সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

দামুড়হুদা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ফাগুনের আগুন ঝরা শিমুল গাছ

| প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে : চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ফাগুনের আগুন ঝরানো উপকারী শিমুল গাছ। আগুন ঝরা ফাগুনে চোখ ধাঁধানো গাঢ় লাল রঙের অপরূপ সাজে সজ্জিত শিমুল গাছ আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবসহ নানা প্রতিক‚লতায় ক্রমান্বয়ে এ গাছ হারিয়ে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। এ গাছ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন মহল। জানা গেছে, নানা প্রতিক‚লতায় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে নানা উপকারী শিমুল গাছ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ গাছের যথেষ্ট ভ‚মিকা থাকলেও এ গাছ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। দামুড়হুদার গ্রামাঞ্চলে এ শিমুল গাছকে অনেকে পাকড়া গাছ নামেও ডেকে থাকেন। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে এ শিমুল গাছের প্রচলিত নাম শিমুল বা তুলা গাছ। শিমুল গাছের সব অংশেরই রয়েছে ভেষজগুণ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা এখনো নানা রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে থাকেন। এ গাছের ইউনানী নাম সেম্ভল। আয়ুর্বেদিক নাম শিমুল বা শেম্ভল, ইংরেজি নাম ঝরষশপড়ঃঃড়হ ঃৎবব. আর এর বৈজ্ঞানিক নাম ইড়সনধী পবরনধ খরহহ (বোমবাক্স সাইবা লিন)। এটি ইড়সনধপধপবধপ (বোমবাকাসিয়াক) পরিবারের অন্তর্গত উদ্ভিদ। শিমুল গাছ বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কম বেশি দেখা যায়। সাধারণত, বীজ ও কাÐের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার হয়ে থাকে। রোপণের ৫-৬ বছরের মধ্যে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। প্রাকৃতিকভাবে তুলার সাথে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়া বীজ থেকেই এর জন্ম হয়। আগে জেলার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ধার, মাঠ ও বসতবাড়ির পাশে বড় বড় শিমুল গাছ দেখা গেলেও বর্তমানে বড় গাছ তেমন একটা চোখে পড়ে না। অন্যান্য গাছের মতো এ গাছ কখনো কেউ শখ করে লাগায় না। নেয়া হয়না কোনো যতœ। সমাধারণত, অযতেœ অনাদরে প্রাকৃতিকভাবেই এ গাছ বেড়ে ওঠে। জ্বালানি, নির্মাণ কাজ, নানা ধরনের প্যাকিং বাক্স তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যাপক ব্যবহার হওয়ায় এলাকা থেকে শিমুল গাছ ক্রমান্বয়ে উজাড় হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন দামুড়হুদা উপজেলাসহ চুয়াডাঙ্গার জেলার সর্বত্রই এ গাছ চোখে পড়তো। সুদূর অতীতেও বসন্তের শুরুতেই গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে জন্ম নেয়া ও অনাদরে বেড়ে ওঠা শিমুল গাছের শাখাগুলো বসন্তের আগমনে লাল শাড়ির ঘোমটা পরা গ্রাম্য নববধূর সাজে সজ্জিত হতে দেখা যায়। যা দর্শনে হতাশ প্রেমিকের মনেও জাগিয়ে তোলে আশা। অন্যান্য গাছের তুলনায় শিমুল গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় বহু দূর থেকে এ মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। সবুজ বনানীর ভেতরে আগুন রাঙা শিমুল ফুলের বাহারে চোখ জুড়িয়ে যায়। আদিকাল থেকে দামুড়হুদাসহ আশপাশ এলাকায় বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে শিমুল ফুল প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে আসছে। অথচ বর্তমানে মানুষ এ গাছকে তুচ্ছ মনে করে কারণে অকারণে কেটে ফেলছে। দৃষ্টিনন্দন শিমুল ফুলের টকটকে লাল পাঁপড়িগুলো মানুষের নজর না কেড়ে পারে না। জোয়ার এনে দেয় কবির কল্পনার জগতে। কেবল সৌন্দর্যই বিলায় না শিমুল গাছের রয়েছে নানা উপকারিতা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব¡। এ গাছের কাঠ দিয়ে এক সময় দিয়াশলাইয়ের খোল, টুথপিকসহ বিভিন্ন জিনিস প্যাকিংয়ের জন্য বাক্স তৈরি হতো। অতীতে ব্যাপকহারে ইমারত নির্মাণ কাজে সাটারিংয়ের পাটাতন, নানা ধরনের প্যাকিং বাক্স তৈরি ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও সেই তুলনায় রোপণ না হওয়ায় এলাকা থেকে এ গাছ হারাতে বসেছে। এ গাছের প্রায় সব অংশই কাজে লাগে। এর ছাল, পাতা ও ফুল গবাদিপশুর খুব প্রিয় খাদ্য। এখনো এ গাছের ছাল, শিকড় ও বীজ ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষ করে পুরুষের শুক্রবর্ধক হিসাবে এবং মেয়েদের প্রদর ও অতিরিক্ত রক্ত¯্রাবে কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করে থাকে বলে এখনো গ্রামাঞ্চলে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বালিশ, লেপ ও তোষক তৈরিতে শিমুল তুলার জুড়ি নেই। শিমুল গাছ সাধারনত, ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায়। সেই তুলনায় মোটাও হয় বেশ। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিমুল গাছ এক দেড়শ’ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। শীতের শেষে পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শুরুতেই শিমুল গাছে ফুল ফোটে। আর এ ফুল থেকেই হয় ফল। চৈত্র মাসের শেষের দিকে ফল পুষ্ট হয়। বৈশাখ মাসের দিকে ফলগুলো পেকে শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে আপনা আপনিই ফল ফেটে তুলায় আটকে থাকা বীজ বেরিয়ে বাতাসে উড়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আর তুলার সাহায্যে বীজ উড়ে গিয়ে এর বংশবিস্তার হয়। তাই ফল ফাটার আগেই গাছ থেকে পেড়ে এ থেকে তুলা ছাড়িয়ে রোদ্রে ভালোভাবে শুকিয়ে নিলে বীজ ও তুলা আলাদা হয়ে যায় এবং এ তুলা ব্যবহার উপযোগী হয়। একটি বড় আকারের শিমুল গাছ থেকে বছরে গড়ে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকার তুলা পাওয়া যায়। এ গাছ উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের উপরেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় কাক, কোকিল, চিল, বক, কাঠ ঠোকরাসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি বাসা বেঁধে বসবাস করত। এ গাছ উজাড় হওয়ার ফলে এসব পাখিরা আবাসস্থল হারিয়ে পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। গাছ না থাকায় আবাসস্থলের অভাবে ধীরে ধীরে এসব পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে এলাকা থেকে। উপজেলার দর্শনা বাজারের লেপ-তোষক ব্যবসায়ী আ. রব জানান, বিগত সত্তরের দশকেও প্রতি মণ শিমুল তুলা ২শ থেকে ৩শ টাকায় বিক্রি হতো। কিন্তু বর্তমান বাজারে শিমুল তুলা প্রায় নয় হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। সারা বছর নানা কাজে ব্যবহারের জন্য ব্যাপকহারে এ গাছ কাটা হলেও সেই তুলনায় রোপণ না হওয়ায় গাছের সংখ্যা কমছেই। বর্তমানে বড় গাছ সচরাচর চোখে পড়ে না। সচেতন মহল মনে করেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে রাস্তার ধার, পুকুর পাড়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পতিত জমিতে অন্যান্য গাছের পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজনেই প্রতি বছর কিছু কিছু শিমুল গাছ রোপণ করা উচিৎ। বর্তমানে যেভাবে শিমুল গাছ উজাড় হচ্ছে তাতে করে এ গাছ রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা না নিলে এক সময় উপকারী গাছের তালিকা থেকে এ গাছটি হারিয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জানতেও পারবে না বাংলার মাটিতে শিমুল নামের কোনো গাছ ছিল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন