আবদুল আউয়াল ঠাকুর : বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভাষা শহীদদের স্মরণ ও দেশগড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতি শোক, অহঙ্কার আর গর্বের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করেছে। সঙ্গত বিবেচনা থেকেই একুশকে নিয়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনাও হয়েছে। একুশের চেতনা অবিভাজ্য। সেই ৫২ সালে ভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখের শাহাদতবরণের পর যেমনি এদেশের মানুষ মায়ের ভাষায় কথা বলার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল আজো একুশ পালনে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে রাজপথ, জনপদ। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না ব্যাপারটি যেন অনেকটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা দোষের নয়, যদি তা থেকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। দেশের সকল রাজনৈতিক দলসহ শ্রেণী পেশার মানুষ মহান একুশ পালন করলেও এবার যেকোন কারণেই হোক একধরনের ভিন্নতার অবাঞ্ছনীয় সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। ওসমানী মিলনায়তনে একুশের পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সমালোচনার বাণে করেছেন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধানকে। তিনি বিএনপির চেয়ারপরসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছেন তার কথা শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও অনুরূপভাবে বলেছেন, গণতন্ত্র অবরুদ্ধ করে রেখে ক্ষমতাসীনরা ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধের রক্তের সাথে বেঈমানী করছে। এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে একই মিনারে শ্রদ্ধারমালা অর্পণ করার পরেও মনের অবস্থা এক নয়। অন্যভাবে যদি বলা যায় তাহলে এটা বলাও বোধহয় অন্যায় নয় যে, একুশের যে কয়টি মৌলিক বিষয় তাহলো ভাষা সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র। এরমধ্যে মূল হচ্ছে গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র নিয়ে ক্ষমতাসীনরা টুঁ শব্দটিও করেনি। একটি রুদ্ধ পরিবেশে একুশ পালন করা না করার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য খুবই কম।
নিয়মানুযায়ী একুশকে নিয়ে প্রতিবছরই ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ আলোচনার আয়োজন করে আসছে। এবারেও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। ছোট্ট সীমিত পরিসরে ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের মিলনায়তনে এই আলোচনার আয়োজন করেছিলেন সংগঠনটি উদ্যোক্তারা। যারা আলোচনায় এসেছিলেন তাদের কেউ কেউ এবং শ্রোতাতের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছিল এতছোট্ট গরম একটি রুমের মধ্যে কেন ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠনের আয়োজন। ব্যাপারটি যারা জানেন তাদের কাছে কোন নতুনত্ব নেই। তবে পরিস্থিতি পরিষ্কার করতে বলতে হয় বড় জায়গায় করার মত সামর্থ সংগঠন নেই। তমদ্দুন মজলিশের আলোচনায় ভাষা সৈনিক ও রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল গফুরসহ আমরা ক’জন আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম। আলোচনায় কিছু মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করে ভাষা সৈনিক অধ্যাপক চেমন আরা। তিনি প্রশ্ন তোলেন এবারে যেসব মেয়ের ভাষার জন্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাদের ভূমিকা নিয়ে। সেই সূত্রধরেই কথা এগুচ্ছিল। বলা হয়েছে ভাষা সৈনিকদের নামের তালিকা প্রণয়নে আদালতের নির্দেশনার কথা। অধ্যাপক চেমন আরাই শুধু নন, এখনো ভাষার আন্দোলনের সেই রক্তঝরা দিনগুলো যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের দু’একজন জীবিত রয়েছেন। প্রকৃত বিবেচনায় ভাষার দিবসে নানা কথা হলেও প্রকৃত যে কাজ তা কতটা হচ্ছে সেপ্রশ্নও তোলে বক্তারা। দেশে প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই এবং ইতিহাসের স্বীকৃতি হচ্ছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সংগঠন তমদ্দুন মজলিশই ভাষার দাবিটি সামনে নিয়ে আসে। আন্দোলনের বিবেচনা বোধ বিশ্বাসে নানা পরিবর্তন থাকতেই পারে তাই বলে মূল বিষয়কে অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। এ আলোচনাতেই উঠে আসে ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশেরও অনেকদিন হয়ে গেছে তা সত্ত্বেও তমদ্দুন মজলিশ ভাষা আন্দোলনের কোন বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাবার কথা। এই না পাওয়ার হয়ত অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে প্রধান হয়ত এই যে তারা কারো লেজুড়বৃত্তি করেনি। তমদ্দুন মজলিশের স্বীকৃতি না দেয়ার বিষয়টি এক অর্থে ভাষা আন্দোলনের প্রতি অবজ্ঞাও বলা যেতে পারে। সে কারণেই আজকের প্রেক্ষাপটে যদি ভাষা আন্দোলনকে দেখা যায় তাহলে বলতে হবে কেবল ভাষার কথা বলে ভাষাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। অধ্যাপক চেমন আরাও কোন রাষ্ট্রীয় পদক পাননি। হয়তো আর বেশি দিন তিনি বেঁচে নাও থাকতে পারেন। জীবিত অবস্থায় তিনি এই আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন না। এটা বোধকরি আমরা যারা ভাষার প্রতি বিনম্র ভালোবাসা প্রদর্শন করছি তাদের প্রতিও চপেটাঘাত। এরকম আরো হয়তো অনেকেই রয়েছেন যাদের ভাষা আন্দালনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কপালে জোটেনি। কারণ তারা ভাষা আন্দোলনকে বেচে খাননি। উচ্চতর আদালতের রায়ের কথা না বললেও এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এই মহান আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর নামের তালিকা থাকা যেমনি দরকার, তেমনি দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি কর্মীর যথাযথ সম্মান পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। তাদের প্রতি যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন না করার অর্থ হচ্ছে ভাষার প্রতি অসম্মানপ্রদর্শন করা। কথাটা আর্কিমিডিসের সূত্রের মতো করে যদি বলতে তাহলে এমনটা দাঁড়ায় যে, আমরা ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের প্রতি সম্মানপ্রদর্শনে যতটা কার্পণ্য করছি প্রকৃৃতপক্ষে ভাষার প্রতি সম্মানপ্রদর্শনে ততোটাই পিছিয়ে পড়ছি। এটা মনে রাখতে হবে, এই ভাষার সম্মান ঐতিহ্য রক্ষার্থেই সেই সুদূর ঐতিহাসিককালের বৌদ্ধ, ভিক্ষুরা এ অঞ্চল ছেড়ে নেপালে রাজ দরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবার সেই ভাষার সম্মান রক্ষার্থেই ’৫২ সালে এদেশের তরুণ সমাজ অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। সে অর্থে ভাষা কেবলমাত্র মুখের বুলি হিসেবে নয় বরং আমাদের অস্তিত্বের প্রতীকরূপে প্রতিষ্ঠিত। সে কারণেই ভাষার লড়াই যেমনি একমাত্রিক নয়, তেমনি ভাষা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও একমুখী নয়।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলা ও ইংরেজির মিশেল বাংরেজি থেকে ছেলেমেয়েদের সরিয়ে আনতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলা ভাষাকে কোনোভাবেই বিকৃত করা যাবে না। ভাষার বিকৃতি রোধে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান অবশ্যই ভাষার প্রতি মমত্ববোধ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে। একে ইতিবাচক মনে করাই সঙ্গত ও যৌক্তিক। অবশ্যই আজকের দিনে ভাষার বিকৃতির প্রবণতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। তিনি ভাষার আলোচনা করতে গিয়ে স্বকীয়তার বিষয়টিও তুলেছেন। এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিকভাবে বিভাজিত রাষ্ট্রগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখা যাবে, প্রায় সবগুলো দেশের ভাষাই একে অপরের চেয়ে আলাদা। ভাষা বিজ্ঞানীরা ভাষার আলোচনা করতে গিয়ে এর স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। সেখানে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এর মূল উৎপত্তিস্থল। এগুলো মূলত যারা পড়াশোনা করছেন বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করছেন তাদের গবেষণার বিষয়। এই অঞ্চলের কথাই যদি বলা যায় তাহলে দেখা যাবে, সীমান্তের এপার-ওপারের ভাষা এক নয়। একটু একটু করে পাল্টাতে পাল্টাতে এক সময় অচেনা-অজানা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট রীতি রয়েছে। রয়েছে গতি-প্রকৃতিও। কেন এমন হয় তার বিশদ আলোচনার জায়গা এটি না হলেও বলা যায়, প্রতিটি দেশের মানুষের কৃষ্টি-মেধা-মননের ওপর ভিত্তি করেই ভাষা টিকে থাকে, অগ্রসর ও বিস্তৃত হয়। এখনও এমন অনেক খবর প্রকাশিত হয় যে, কোনো একটি আঞ্চলিক ভাষার শেষ ব্যক্তি মারা যাবার ফলে ঐ নির্দিষ্ট ভাষার মৃত্যু হয়েছে। এটা প্রমাণ করে ভাষার সাথে নদীর প্রবাহমানতার এবং পাখীর কুহতানের যে সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয় তা নিছক উপমা নয়। ভাষা সমৃদ্ধ নাহলে বাঁচে না। ভাষার বেঁচে থাকার সাথে রাষ্ট্রের বেঁচে থাকার আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষার কথাই বলা যাক। চর্যাপদকে আমরা আমাদের ভাষার আদি নিদর্শন বলে বিবেচনা করি। এখনকার সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চর্যাপদ পড়তে দিলে তা কতজনের পক্ষে পড়া এবং মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হবে এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এক সময়ে লেখ্য ও কথ্যভাষায় যে তৎসম শব্দের ব্যবহার করা হতো এখনকার সময়ে তার অর্থ অনুধাবনে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হবে। একসময়ে মনে করা হতো, বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। এখন প্রমাণিত যে সংস্কৃত এবং বাংলা আলাদা দুটি ভাষা। সে বিবেচনায় যে চারটি ভাষাকে পরস্পরের ভগ্নি মনে করা হয় তাহলো বাংলা সংস্কৃত, হিন্দি ও মৈথালী। আজকের প্রেক্ষাপটে যদি এসব ভাষার আলোচনা করা যায় তাহলে বোধকরি অনেকের পক্ষেই খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে এসব ভাষায় কারা কথা বলে। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা। বাংলা ভাষার কবির রচিত জাতীয় সংগীত প্রতিবেশি ভারতে গীত হয়। তারা ঐ সংগীতের বাইরে বাংলার আর কোন মর্যাদা দেয় না বরং সেখানে বাংলাকে গ্রাস করছে হিন্দি। আর হিন্দিকে গ্রাস করছে ইংরেজি। হিন্দি ও উর্দুর মধ্যে মিল থাকলেও বই দুটি পৃথক ভাষা। এখন বাংলা নিয়ে কিছু বলা যাক। যে কথা আমরা শুরুতে বলেছি বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের নিগ্রহ-নির্যাতনে এদেশের বৌদ্ধরা দেশছাড়া হবার সময়ে তারা ভাষাকেও সাথে নিয়েছিল। তাহলে যারা বৌদ্ধদের ঘরবাড়ী ছাড়া করেছিল তারা প্রকৃত বিবেচনাতে বাংলা ভাষাকেও মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এই চেষ্টার অন্য উদাহরণ হলো এই শ্রেণীই মনে করত বাংলা ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে নরকে যেতে হবে। সে বিবেচনাতেও বলা যায়, বাংলার টিকে থাকার সাথে এক বড় ধরনের লড়াই ছিল। বাংলা টিকে গেল ঐতিহাসিকভাবে এদেশে মুসলমানদের আগমনের কারণে। মুসলমানরা এদেশে আসার ফলে এই নির্যাতিত শ্রেণী অনুভব করেছিল তাদের মুক্তির দূতেরা এসে গেছেন। দলে দলে যারা সেদিন ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাই কিন্তু সাথে করে ভাষাকেও নিয়েছিলেন। তাহলে এটা সত্যি যে, ভাষার টিকে থাকার লড়াই আর জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই এ অঞ্চলে এক ও অভিন্ন ছিল। একথাও এখানে বলে রাখা দরকার, আমরা এখন যেবাংলা ভাষায় কথা বলছি তা এগিয়েছে সে সময়ের মানুষের চর্চা থেকেই। শব্দগুলোও এভাবেই এসেছে। ভারতবর্ষ ইংরেজরা দখল করে নিয়েছিল ছলে-বলে-কৌশলে। ভারতবর্ষে মুঘলরা শাসন করলেও বাংলা ভাষার চলার পথে কোন সমস্যা হয়নি। সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে ইংরেজ আমলে। সে সময়েই কতিপয় ইংরেজ বাংলাকে সংস্কৃতিজাত বলে প্রমাণের চেষ্টা করে। ফলে ভাষা সর্বপ্রথম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। আর এই সময়কে কেউ কেউ রেনেসাঁর সময় বলে উল্লেখ করতে চান। ঠিক যেমন বলা যায়, বাংলা ভাষার উৎকর্ষের যুগ হচ্ছে মধ্যযুগ। এটি হচ্ছে বাংলায় সেনবংশের পতনের পর মুসলিমযুগের সূত্রপাতের সময়। ভারতীয় হিন্দু প-িতেরা সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে এই সময়কে বলেন অন্ধকারযুগ। এর কোন ব্যাখ্যা কলিকাতাকেন্দ্রিক বাংলা প-িতদের না থাকলেও এটা বোঝা যায় কথা-বার্তায় যাই হোক ধর্মীয় আবরণ থেকে তাদের বেরিয়ে এসে সত্য স্বীকার করা সম্ভব নয়। তাহলে এটা প্রমাণিত যে, ভাষার একলা চলার কোন পথ নেই। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব অথবা অবহেলা ভাষার জন্য মারাত্মক বিবেচিত হয়। বলা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও নাকি সূর্যাস্ত যেত না। অর্থাৎ পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। যেভাবেই হোক এটাই সত্যি যে, অনেকদিন তারা শাসন করেছে। যে অঞ্চলে তারা গিয়েছে সেখানেই তারা স্থায়ী প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা করেছে। এখন মুসলমানরা মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে তথাকথিত জঙ্গি খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যেখানে ব্রিটিশরা শাসন করেছে সেখানেই তারা চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছে। ইংরেজি ভাষার প্রচলন করেছে। শাসন পরিবর্তন হলেও সবকিছুর পরিবর্তন হয়নি। তারা যে সাম্রাজ্য তৈরি করেছে সেখানে আধুনিক প্রযুক্তিসহ নানা বিদ্যার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একসময়ে যে দাসবৃত্তির বিরুদ্ধে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ হয়েছে এখন সেই দাসবৃত্তি করতে এসব অঞ্চলের মানুষেরা ভিড় করছে। এর সাথে রয়েছে প্রকৃত বিবেচনাতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। আধুনিক বিশ্বে চীনসহ অনেক দেশের উদাহরণ দেয়া যাবে যারা বিদেশি ভাষায় নয় বরং স্বদেশি ভাষাতেই উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে নিজ নিজ দেশে কাজে লাগাচ্ছে। সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে ইংরেজির চল আবার ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশশুলোতে ফরাসি ভাষার এখনো চল রয়েছে। আফ্রিকান দেশগুলোতে বিকল্প ভাষা হিসেবে ফরাসির ব্যবহার রয়েছে। এর ফলে সেসব দেশে নিজস্ব ভাষা মরে যায়নি বা এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আবার ঐসব দেশে বিদেশি ভাষার প্রতি সহানুভূতি থাকলেও মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্রও আলাদা কোনো মমত্ববোধ নেই। বিষয়টি নির্ভর করছে দেশপ্রেমের ওপর।
ভাষা থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার কথা আমরা প্রায়শই উচ্চারণ করছি। প্রায়শই আমরা গণতন্ত্রের জন্য আমাদের প্রাণ দানের কথাও বলে বেড়াচ্ছি। আসলে এসবের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি স্বাধীন সত্তা অর্জন। এটা করতে গেলে জনগণের হয়ে যারা সরকার পরিচালনা করেন তাদের এটা বুঝতে হবে, এর প্রতি গভীর আস্থা থাকতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে বিশ্বাস করতে হবে জনগণের চেতনাবোধকে লালন করতে হবে। এই প্রক্রিয়াতেই ভাষা টিকে থাকে। সভা-সমিতি বক্তৃতা, বিবৃৃতি, সাংস্কৃতিক, কর্মকা--শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকেই সাধারণ মানুষ কথা ও ভাষা শেখে। এটা অপ্রিয় হলেও সত্যি বর্তমান সময়ে এক বন্ধাত্বের যুগ চলছে। গণতন্ত্রের মূল চাহিদা ভোট এখন অনুপস্থিত। মিটিং-মিছিল করা যায় না। সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন এক বিশেষ মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গন এখন ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতির শিকার। আমাদের অনেক পত্র-পত্রিকায় এখন দেশের নয় বরং ভারতীয়দের লেখাকেই কদর করছে। দেশের অনেক কাগজে জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার পরিবর্তে ভারতীয়দের দ্বারা পূর্ণ করা হচ্ছে। নতুন বংশধরদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে বিদেশি সংস্কৃতির ধারকদের। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে গোটা দেশই এখন ভারতীয় হিন্দি ভাষার জোয়ারে ভাসছে। পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা এখন বাংলা তুলতে বসেছে। তারা এখন যা বলে তা ঠিক কোন ভাষা বলা কষ্টকর। বাংলাদেশেও এখন বাংলার সাথে মিশতে শুরু করেছে হিন্দি যার ফলে তৈরি হচ্ছে বান্দি ভাষার। প্রধানমন্ত্রী বাংরেজি ভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধে যে জনমত গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন তার চেতনাগত বিষয় যদি বিবেচনায় নেয়া যায় তাহলে অবশ্যই বর্তমান সময়ের প্রধান বিষয় হচ্ছে হিন্দির আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ইতিহাসের শিক্ষা অনুযায়ী ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমাদের জাতীয় স¦াধীনতা বা সাস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য হুমকি নয়। বাংরেজি নয়া বান্দি ভাষা রুখে দিতে না পারলে একুশের অনুষ্ঠান কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া অন্যকিছুই থাকবে না। অবশ্যই জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই ভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষাকরা অপরিহার্য।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন