহিনীর এক দেবীকে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে কেন? আপনারা কেউ যদি ইন্টারনেটে যান তাহলে দেবী থেমিসের শত শত ছবি কম্পিউটারের মনিটরে দেখতে পাবেন। তার সব ছবিতেই কিন্তু তিনি দাঁড়িপাল্লা এবং তলোয়ার ধারণ করেননি। ভিক্টোরিয়ান যুগের মহিলাদের পোশাকেও তাকে দেখা যায়। আসলে গ্রিক টাইটান তথা দেব-দেবী তথা থেমিসের কাহিনীটি পৌরাণিক হলেও মূলত সেটি তাদের একটি ধর্মীয় কাহিনী।
খ্রিস্টানদের ধর্মীয় কাহিনী দেবী থেমিসে পার্সোনিফাইড হয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে শোভা পাবে কেন? নীতিনৈতিকতা এবং ইনসাফের কথা যদি বলতেই হয় তাহলে গ্রিক তথা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় কাহিনী থেকে ধার করে আনতে হবে কেন? যে দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান সেই বাংলাদেশে কল্পনার দেবী থেমিসকে সুপ্রিম কোর্টে বসাতে হবে কেন? ৬৮ বছর ধরে যে দাঁড়িপাল্লা ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে উদ্ভাসিত ছিল সেটিকে হঠাৎ করে নির্বাসনে পাঠিয়ে গ্রিসের খ্রিস্টান দেবীকে আমদানি করতে হবে কেন? সুপ্রিম কোর্টে যদি ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি করতে হয় তাহলে পবিত্র কোরআন অথবা পবিত্র হাদিসের এক বা একাধিক পাক কালাম উদ্ধৃত করা হয়নি কেন? কোরআন শরিফ বা হাদিস শরিফের সত্য ও ন্যায়ের অমীয় বাণীর কি অভাব হয়েছে? আমরাও তাই মনে করি, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে শাড়ি পরিহিতা গ্রিক দেবী থেমিসকে অবিলম্বে অপসারণ করা হোক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন