আফতাব চৌধুরী
১.
সুদূর অতীতকাল থেকে অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেট অঞ্চল। ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সিলেট অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। প্রসারমান ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ‚রাজনৈতিক পটভূমি, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক ভূমিকা, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময় সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক লালন ও উজ্জীবন আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সিলেটকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মহিমা, করেছে তাৎপর্যময় ও সর্বাধিক গুরুত্ববাহী। স্বাভাবিকভাবেই সিলেটের এমন প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ার পেছনে এখানকার পরিবেশ, বন-বনানী, আবহাওয়া, পারিপার্শি¦কতার ভূমিকা ও প্রভাব শুধু প্রত্যক্ষই নয় সুদূরপ্রসারীও বটে। জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র, আবহাওয়ার বৈচিত্র্য অথচ সহনীয় মাত্রার জনপদ হিসেবে এ অঞ্চল তুলনামূলকভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অধিকারী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সিলেট অঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ইকোপার্ক, বিপুল মৎস্য সম্পদে ভরা অগণিত হাওর, খাল-বিল, অতুলনীয় দৃষ্টিনন্দন স্রোতস্বিনী মাধবকুন্ড ও হামহাম জলপ্রপাত। এখানে রয়েছে সারি সারি পাহাড়ের গায়ে সবুজ মায়া আর রূপলাবণ্যের পেখম ছড়ানো অসংখ্য চা-বাগান। সিলেটের মাটি অপার রত্মগর্ভা। এ মাটিতে মওজুদ আছে গ্যাসসহ নানা খনিজ সম্পদ ও পাথর। হাজার বছরের ঐতিহ্যঘেরা বনসমূহে ৬২০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২১৫ প্রজাতির পাখি, ৪৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫২ প্রজাতির সরিসৃপ, ২০ প্রজাতির উভচর সিলেটকে জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব বৈশিষ্ট্য দান করেছে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ধমীয় নিদর্শন ও প্রতিষ্ঠান, স্থাপত্যকলা, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনাচার, জলাভূমি-জলাধারের সৌন্দর্য আকর্ষণে হাজারো পর্যটক প্রতিদিন পরিভ্রমণে ছুটে আসেন।
২.
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ একটি অতি আলোচিত বিষয়। বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি ও গ্রিনহাউস এফেক্টের ফলে সর্বব্যাপী বিরূপ প্রভাবে মনুষ্য বসবাস, জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুস্পষ্টভাবে হুমকির সম্মুখীন। সারা বিশ্বে অতিরিক্ত কয়লা ও অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক বয়ানে জানা যায়, পৃথিবীতে গড় কয়লার ব্যবহার বেড়েছে ১০ কোটি ৭০ লক্ষ টন। এ বৃদ্ধির হার ৬ কোটি ৩০ লক্ষ টন। উন্নয়নশীল বিশ্বে শিল্পে মাত্রাতিরিক্ত কয়লার ব্যবহার প্রায় ১.৫ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবজনিত কারণে বায়ুমন্ডলে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাউডের পরিমাণও। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৯৫০ সাল থেকে কয়লার অধিক ব্যবহারজনিত কারণে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পশ্চিমা দেশসমূহে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার শতকরা ৫০ ভাগ থেকে হ্রাস পেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে শতকরা ৪৫-এ দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্বে সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ সংঘটিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যার হার শতকরা ২৩ ভাগ। এ হার ১৯৯৬ সালে প্রায় ৩.৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসণের এ মাত্রা বর্তমানে অব্যাহত আছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে অস্ট্রেলিয়ায় এ বৃদ্ধির হার শতকরা ৯.৬ ও জাপানে গত ছয় বছরে এ হার শতকরা প্রায় ১২.৬ ভাগ বেড়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপে ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ শতকরা ২০ থেকে কমে সাম্প্রতিক ফল ১৫-এ দাঁড়িয়েছে। এর কারণ গত এক দশকে সেখানে কয়লা শিল্প ব্যবহার কমে যাওয়া।
উন্নয়নশীল দেশসমূহে কয়লার বহুল ব্যবহারের কারণে ১৯৫০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ শতকরা ২৪ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিঃসরণ বৃদ্ধির শতকরা হার হলো ৪০। বাংলাদেশে কয়লার ব্যবহারজনিত কারণে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার বেড়েছে শতকরা ৩৮ হারে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির জন্য মানুষের ভ‚মিকা বেশি। বাতাসে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে বায়ূদূষণের মাত্রা শতকরা ৬৪। পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার ব্যাপারে এ ক্ষতিকারক গ্যাস বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫০ পিপিএমে এসে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষতিকারক গ্যাসে বায়ু দূষিত হয়ে পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি করেছে ৩ থেকে প্রায় ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে থাকলে একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জন্য অনেক নৈসর্গিক বিপর্যয় ও উত্তাপ বৃদ্ধির কারণে পূর্বে যেসব স্থানে মশাবাহিত রোগ কম ছিল সেখানে মশাবাহিত রোগের সম্ভাবনা দ্রুত হারে বাড়বে। এ উত্তাপ বৃদ্ধির হার চলতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যহানীর সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব আবহাওয়াবিদদের সংগঠন আইপিপিসি তাই স্থির করেছে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের উৎস প্রায় ২০ কোটি টন কমাতে হবে। এ সংগঠিত প্রচেষ্টা সফল হলে এ ক্ষতিকারক গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ৩৫০ পিপিএম লেভেলে আসবে। এভাবে বায়ুদূষণের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পেলে পৃথিবীর উত্তাপ গত দু’লক্ষ বছরের লেভেলে নিয়ন্ত্রিত হবে।
গত কিওটো সম্মেলনে স্থির হয়েছে যে, পৃথিবীর শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে কয়লার হার দ্রæত হারে কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালানো হবে। কিওটো ঘোষণাপত্রে ১৭১টি দেশ অংশ নিয়েছিল। কিওটোয় স্বাক্ষরকারী দেশসমূহে ১৯৯০ সালের তুলনায় ইতোমধ্যে এ ক্ষতিকারক গ্যাস হ্রাস পেয়েছে শতকরা ২.৩ ভাগ। তবে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দায়িত্ব বেশি।
৩.
ভ‚পৃষ্ঠ ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। বিশ্বের উষ্ণায়নের অর্থ ভ‚পৃষ্ঠের কাছাকাছি বাতাস এবং সমুদ্র্র্রের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি। বিগত কয়েক দশক ধরে এ গড় উষ্ণতা বেড়ে চলেছে এবং আগামী দিনে এটি ক্রমাগত বেড়ে চলার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) হিসেবে গত ১০০ বছরে পৃথিবীর গত তাপমাত্রা ০.৭৮+০.১৮ সেলসিয়াস (১.৩৩+০.৩২ ফা) বেড়েছে। আইপিসিসির বক্তব্য, প্রধানত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এ বিশ্ব উষ্ণায়নের শুরু এবং এর জন্য দায়ী মূলত গ্রিনহাউস গ্যাস।
প্রাক শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। যেমন সৌর বিকিরণ বা অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বিশ্ব সামান্য উত্তপ্ত এবং ১৯৯৫ সালের পর থেকে পিসিসির মতে, একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর উষ্ণতা আরও ১.১ ডিগ্রি থেকে ৬.৪ ডিগি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ভবিষ্যতে গ্রিনহাউস গ্যাসের বিভিন্ন পরিমাণে নির্গমন ও অন্যান্য কারণে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও প্রকৃতির রোধ থেকে নি®কৃতি পাওয়া যাবে না। কারণ সমুদ্রের পানি ঠান্ডা হতে বেশি সময় নেওয়ায় সমুদ্রের স্ফীতি বজায় থাকবে ১,০০০ বছরের ও বেশি সময় ধরে।
প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় তাতে পৃথিবীর উষ্ণতা থাকে গড়ে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারত না। মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেভাবে ব্যবহার করছে বিশেষত শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে। এতে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে চলেছে। আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতল উঠে আসবে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও সময় বদলে যাবে। এছাড়া হিমবাহ গলবে, বিভিন্ন প্রজাতির জীব লুপ্ত হয়ে যাবে, রোগভোগ বাড়বে।
মানুষের কৃষিকাজ ইত্যাদির কারণে বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রাক শিল্প বিপ্লব যুগের তুলনায় বর্তমানে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১৪৯ শতাংশ বেড়েছে। গত বহু বছরের মধ্যে বাতাসে মিথেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৮৩ পিপিএম। আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ২১০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৪১ থেকে ৯৭০ পিপিএম। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়া ও জমির ব্যবহারে পরিবর্তনের কারণে বর্তমান সময়ের তুলনায় ভবিষ্যতে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়বেই। তবে কতটা বাড়বে তা নির্ভর করছে আমরা কী করছি তার উপর।
বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রধানত দুভাবে সমুদ্রের পানি স্তুরের আয়তন বাড়বে। ১) সমুদ্রের পানির তাপীয় প্রসারণ ঘটবে, ২) মেরু অঞ্চলের বরফ গলবে। সাধারণত হিসেব মতে, বর্তমান গতিতে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে এ শতাব্দীর শেষ দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটারের মতো বৃদ্ধি পেতে পারে। যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের বহু দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল জলমগ্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে। কয়েক কোটি উপকূলবর্তী মানুষের গৃহহীন হওয়ার আশংকা রয়েছে। ভারতের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সীমানা সমুদ্রবেষ্টিত। এ সীমানা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বহুলাংশে। এছাড়া হিমালয়ের হিমবাহ সমুদ্রের বরফ যেভাবে গলতে শুরু করেছে তাতে আগামী দিনে হিমালয়ের নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমবে। বাংলাদেশসহ সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকার আবহাওয়া একদিন হয়তো শুষ্ক ও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশসহ হিমালয়ের বুকে যে নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের অতি মূল্যবান পাইনের অরণ্য রয়েছে। সেগুলো হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে। এ ছাড়া হিমালয়ের আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ ভারতের সমতল ভ‚মির আবহাওয়ায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এতে ক্ষতির পরিমাণ হবে অভাবনীয়। বাংলাদেশ ও ভারতের কৃষি উৎপাদনে আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
পৃথিবীর উষ্ণায়নের জলবায়ুর যে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটছে, এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ও সময়, ঝড় ঝঞ্ঝার গতিবেগ ও সময় ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন ঘটবে। বিগত কয়েক দশক ধরে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ও সময়, সামুদ্রিক ঝড়ের গতি-প্রকৃতির নানা পরিবর্তন হচ্ছে। এছাড়া বছরের বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তন ঘটছে। এর প্রতিক্রিয়া জীবমন্ডলের উপর স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষভাবে বস্তুতন্ত্রের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে এমনভাবে প্রভাবিত করবে যে, নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বনভ‚মি দ্রæত হ্রাস পাচ্ছে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে।
অনেকেই শব্দদূষণ বিষয়ে অবগত নন। ফলে প্রতিদিন শব্দদূষণ ঘটছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের আশপাশে। এক মিটার দূরত্বের মধ্যে দুজন মানুষ একটু উচ্চ স্বরে কথা বললে শব্দ উৎপন্ন হয় ৬০ ডেসিবেল। মোটরগাড়ির হর্নের শব্দ ১০০ ডেসিবেল। নিষিদ্ধ হাউড্রোলিক হর্ন আরও বেশি ক্ষতিকারক শব্দ সৃষ্টি করে। বাস-ট্রাক চলার সময় ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ সৃষ্টি করে। অথচ মানব শরীরের শব্দ ধারণক্ষমতা মাত্র ৭০ ডেসিবেল। আমাদের দেশে শব্দদূষণের পরিমাণ ৮০ থেকে ১২৫ ডেসিবেল। বাসায় আমরা অনেকেই রেডিও, টিভি, টেপ, ক্যাসেট প্লেয়ার, সিডি, ডিভিডি উচ্চস্বরে বাজাই। এতে শব্দ দূষণের মাত্রা থাকে ৮০-১০০ ডেসিবেল। যা স্বাভাবিক মাত্রা ৭০ ডেসিবেল এর চেয়ে ১০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি।
শব্দদূষণ চোখ ও মাথার ক্ষতি করে। হর্নের শব্দ ধমনীকে সংকুচিত করে হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। চিকিৎসকের মতে শব্দদূষণে অনেকে হৃদরোগ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞের মতে, কেউ ক্রমাগত ৮ ঘণ্টা ৯০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে বসবাস করলে ২৫ বছরে তার বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বড় শহর ও নগরে শব্দদূষণ এখন অত্যাচারের পর্যায়ে। অথচ শব্দ দূষণ প্রতিরোধে দেশে আইন থাকলেও কার্যকর হচ্ছে না।
এক গবেষণায় জানা যায়, মাথা ধরা, বিরক্তি, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের ব্যাঘাত, কানে কম শোনা ও মনোসংযোগের অসুবিধাসহ অন্যান্য অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় অতিমাত্রায় শব্দদূষণের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের একাধিক গবেষণা ও সমীক্ষায় জানা যায়, দেশের ত্রিশটি কঠিন রোগের প্রধান কারণ বারো ধরনের পরিবেশ দূষণ। শব্দদূষণ এর অন্যতম। শব্দদূষণের লক্ষ্যে দেশে কাজ করছে বেশ কিছু সংগঠন। সরকারিভাবে একটি খসড়া আইনও জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে দীর্ঘ সময়েও তা বাস্তবায়নের কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সিলেট বর্তমানে যানজটের এবং শব্দদূষণের শহর। মাইকের এবং যানবাহনের উচ্চস্বরে হর্ন, বিশেষত হাইড্রোলিক হর্নের কারণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে হুমকিগ্রস্ত। সরকারি-বেসরকারীভাবে শব্দদূষণ প্রতিরোধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াগত ভারসাম্য এবং পরিবেশ রক্ষা ব্যতিরেকে ভবিষ্যৎ বংশধরকে একটি সুন্দর ও বাসোপযোগী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানো অবান্তর। জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ, সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত গবেষণা-পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ একান্ত জরুরি। একই সঙ্গে বন, পরিবেশ ও আবহাওয়া রক্ষায় স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুগপথ সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ন্যায় শিল্প-বিপ্লবের জোয়ার এসে লাগে বাংলাদেশে। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলকারখানা, আবাসিক প্রকল্প। শিল্পজাত দ্রব্যের নানামুখী ব্যবহারে চাহিদা মেটাতে সময়ের সাথে তাল মিলাতে শিল্পকারখানার অবাধ প্রসার উপরন্ত অনিরাপদ, অস্বাস্থ্যকর, অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানা সিলেটের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। পাশাপাশি ব্যাপক হারে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কর্তন, জমিতে অপরিমিত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে আমাদের পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সীমাহীন শব্দদূষণ প্রাকৃতিক স্বপ্নপুরী সিলেটকে জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দিক দিয়ে ক্রমশ অনিরাপদ করে তুলছে। প্রাকৃতিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রম, বনায়নের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যকে প্রাধান্য না দেওয়া, পরিবেশ সংরক্ষণে সময়ানুগ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার ফলে আমাদের প্রাচুর্যময় জীববৈচিত্র্য বর্তমানে মারাত্মক হুমকিগ্রস্ত।
৪.
সিলেট অঞ্চেলের বন-বাদাড় যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলকে চিরসবুজ, ছায়াময়-মায়াময়, ক্লান্তিনাশা শীতলতার ঐশ্চর্যে অপরূপ শোভা দান করেছে। এ অঞ্চলের বন-বনানীতে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের গভীর শেকড়। বনে বনে আছে জীবনদায়ী অফুরান সম্পদরাজি, মানবসভ্যতা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার হরেক রকম উপাদান। অথচ আধুনিক সভ্যতার অতি উৎসাহী ব্যবহার এ চিরহরিৎ বনাঞ্চলের হৃদপুষ্ট চেহারাকে ক্রমশ ¤øান করে দিচ্ছে। অবাধে বৃক্ষনিধন, বৃক্ষরোপণে অনীহার কারণে আমাদের বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন।
সিলেট বন বিভাগের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল অতীত। সিলেট বন বিভাগ ১২৫ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে। T.J. Campball, DCF ( ১৮৯৫-৯৬) কর্তৃক প্রণীত ‘The Assam Rorest Manual’- এ ‘A brief history of the Forest Department in Assam’- হতে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের পূর্ব পর্যন্ত আসাম রাজ্যের বনাঞ্চল বেঙ্গল রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। আসাম বন বিভাগের সূচনা হয় ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে। তখন সিলেটের বনাঞ্চলকে বেঙ্গল রাজ্য থেকে পৃথক করে আসাম বন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বেঙ্গল রাজ্যের বনাঞ্চল এর পূর্বে ঢাকা বন বিভাগের অধীনে ছিল। আসামের বনাঞ্চলকে আসাম বন বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করার ফলে আসাম কমিশনারশিপে যে পাঁচটি বন বিভাগের সৃষ্টি হয় সেগুলো হলো : ১) গোয়ালপাড়া বন বিভাগ, ২) গৌহাটি বন বিভাগ, ৩) তেজপুর বন বিভাগ, ৪) গোলাঘাট বন বিভাগ, ৫) কাছাড় বন বিভাগ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বন বিভাগ পুনর্গঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৫ সালে সিলেট জেলার বনাঞ্চলকে কাছাড় বন বিভাগ থেকে আলাদা করে সিলেট বন বিভাগ নামকরণ করা হয়।
সিলেট বন বিভাগের জেলাওয়ারী বনভ‚মির তথ্য অনুযায়ী সিলেট জেলার সংরক্ষিত বনভ‚মির পরিমাণ ৯,৬৭৬,৩৭ হেক্টর, প্রস্তাবিত বনভ‚মি ১.,৩৩৯,৬১ হেক্টর ও অধিগ্রহণকৃত বনভ‚মি ১২,৯৭ হেক্টর। সিলেট জেলার রিজার্ভ ফরেস্টের পরিমাণ : ১) টিলাগড় রিজার্ভ ফরেস্ট-১১২.০০ একর, ২) খাদিমনগর রিজার্ভ ফরেস্ট-১৮৯০.৭৩ একর, ৩) সোয়াস্প ফরেস্ট-২১৮৯৭.৯০ একর। সিলেট জেলায় মোট ১৫টি মুর্তা মহল রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : উত্তর সিলেট রেঞ্জ-১ এ ৭২০.৯৫ একর এবং রেঞ্জ-২ এ ৩১৪৭.১৬ একর। জেলার ৩টি জলমহালের পরিমাণ হচ্ছে- উত্তর সিলেট রেঞ্জ-১ এ ৪৭৬ একর ও রেঞ্জ-২ এ ৬৪৯.৩০ একর। সিলেট জেলার কৌতি ভাষা মহালের পরিমাণ : উত্তর সিলেট রেঞ্জ-১ এ ৫টি ও রেঞ্জ-২ এ ৪টি।
সিলেটের বনাঞ্চলের নান্দনিক আমেজ সৃষ্টিকারী, প্রাকৃতিক বহুমাত্রিক সৃষ্টিসম্ভারে ভরপুর টিলাগড় ইকোপার্ক, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, জাফলং গ্রিনপার্ক ও রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। ১৯২৭ সালের ৩১ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলাধীন টিলাগড়স্থ ১১২ একর বনভ‚মিকে সংরক্ষণ বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে টিলাগড় ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বনরাজি ও জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাহার রয়েছে এখানে। শকুন, বন মোরগ, পাহাড়ি ময়না, বন বিড়াল, খেকশিয়াল, বানর, খরগোশ, মেছোবাঘ, বেজি, ঘুঘু, টিয়া, মানিকজোড়, গুইসাপ, হুতুমপেচাঁ প্রভৃতি প্রাণীর অভয়ারণ্য। বৃক্ষরাজির মধ্যে শাল, গর্জন, নাগেশ্বর, জারুল, অর্জুন, কদম, চাপাশি, ছাতিম, বহেরা, চম্পাফুল, মোনালু, বহেরা, হরিতকি, বেত বিভিন্ন লতা-গুল্ম রয়েছে।
খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত। সিলেট মহানগরীরর নিকটবর্তী সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের পাশে খাদিমনগর জাতীয় উধ্যান অবস্থিত। ২০০৬ সালে ৬৭৯.০ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়ে এ উদ্যানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০-এর দশকে এখানকার বাঁশবন পরিষ্কার করে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজি দ্বারা বনায়ন করা হয়। খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান নিচু পাহাড়ি এলাকা বিশিষ্ট। পুরোটা প্রায় পাতাঝরা ক্রান্তীয় বন। এ উদ্যানে রয়েছে ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৫ প্রজাতির পাখি, ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বনমোরগ, শকুন, শঙ্খচিল, ঘুঘু, বানর, মুখপোড়া হনুমান, বেঁজি।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা জাফলং। ২০০৮ সালে প্রায় ৫৩৭০ একর বনভ‚মি নিয়ে জাফলং গ্রিনপার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পাশে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিশাল খাসিয়াপুঞ্জি। এখানে রয়েছে ছন্দময় সতত প্রবহমান পাহাড়ি ঝরনা, পাহাড়ি শিলা বিছানো ও কংকরময় মাটিতে সবুজ অরণ্য, মনমাতানো পাহাড়ি নদী ভাউকীর স্ফটিক পানিধারা। পাশেই দৃষ্টিনন্দন ভারতের জাফলং জিরো পয়েন্ট অবস্থিত ঝুলন্ত ব্রিজ। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো যে, জাফলং পাহাড়ি এলাকা অতীতে সবুজ ঘন অরণ্যে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সবুজ বন বিলুপ্ত হতে চলেছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট অবস্থিত। সিলেট মহানগরীরর কাছাকাছি রাতারগুল বন এক সময় বিশাল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত থাকলেও বনবান্ধব পরিবেশের অভাবে বর্তমানে এর অস্তিত্ব মাত্র প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রাতারগুল মূলত ৩টি নদীর তীরবর্তী বৈচিত্র্যপূর্ণ জলাবন ও প্রাণীদের আবাসস্থল। এখানে রয়েছে হিজল ও কড়চ জাতীয় গাছের নিবিড় অরণ্য। এখানে বিচরণ করে বানর, সাপ, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী ও নানা প্রজাতির পাখি। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে বেত, নল-খাগড়া, মুর্তা ইত্যাদি। [চলমান]
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন