মেহেদী হাসান পলাশ : ২০১৬ সালের শেষ দিনে জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন। পরদিন ১ জানুয়ারি ২০১৭ ভোরের সূর্য ফোটার সাথে সাথে জাতীয় সংবাদপত্র হাতে নিয়ে যারা নতুন বছর শুরু করেছিলেন, তাদের জন্য বছরের সূচনাটি মোটেও শুভ হয়নি। কেন না, প্রায় সকল সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনের রক্ত মাখা লাশের ভয়াবহ ছবি। আগের দিন বিকাল চারটায় নিজ বাড়িতে গুলিতে আহত সংসদ সদস্য সন্ধ্যা ৭টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সে কারণে ২০১৭ সাল শুরু হয়েছিল একজন সংসদ সদস্যের লাশের খবর দিয়ে।
খবরে প্রকাশ, ঘটনার দিন মনজুরুল ইসলাম লিটন এমপি বাড়ির বৈঠকখানায় বসে ছিলেন। সন্ধ্যার কিছু আগে দুটি মোটরসাইকেলে করে অজ্ঞাতনামা ৫ যুবক তার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙার বাড়িতে যায়। এরাই ছিল এমপি মনজুরুলের খুনি। তাদের মধ্যে ৩ জন মোটরসাইকেলের আশপাশে থাকে, বাকি ২ জন তার বৈঠকখানায় যায়। খুনিরা এমপি লিটনের সাথে ব্যক্তিগত আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করলে লিটন সেখানে উপস্থিত তার স্ত্রী ও শ্যালককে বাড়ির ভিতরে পাঠিয়ে দেন। এ সময় পরপর ছয়টি গুলির আওয়াজ শোনা যায়। গুলিগুলো তার ডানহাতে ও বুকের ডানপাশে বিদ্ধ হয়। এরপর খুনিরা দ্রুত মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে এমপি লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পৌনে ৭টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। লিটন হত্যাকান্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তার সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে এসে অবরোধ সৃষ্টি করে, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
একজন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের নিজ বাড়িতে খুন হওয়ার ঘটনায় সমগ্র জাতি যখন হতবাক, বিহ্বল, ক্ষুব্ধ; লিটন হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ঠিক তখনই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এ হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন সব দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি একের পর এক আসতে থাকে, যাতে হত্যা তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশবাসীর মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।
লিটনের লাশ দেখতে গিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের বলেন, লিটন দীর্ঘদিন যাবৎ জামায়াত-শিবিরের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। এই জামায়াত-শিবিরই তাকে হত্যা করল। আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ বি এম মোজাম্মেল হক এমপি একই সুরে বলেন, জামায়াত-শিবির চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করতেই লিটনকে হত্যা করেছে। এই চক্রকে দেশ থেকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। শুধু তাই নয়, গত ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম বছরের প্রথম সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার। একই দিন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জামায়াত এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তিতে উৎসাহিত হয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও সুর মেলাতে থাকেন। গাইবান্ধা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসানুল করিম চাঁদ এ হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে বলেন, জামায়াত-শিবিরের লোক পুলিশ হত্যা মামলায় জামিনে এসে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়িয়ে আবারও এমপি লিটনকে হত্যা করেছে। পুলিশ ব্যর্থ হলে আমরা আওয়ামী লীগের লোকজন এমপির খুনি জামায়াত-শিবিরদের চিহ্নিত করব। শুধু সরকারি দলের কেন্দ্রীয় স্থানীয় নেতারাই নয়, এমপি লিটন হত্যাকান্ডের পর দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি এসেছে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকেও। পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক বলেন, এলাকার সাধারণ লোক ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলেছেন, খুনের সাথে জামায়াত-শিবির জড়িত থাকতে পারে। সংসদ সদস্য লিটন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। গত ২ জানুয়ারি পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, এমপি লিটন হত্যাকান্ডের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করেই মামলা করেছে পরিবার।
এমনকি এ হত্যাকান্ড নিয়ে আগাম মন্তব্য করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ জানুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গাইবান্ধা ১ আসনের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন এলাকায় জামায়াত-বিরোধী একটি শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই তাকে জীবন দিতে হয়েছে। আগেও লিটনের উপরে কয়েকবার হামলা হয়েছিল। লিটন ওখানে জামায়াতবিরোধী শক্ত অবস্থান নিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সবসময় সাহায্য করত। যে কারণে তাকে জীবনটা দিতে হলো। জানি না, ওদের আর কি পরিকল্পনা আছে। যখন তারা নির্বাচন করলো না, আন্দোলন করে সরকার উৎখাতে ব্যর্থ হলো এখন গুপ্তহত্যা- এটাই বিএনপি-জামায়াতের চরিত্র। এটা নতুন নয়। খুন করাই তাদের চরিত্র। তারাইতো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি দিয়েছিল।
খোদ সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে লিটন হত্যাকান্ড নিয়ে এহেন মন্তব্য আসার পর এ হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশবাসীর মনে গভীর সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে লিটনের স্ত্রীর দায়ের করা মামলায়ও সরকারি বক্তব্যের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। যদিও লিটনের বোনেরা এই হত্যাকান্ডের পেছনে একমাত্র জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে রাজনৈতিক ফায়দা না লুটে যে কোন সম্ভাবনাকেই বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি বারংবার আহ্বান জানান। কিন্তু শুরুতে পুলিশ সরকার ও নিজেদের শীর্ষ পর্যায়ের বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে একের পর এক জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে লিটন হত্যা মামলায় পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে ১৭ জনকে আটক করে যাদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ।
তবে এরই মধ্যে অন্য কিছু সম্ভাবনাকে ও বিবেচনায় রেখে তদন্ত কাজ চালিয়ে গিয়েছিল স্থানীয় পুলিশ। এরই এক পর্যায়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি অকস্মাৎ লিটন হত্যাকান্ডে সকল জট খুলে যায়। বেরিয়ে আসে আসল খুনি। পুলিশের ভাষ্যে, এমপি লিটন মারা যাওয়ার ২৮/২৯ দিন আগে ওই এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। ছিনতাইয়ের সময় সন্ত্রাসীদের অসতর্কতায় তাদের ব্যবহৃত পিস্তলের ম্যাগাজিন ঘটনাস্থলে পড়ে যায়। ওই ম্যাগাজিনে যে গুলি পাওয়া যায় তার সাথে এমপি লিটনের শরীর থেকে প্রাপ্ত গুলির মিলের সূত্র ধরে পুলিশ ওই ছিনতাইকারীদের সন্ধান করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই ৩ ছিনতাইকারী মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নানের পরিচয় শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তারা এ হত্যাকান্ডের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এ হত্যাকান্ডের সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করে। তাদের স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে পুলিশ একই দিন বিকেলে বগুড়ার বাসা থেকে গাইবান্ধা-১ আসনের সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টির নেতা লে. ক. (অব.) ডাক্তার আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করে। একই দিন ঢাকা থেকে আনোয়ারুল ইসলাম রানা নামের আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পরদিন ডাক্তার আব্দুল কাদের খানকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এর পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এমপি কাদেরের দেয়া তথ্য অনুসারে, তার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটি (খানবাড়ি) গ্রামের বাড়ির আঙিনার উত্তর পাশের দেয়াল ঘেঁষে মাটির নিচ থেকে ছয়টি গুলিসহ একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করে পুলিশ।
জবানবন্দিতে ডা. আব্দুল কাদের খান স্বীকার করেন, মূলত রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বতা থেকে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটনকে খুন করান তিনি। হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত শাহীন আব্দুল কাদের খানের ভাতিজা, হান্নান তার গাড়ি চালক। পুরো এক বছর ধরে এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা করেন তিনি। অর্থায়নও তিনিই করেন। হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িতদের বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে তার ছাপড়হাটির গ্রামের বাড়িতে হত্যাকারীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন। হত্যাকারীরা দরিদ্র। কাদের খান তাদের লোভ দেখান এমপি লিটনকে সরিয়ে দিতে পারলে উপনির্বাচনে এমপি হয়ে তিনি তাদের নানাভাবে আর্থিক সাহায্য করবেন, পেট্রল পাম্প দিয়ে দেবেন। এ ধরনের আর্থিক ও বৈষয়িক প্রলোভনে পড়ে খুনিরা আব্দুল কাদের খানের কথায় বিশ্বাস করে লিটন হত্যাকান্ডে অংশ নেন।
পুলিশের ভাষ্যে, ডা. কাদের খানের যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়া গেছে তাতে জানা যায়, তার ধারণা ছিল এমপি লিটনকে সরিয়ে দিতে পারলে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তিনি আবার এমপি হতে পারবেন। কেননা তিনি ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার বাড়ি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ছাপড়হাটি গ্রামে হলেও পরিবারসহ তিনি বগুড়া জেলা শহরের রহমাননগরে থাকেন। বাসভবনে তার নিজের গরীব শাহ ক্লিনিক রয়েছে। যেটি তিনি এবং তার স্ত্রী পরিচালনা করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন কাদের খান। কিন্তু সেখান থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হিসেবে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন মনজুরুল ইসলাম লিটন। এ নির্বাচনের পর থেকেই সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনকে সরিয়ে দিতে নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন কাদের খান। এরই অংশ হিসেবে লিটনের নিজ দল আওয়ামী লীগের ভিতরকার রাজনৈতিক শত্রু ও তার প্রতি অসন্তুষ্টদের জড়ো করেন কাদের খান। এদেরই একজন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। বামনডাঙার মনমথ গ্রামের সুশীল সরকারের ছেলে চন্দন সরকার। কাদের খানের জব্দ করা মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তার সাথে চন্দন সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা জানতে পারে পুলিশ। মূলত, খুনের দিন এমপি লিটনের বাড়িতে তার অবস্থার ও অনুক‚ল পরিবেশের খবর মোবাইলে খুনিদের জ্ঞাত করে সে। তার তথ্য মতে, কিলিং মিশন সম্পন্ন করে খুনিরা। স্থানীয়দের ধারণা, আত্মগোপন করতে চন্দন সরকার এরই মধ্যে ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে।
শুধু তাই নয়, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কাদের খানের আরও এক অপকীর্তির কথা বেরিয়ে এসেছে। মনজুরুল ইসলাম লিটনকে খুন করা ছাড়াও সাবেক এমপি ডা. আব্দুল কাদের খান গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সদর ও সাদুল্যাপুর উপজেলায় বিভিন্ন মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন নব্য জেএমবির নাম দিয়ে। পুলিশ এখন এ সকল মন্দিরে আগুন ও প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগ তদন্ত করছে। পুলিশের দাবি, গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কাদের খানের নির্দেশ ও পরিকল্পনায় বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয়। ৯ অক্টোবর সদর উপজেলার লক্ষীপুরের কামারপাড়া কালীমন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এ অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটি ইউনিয়নের মন্ডলের হাট থেকে ফয়সাল হোসেন ফাগুন, নজরুল ইসলাম খান, আশিকুল ইসলাম এবং শহীদ মিয়া নামে কথিত চার নব্য জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ফয়সাল হোসেন কাদের খানের ভাতিজা আর নজরুল ইসলাম খান তার বাড়ি দেখাশুনা করতেন। সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, মন্দিরে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার চারজন কালীমন্দিরে আগুন দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
পুলিশ লিটন হত্যা মামলার তদন্তে শুধু তার খুনিকেই শনাক্ত করেনি বরং সেই সাথে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা উত্থানের এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের নীলনকশা উদঘাটন করেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সারা বাংলাদেশে নব্য জেএমবির নামে যেসব সাম্প্রদায়িক তৎপরতা পরিচালিত হচ্ছে তার পেছনে সত্যিই কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠী রয়েছে নাকি মৌলবাদী গোষ্ঠীর নামে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে অন্য কোনো মহল গভীর ষড়যন্ত্র লিপ্ত রয়েছে। অন্যদিকে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে একের পর এক রাজনৈতিক ও মামলায় প্রভাব বিস্তারকারী বক্তব্য দেয়া হলেও স্থানীয় পুলিশ তাতে প্রভাবিত না হয়ে যেভাবে আসল খুনিদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। একটি অত্যন্ত জটিল মামলার তদন্তে পুলিশ যেভাবে দূরবর্তী সূত্রের মাধ্যমে এগিয়ে মূল খুনিদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তা সার্লক হোমসের অনেক গোয়েন্দা কাহিনীকে হার মানাতে পারে। পুলিশের এই দক্ষতা প্রশংসা ও অভিনন্দনযোগ্য। এ ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, পুলিশ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারলে যে কোন মামলায় রহস্য উদঘাটনে সক্ষম।
বাংলাদেশে বিগত এক দশকের রাজনৈতিক গতিধারা হচ্ছে, যে কোন বড় ধরনের অপরাধ বা হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার সাথে সাথে কখনো সরকার ও কখনো পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিএনপি-জামায়াতের উপর দোষ চাপিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য করা হয়। এতে হয়তো সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দা তোলা সহজ হয় কিন্তু তা মামলার সঠিক তদন্তে ও বিচারকার্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক অবস্থানমূলক বক্তব্যের কারণে পুলিশের পক্ষেও প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে কারণে এসব মামলার তদন্তে অগ্রগতি ও আসল খুনিদের শনাক্ত করা বেশিরভাগ সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ ধরনের ভ‚রি ভ‚রি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমপি লিটন হত্যা মামলা তার উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। এ মামলা পুলিশের ভাবমর্যাদা উন্নত করেছে। মানুষকে পুলিশ সম্পর্কে আশাবাদী হতে সহায়তা করেছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে, পুলিশকে রাজনৈতিক, দলবাজ, দুর্নীতিবাজ করার নানা চেষ্টা সত্তে¡ও এখনো তাদের মধ্যে সততা ও দক্ষতার অভাব নেই। মন্দ পুলিশের পাশাপাশি ভাল পুলিশ সদস্যের সংখ্যাও কম নয়। এই ভাল পুলিশ সদস্যরাই বাংলাদেশর জনগণের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমর্যাদা গড়তে সহায়তা করবে। পুলিশকে একটি উন্নত সেবাপ্রদানকারী সংস্থা হিসাবে দেশবাসীর মধ্যে তুলে ধরবে। আর সেটা করতে হলে দেশের মধ্যে অন্যান্য যেসকল চাঞ্চল্যকর মামলা বিচারাধীন রয়েছে সেগুলোও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সঠিক পথে তদন্ত কাজ পরিচালনা করে অপরাধীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের মানুষ চায় বাংলাদেশ পুলিশ এ কাজে শতভাগ সফল হোক।
email-palash74@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন