দিলীপ কুমার আগরওয়ালা : আমাদের দেশে শিশুদের বৃহত্তর অংশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে আসছে। গরীব, দুঃস্থ পরিবারের শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। অল্প বয়স থেকেই অভাব-অনটনের তাগিদে বাধ্য হয়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। এসব শিশুকে সুকৌশলে স্কুলমুখী করা তো দূরের কথা সামাজিক বৈষম্যের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিশুরা তাদের জীবনের তাগিদে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
আমাদের দেশের শহর-শহরতলীতে বসবাসকারী বস্তিবাসীসহ রেলস্টেশন, টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, হাটবাজারে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পরিবারের অধিকাংশ শিশু অভিভাবকের সাথে কাজে সহযোগিতা ছাড়াও রিকশা গ্যারেজ, গাড়ী গ্যারেজ, বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে এমন কি বালু, পাথর কোয়ারী ছাড়াও হোটেল, রেস্টুরেন্টে গøাস বয় হিসাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এসব ছাড়াও কৃষি ক্ষেত্রেও শিশুরা অবাধে শ্রম বিক্রি করলেও অল্প মজুরিতে এসব শিশুরা রাত-দিন খেটে যাচ্ছে। এদের ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই। এসব শিশু সামাজিকভাবে অবহেলিত। শিশু হিসাবে যে অধিকার পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত।
শিশুশ্রম বন্ধে আইন থাকলেও দেশে প্রায় ৫০ লাখ শিশু নিষিদ্ধ শ্রমে জড়িয়ে আছে। তারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের দুরন্ত শৈশব। অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে ওদের সোনালি ভবিষ্যৎ। পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে মোট ৪৫ ধরনের কাজে। এর মধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজেই শিশুরা অংশ নিচ্ছে।
সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের এক হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমিকের ১২ শতাংশই শিশু। কম মজুরি, মাত্রাতিরিক্ত খাটুনি ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে দেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতি। শিশুরা এসব কাজে নিয়োজিত থেকে অনেক সময়ই শুধু জীবনধারণের খোরাকি পেয়ে থাকে যা দয়াদাক্ষিণ্য বলেও বিবেচিত হয়। গত পাঁচ বছরে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ১০ লাখেরও বেশি। মোট শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
বর্তমান সরকার দেশের শিশুদের শ্রম বন্ধে শিশুশ্রম নিষিদ্ধের লক্ষ্যে আইনি পদক্ষেপ নিলেও শিশুশ্রম বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশুরা অবাধে শ্রম বিক্রি করে চলেছে। শিশুশ্রম বন্ধে প্রকৃত সমাধান বের করতে হবে। শিশুদের পরিবারের কর্মক্ষম অভিভাবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, শিশুদের ফ্রি চিকিৎসা, লেখাপড়ার সমস্ত খরচ বহন অর্থাৎ প্রতিটি পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছাড়াও শিশুদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
শিশু কল্যাণে সরকারি বরাদ্দ ছাড়াও বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা পথশিশুসহ কর্মরত শিশুদের কল্যাণে প্রাথমিক পর্যায় কারিগরি ও কৃষি শিক্ষা প্রদান করতে পারলে এসব শিশুরা অল্প মজুরিতে শ্রম বিক্রি না করে স্বাবলম্বী হতে পারবে। তাই শিশুদের হাতেখড়ি হিসাবে কারিগরি ও কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে।
সরকারি উদ্যোগের সাথে শহরের বস্তিসহ গ্রামীণ পর্যায় কারিগরি প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষা প্রদানে সকল প্রকার অনিয়ম দূরীকরণে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের কোন প্রকার অপচয় কঠোর হতে দমন করতে হবে। এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যাপারে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সমাজে অবহেলিত বঞ্চিত শিশুদের প্রয়োজনে সম্মান অর্থ দিয়ে ও সমষ্টিগতভাবে কারিগরি শিক্ষার সাথে অসা¤প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। তবেই হিংসা, বিদ্বেষকে বিতাড়িত করে অসা¤প্রদায়িক মানবসম্পদ হিসাবে গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম কমছে। এটা স্বস্তির খবর। বলা হচ্ছে, সরকারী, বেসরকারী প্রচেষ্টায় ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিদ্যালয়ে গমনের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত এই সাফল্য। কিন্তু অভাব, দারিদ্র্য দূর না হলে চরম দারিদ্র্যের শিকার শিশুদের শ্রম বিক্রি বন্ধ হবে না। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। গৃহকর্মে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়ে আসছে। অন্যান্য পেশায়ও তারা নিগৃহীত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী ৫৭ শতাংশ শিশুশ্রম দিচ্ছে কেবল খাদ্যের বিনিময়ে। ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেয়া হলেও এর পরিমাণ শিশু আইনের তুলনায় নগণ্য।
বলা হচ্ছে, দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমছে। দশ বছর আগে দেশে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ লাখ ১০ হাজার। বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৪ লাখ ৮০ হাজারে। এমনিতে শিশুরা অল্প বয়সে শ্রমে নিযুক্ত হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আবার এর কারণে শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়। তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতেই থাকে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে এসব শিশুকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সবাইকে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে শিশুশ্রম বন্ধে শক্তিশালী কমিশন গঠন করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা।
লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি
মন্তব্য করুন