শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

নৈতিক অবক্ষয় থেকে মুক্তির উপায় ধর্ম চর্চা

| প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আলতাফ হোসেন হৃদয় খান : বাংলাদেশে নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এসব বিষয়ে নানা আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মাঝে বর্তমানে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। কলেজ ইউনিভার্সিটি এমনকি হাইস্কুল পর্যায়ের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে এমন খবর আমরা প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকার পাতায় দেখতে পাচ্ছি। তাছাড়া ছেলেরা ব্যাপক মাত্রায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এগুলোর পেছনে কারণ কী? এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত পারিবারিক শিক্ষার কথা। এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মূল্যবোধের শিক্ষাটা আসতে হবে পরিবার থেকে। কোনটা সঠিক আর কোনটা সঠিক নয় এটা বিচার করার ক্ষমতা কিন্তু ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষা দিতে হবে এবং তার সূতিকাগার হচ্ছে পরিবার। কিন্তু বর্তমানে এ বিষয়টা খুব দুর্বলভাবে আসছে। অর্থাৎ পরিবার থেকে এ ধরনের ন্যূনতম শিক্ষা পাচ্ছে না ছেলেমেয়েরা। তাছাড়া অভিভাবকরাও বিষয়টিকে সেভাবে দেখছে না; অন্যভাবে বলা যায় অনেকের দেখার সুযোগও কম থাকছে। তারা ব্যস্ত থাকছে তাদের কর্মজীবনের জটিলতা নিয়ে। আর সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এ বিষয়টির যেন পরিবর্তন এসেছে।
সমাজে খারাপ জিনিসটা যদি হরহামেশা হয় যেমন ধরুন ড্রাগের ব্যবহার। বর্তমানে দেশে ড্রাগের ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় ইরানে প্রচুর ড্রাগ এডিকটেড ছিল। কিন্তু আমি যতটুকু জেনেছি যে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর; ইসলামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে ড্রাগ এডিকশন একদম কমে গেছে। বলা চলে সেখানে ড্রাগ এডিকশন নেই। কারণ হচ্ছে, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথমেই বলা হয়েছে যে পারিবারিক শিক্ষা; এই পারিবারিক শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টির প্রচÐ একটা ঘাটতি রয়ে গেছে আমাদের দেশে। আর একটা বিষয়- যারা সমাজে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করছে তাদের পেছনে কাদের হাত আছে তা কিন্তু জানা যাচ্ছে না। এসব বিষয় জানার জন্যে তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেই। অর্থাৎ এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। অবক্ষয় যাদের মধ্যে হচ্ছে তারা কোন পরিবার থেকে আসছে? এরা নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত নাকি উচ্চবিত্ত। তারা শিক্ষিত পরিবার থেকে আসছে নাকি অশিক্ষিত পরিবার থেকে আসছে এসব বিষয়ে কিন্তু কোনো স্টাডি নেই। অর্থাৎ তাদের সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু স্পষ্ট নয়। যে কারণে পারিবারিকভাবে তারা কোনো নৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। আর এক্ষেত্রে নৈতিকতা বোধ বা ভালো-মন্দের তফাৎটা তাদেরকে শেখানো হয়নি বলে তারা এ ধরনের কাজ করতে পারছে।
ইভটিজিংয়ের বিষয়টিও পুরোপুরি নৈতিকতার অভাব থেকে হচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধহীনতা যাদের মধ্যে রয়েছে তারাই এ ধরনের অতিশয় মন্দ কাজ করছে। আর এর জন্য পারিবারিক শিক্ষার ঘাটতিই দায়ী বলে আমি মনে করি। আমরা ছোটবেলায় লক্ষ করেছি যে, ছেলেমেয়েরা বাবা-মার কাছ থেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা পেত। তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকেই নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পেতে। তো সেই নীতি-নৈতিকতার শিক্ষাটা কি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে, তো কেন দুর্বল হলো আর কিভাবে এ বিষয়টিকে চাঙ্গা করা যায়? এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ভালো-মন্দ বোধ বা যাকে মূল্যবোধ বলে তা কিন্তু ছোট বেলায় অর্জন করতে হয়। বর্তমান যুগে সন্তানদের ওপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদের ওপর যে এক্সটার্নাল ফোর্স-যেমন রেডিও টেলিভিশন বা সাংস্কৃতিক নানা মাধ্যম। তাছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক নানা বিষয়। টেলিভিশনে বা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অপসংস্কৃতি। বর্তমান যুগে কমিউনিকেশনের যে বিষয়গুলো তার মধ্যেই বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছে বাচ্চারা বা যুব সমাজ। ফলে তারা পরিবারের সাথে সময় খুব কম দিচ্ছে। এমন একটা সময় ছিল যখন বাচ্চারা তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী বা চাচা-মামাদের কাছে যেত নানারকম গল্প শোনত, আদর্শ গঠনের নানা উপদেশ তাদের কাছ থেকে পেত কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় বাচ্চারা সেই ধরনের কোনো পরিবেশ পাচ্ছে না বা তারা সেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, ফলে পারিবারিক মমত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হারাতে বসেছে যার ফলে নৈতিক চরিত্রের স্খলন ঘটছে বর্তমান তরুণ প্রজন্মদের প্রতি।
এছাড়া পারিবারিক বন্ধনও একটি মুখ্য বিষয়। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে সন্তান-সন্ততির সাথে বাবা-মায়ের বন্ধন অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার কারণ হচ্ছে অনেক সময় বাস্তবতার কারণে বাবা-মা উভয়কেই কাজের মধ্যে থাকতে হয়। ফলে তারা সন্তানদের ঠিকভাবে সময় দিতে পারে না। আর এ কারণে বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যকার বন্ধনটা অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলবো, আমেরিকান বা ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতে সন্তান ও বাবা-মায়ের মধ্যেকার বন্ধনটা সবচেয়ে কম। যদিও বলা হয় তারা অনেক রিচ কান্ট্রি কিন্তু রিচ কান্ট্রি হলেও বেঁচে থাকার জন্য সেই সমাজে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই আর্ন করতে হয়। তানাহলে তাদের পক্ষে চলা সম্ভব নয়। তো এই যে সামাজিক পরিবর্তন এর ফলে এসোসিয়েশনটা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি দেখা যাচ্ছে। বাবা-মা সন্তানদের সময় দিতে পারছে না। অন্যদিকে বাচ্চাদের সময় দেয়ার জন্য তো তাদেরকে কাছে পেতে হবে। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদেরকে বাবা-মায়েরা কাছে পাচ্ছে না। তারা মোর ইন্টারেস্টেড ইন্টারনেট, টেলিভিশন চ্যানেল, মোবাইল ইত্যাদি। আর একসময় রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ে তবে তা বেশ পরে। ফলে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বা পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ে বাচ্চাদের আগ্রহটা বেড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে আমি মোরাল ডেভলপমেন্টকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। যুব সমাজের বা বাচ্চাদের পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্টের জন্য মোরাল ডেভলপমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। আর এটিও কিন্তু বিভিন্নভাবে করা যায়। খেলার মাধ্যমেও মোরাল ডেভলপমেন্ট হতে পারে। যেমন ধরুন খেলার মধ্যেও কিন্তু নীতি-নৈতিকতা ও ডিসিপ্লিন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেখবেন খেলার মধ্যে বাচ্চাদের তেমন ইন্টারেস্ট নেই। তাছাড়া সেই পরিবেশও নেই খেলার। গ্রামে দেখা যেত আগে মাঠ ছিল সেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারতো। এখন আর মাঠ নেই বা খোলা জায়গা নেই। এভাবে অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে যেগুলোর কারণে যুব সমাজের মধ্যে বা আমাদের সন্তানদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা দুর্বল হয়ে পড়ছে আর ঐ ফ্যাক্টরগুলোই এর জন্য দায়ী।
আমি এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তুলে ধরবো সেটি হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। বর্তমানে আমরা যে মোরালিটির কথা বলছি এর মূল উৎস কিন্তু ধর্ম। ধর্মের মধ্যেই জীবনাচারণের সব আদর্শিক বিষয়গুলো উল্লেখ আছে। আর সেই ধর্মীয় চর্চার মধ্যেই জীবনের উৎকর্ষ সাধন করা সম্ভব। ধর্ম চর্চার মাধ্যমেই ভুল এবং ঠিকের বিষয়টি জানা যায়। ধর্মীয় বিধিবিধানের মধ্যেই এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। আমাদের মধ্যে ধর্ম চর্চা অনেকটা লোপ পেয়েছে। এর ফলে ন্যায় বোধ সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যারা আল্টিমেট ফেয়ার বা ন্যায়বোধকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তাদের দ্বারা সমাজের উন্নতি হতে পারে না। মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে যে ন্যায়বোধের কথা বলা হয়েছে সেটিই কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি। অর্থাৎ আমি স্পষ্টভাবে বলবো-ধর্ম চর্চা যদি দুর্বল হয়ে যায় তাহলে সেই ন্যায়বোধও দুর্বল হয়ে পড়বে তখন সেটি সমাজের বা ব্যক্তিজীবনে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তবে হ্যাঁ কারো কারো ক্ষেত্রে ধর্ম ছাড়াও হয়তো ন্যায়বোধ স্ট্রং হতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ধর্মই সবচেয়ে বড় বিষয়।
অনেকে বলবেন- সামাজিক অবক্ষয় এবং নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে মুক্তির উপায় কি? আসলে অনেক জিনিসের অনেক সময় সমাধান দেয়া যায় না। এসব জটিল বিষয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেতে পারে। আমি বলবো-সামাজিক অবক্ষয় বা নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্য সবাইকে ভূমিকা পালন করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের, সমাজের ও পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথমে পরিবার থেকে বাচ্চাদের ধর্ম চর্চা, ধর্মীয় বিধি-বিধান, ও নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। এরপর স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যমে এসব বিষয়কে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এছাড়া সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে সৎকাজের আর মন্দ কাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজে যদি অন্যায় কাজ করে কেউ পার পেয়ে যায় তাহলে অন্যরাও তাতে উদ্বুদ্ধ হয় বা উৎসাহিত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা কি দেখছি! এখানে দেখা যাচ্ছে অন্যায় করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে; বহাল তবিয়তে আছে। অন্যায়কারীরা সমাজের অনেক বড় স্তরে বসে আছে। কাজেই সেইসব অন্যায়কারী সমাজের বড় বড় ব্যক্তিরা যখন নীতির কথা বলে যিনি নীতিবিরোধী কাজ করেন তখন তার কথা তো আর কার্যকর হতে পারে না। আমাদের সমাজে অন্যায়কারীরা তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কৃত হচ্ছে আর যারা ন্যায়ের পথে চলছে তারা সমস্যায় পড়ছে। কাজেই পলিসিগতভাবে সমাজ বলি, রাষ্ট্র বলি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বলি সর্বত্র একটা বিষয়ে স্পষ্টভাবে দেখতে হবে যে-অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে যারা ভালো কাজ করবে তাদের সেই ভালো কাজের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। ছোটদের সামনে এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। তানাহলে তো শিশুরা ভালো মন্দের ব্যবধানটা বুঝতে পারবে না। আর মোরাল ডেভলপমেন্টের মূল কথা কিন্তু ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে শেখা এবং ভালো কাজ করতে শেখা। যখন সমাজের মানুষ দেখবে ভালো কাজ করলে পুরস্কৃত হওয়া যায় তখন তারা ভালো কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে এবং পারিবারিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধকে আরো দৃঢ় করে সামাজিক অবকাঠামোকে যথোপযুক্তভাবে কল্যাণমূলক কাজ করে নৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে তরুণ প্রজন্মদের।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন