মোবায়েদুর রহমান : আমেরিকার স্কুল লেভেলের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেছি। এবার অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে স্কুল লেভেলের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা নিতে সক্ষম হয়েছি। আমার ভাতিজা-ভাতিজী এবং ভাগ্নে-ভাগ্নিরা এখানেই লেখাপড়া শিখছে। এখানে সাবজেক্ট সীমিত, কিন্তু ইনটেনসিভ। সাবজেক্ট কম হলেও তার গভীরে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া এখানকার শিক্ষকরা দেখেন শিক্ষার্থীর এ্যাপটিচুড। উচ্চশিক্ষা নেয়ার বেলায় কোন বিষয় বা ব্রাঞ্চে গেলে শিক্ষার্থীরা ভালো করবে সেটাও তারা খেয়াল রাখেন এবং ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকদের সেভাবে পরামর্শ দেন। অবশ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন গার্জিয়ানরা।
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটি আলাদা। এখানে ইংরেজি এবং বাংলা দুই মাধ্যমেই লেখাপড়া চলছে। তাই সারা বছরই পরীক্ষা লেগে থাকে। কোনোটা জুন-জুলাইয়ে, আবার কোনোটা নভেম্বর-ডিসেম্বরে। আর শিশু-কিশোর বা ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষা মানে তার একার পরীক্ষা নয়, তার সাথে সাথে মনে হয় ওই ছাত্রছাত্রীর চৌদ্দগোষ্ঠী পরীক্ষা দিচ্ছে। এই চৌদ্দগোষ্ঠী বলতে প্রধানত দেখা যায় ছাত্রছাত্রীর পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানী, বড় ভাইবোন সকলের পরীক্ষা। আপনি আশপাশের প্রতিবেশীদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, যাদের স্কুল পড়–য়া ছেলেমেয়ে আছে তারা সকলেই অস্বাভাবিক ব্যস্ত। যারা স্কুল লেভেলে পড়ে তাদেরও ১৪/১৫টি সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে হয়। কচি বয়সেই তারা পড়ছে কৃষিবিদ্যা। বীজ বপন থেকে চারাগাছ, সার, মাছের চাষ ইত্যাদি সব বিষয়। আপনি গভীরভাবে স্টাডি করুন, বাংলাদেশে স্কুল বা কলেজ লেভেলে ছাত্রছাত্রীরা যা পড়ে বাস্তব জীবনে তার কতটুকু কাজে লাগে? বাস্তব জীবনের সাথে পঠিত বিষয়ের সম্পর্ক কমই রয়েছে। শারীরিক শিক্ষা রয়েছে পাঠ্যবইয়ে। কিন্তু স্কুল-কলেজে কি শরীর চর্চা হচ্ছে?
ছোট ছোট শিশু বা বাচ্চারা যখন স্কুলে যায় তখন বইপুস্তক খাতাপত্রে ঠাসা একটি ঢাউস সাইজের ব্যাগ তাদের গলা থেকে পেঁচিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সেই ব্যাগের ভারে শিশু ছাত্রছাত্রীরা বাঁকা হয়ে হাঁটে। স্কুলের উঁচু ক্লাসে ছাত্রদের বিজনেস স্টাডিজ, এ্যানাটোমি এসব বিষয় পড়ানো হয়। তারা বিষয়টি কি বুঝলো, সেটার ওপর জোর দেয়া হয় না। পরদিন বা তার পরদিন ক্লাসে ওই বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করা হয় অথবা টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় পঠিত বিষয়ে উত্তর লিখতে হয়। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, প্রতিদিন এক গাদা করে হোম টাস্ক দেয়া হয়। অথচ বিষয়গুলো ছাত্রদের ভালো করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তারা সময় ব্যয় করেন না। ফলে পড়ালেখার সিস্টেমটাই হয়ে পড়েছে মুখস্থকেন্দ্রিক। মুখস্থ করতে গিয়ে ওই ছাত্র কী মুখস্থ করছে, সেই বিষয়টিই জানতে পারে না। তবুও পাস করার জন্য বা ভালো মার্কস পাওয়ার জন্য তারা অবিরাম মুখস্থ করে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে মুখস্থ করতে করতে তারা যেমন বিরক্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে মুখস্থ ভীতি।
যখন ওই ছাত্রের শেখা দরকার অঙ্ক, যখন তার ভিত্তি গড়া দরকার বাংলা ও ইংরেজির, তখন তার মাথায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অর্থনীতি, ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির বোঝা। এসব কঠিন বিষয় সে শিখে উঠতে পারছে না। কিন্তু তাকে তো হোম টাস্ক করতে হবে। সুতরাং আশ্রয় নিতে হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যার। মুখস্থ বিদ্যাতেও যখন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না তখন ঘরে রাখতে হচ্ছে প্রাইভেট টিউটর বা গৃহশিক্ষক। ক্লাস নাইন টেন বা ‘এ’ লেভেল বা ‘ও’ লেভেলে চলে ত্রিমুখী টিচিং। ঘরে প্রাইভেট টিউটর, বাইরে কোচিং ক্লাস, তারও বাইরে স্কুল। ওইসব স্কুল বা কলেজের টিচাররাই ছাত্রছাত্রীর ঘরে এসে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, আবার তারাই খুলে বসেছেন কোচিং ক্লাস। এভাবে স্রোতের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে অভিভাবকদের টাকা। কিন্তু কী করবেন তারা? না করে উপায় কী?
\ দুই \
এখন সারা বাংলাদেশের অভিভাবকদের একটিই দুশ্চিন্তা। কীভাবে তারা তাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করবেন? স্কুল পার হলে কীভাবে ভালো কলেজে? কলেজ পার হলে কীভাবে ভালো ইউনিভার্সিটিতে? এসব করার জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে মায়েদের ওপর। আর সেই মা যদি চাকরিজীবী হন, তাহলে সেই তার করুণ অবস্থাটি চিন্তা করুন। মুখস্থ বিদ্যা আর কোচিংয়ের জন্য সন্তানের পেছনে তাকে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে চাকরি। কোনদিকে যাবেন তিনি? ওইদিকে বেচারা ছাত্র বা ছাত্রীরও ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা। ভোর ৬টা থেকে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি। স্কুল শেষে প্রাইভেট পড়া অথবা কোচিং ক্লাস। মা-ছেলে ঘরে ফিরছেন সন্ধ্যার পর। এসব করে কি আর জীবন বলে কিছু থাকে? জীবন থেকে রূপ, রস, গন্ধ, আনন্দ, সব হারিয়ে যায়। এই করে ওই শিশু-কিশোর বা তার পিতা-মাতা সমাজ থেকে কী পাচ্ছে? না পাচ্ছে সঠিক শিক্ষা, না পাচ্ছে সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, না পাচ্ছে সুস্থ পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ।
এই মুখস্থ বিদ্যা, প্রাইভেট পড়া এবং কোচিং ক্লাস যে তাদের প্রকৃত শিক্ষা এবং জ্ঞান দিতে পারছে না তার বড় প্রমাণ হলো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের পুওর পারফরম্যান্স। জিপিএ-৫ পাওয়া ৫০ জন ছাত্র ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজি অনার্সে ভর্তি পরীক্ষা দিল। পাস করল মাত্র ৫ জন। এই কি তাদের শিক্ষার স্ট্যান্ডার্ড? এই কি তাদের জিপিএ-৫ এর মান? তাহলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা-পয়সা খরচ করে ইংলিশ মিডিয়ামে বা প্রাইভেট স্কুলে পড়িয়ে, প্রাইভেট টিউটর রেখে, কোচিং ক্লাসে পড়িয়ে কি লাভ হলো? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে তাদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্কুলে পড়াতে গার্জিয়ানরা খরচ করেছেন হাজার হাজার টাকা। এবার প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াতে গিয়ে খরচ করছেন লাখ লাখ টাকা।
বাংলাদেশের ৫৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ ছাত্র পড়ে। প্রতিটি ছাত্রের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়। আপনার আমার চারপাশেই এমন সব অভিভাবক আছেন যাদের মাসিক আয় ৩০/৪০ বা বড়জোর ৫০ হাজার টাকা। তারা কোথা থেকে জোগাড় করছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার হাতির খরচ? কে তাদের গৌরী সেন? এর উত্তর খুব সোজা। সেই উত্তর সকলেরই জানা। জেনেশুনেও কেউ কিছু বলছেন না। আর বলবেন কেমন করে? কারণ সুযোগ পেলে তিনিও তো ওই গৌরী সেনের দ্বারস্থ হবেন। এভাবেই সমাজটা আজ গেছে রসাতলে। দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরকে আচ্ছন্ন করেছে। যাদের দুর্নীতি করার সুযোগ নেই তারা অর্থাৎ সেই ছাত্রছাত্রীর পিতামাতাদের উভয়কেই চাকরি করতে হয়। শুধু চাকরি করতে হয় না, এক চাকরিতে হয় না বলে প্রায় ক্ষেত্রেই দুটি চাকরি করতে হয়।
\ তিন \
সম্প্রতি আমেরিকার একটি বড় কোম্পানি থেকে এক বাংলাদেশি মহিলা বাংলাদেশে এসেছিলেন কিছু ছাত্রের ইন্টারভিউ নিতে। উদ্দেশ্য, এদেরকে চাকরি দিয়ে আমেরিকা পাঠাবেন। ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে তিনি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও বিদেশিদের তুলনায় কিছুই জানে না। বিশেষ করে সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় তারা খুব দুর্বল। তিনি বলছেন, শেখানো বিষয়ের বাইরে একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ভাবতে পারে না, তাই চটপট উত্তর দিতে পারে না। অথচ বাইরের কোম্পানিগুলোতে বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডে চাকরির প্রথম শর্তই হলো সৃজনশীল চিন্তা এবং সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা। তিনি বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাই বা বললাম। কীভাবে তাদের সার্টিফিকেট দেয়া হয়, আমি জানি না। তার মানে এই নয় যে, কেউ কিছু জানে না। যাদের ইন্টারভিউ তিনি নিয়েছেন তাদের সকলেই যে খুব খারাপ করেছে তা নয়, কিন্তু সিংহভাগই খারাপ করেছে। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করার মতো প্রার্থী তো আজকাল পাই না। তাহলে কোথায় যাচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা?
সেই তুলনায় আমেরিকা তো দূরের কথা, অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা কত সোজা। অথচ কত উন্নত এবং কত মানসম্মত। বাংলাদেশে প্লে গ্রæপে একটি শিশুকে ভর্তি করাতে হলে খরচ পড়ে স্কুলভেদে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মাসিক বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। শুনেছি, ঢাকার আমেরিকান স্কুলে নাকি ৫০ হাজার টাকা। এত বিপুল অঙ্কের ভর্তি ফি এবং মাসিক বেতন, অথচ বাচ্চাদের স্কুলে রাখা হয় মাত্র ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। এর বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় একটি স্কুলের নাম রেড হিল স্কুল। এখানে লেভেল টুর ছাত্রকেও সকাল ৭টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত স্কুলে রাখা হয়। আমাদের দেশের মতো এখানে কোনো ধরাবাঁধা সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম নেই। তার অর্থ এই নয় যে, ছাত্রদের কী পড়ানো হবে সেটা শিক্ষকরা জানেন না। ছাত্রদের পাঠ্যবইও আছে। আছে বুক লিস্ট। কিন্তু শিক্ষকরা এমনভাবে পড়ান যাতে ছাত্রদের বুক ওয়ার্ম বা বইয়ের পোকা না হতে হয়। এমন দু-একটি স্কুলের পাঠদান পদ্ধতি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ছাত্রদের সামনে থাকে ম্যাপ, খেলার সামগ্রী, ছোট ছোট যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। গল্পের ছলে, খেলার ছলে তাদের শিক্ষা দেয়া হয়। ক্লাসে তাদের টিফিন দেয়া হয়। শেখানো হয় শরীর চর্চা, কিছুটা সময় দেয়া হয় খেলাধুলার জন্য। কোনো হোম টাস্ক নেই। স্কুলের সময় দীর্ঘ। যা কিছু পড়ার বা শেখার তারা সেটা স্কুলেই শিখে আসে। বাসায় এসে আবার পড়তে বসার বালাই নেই। যা কিছু শিক্ষা সেটা হাতেকলমেই দেয়া হয়।
এখানে নেই কোনো কোচিং ক্লাস। তবে সিডনিতে দেখলাম কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি প্রাইভেট পড়ানোর পদ্ধতি প্রবর্তনের পাঁয়তারা করছেন। উদ্দেশ্য অতি সাধু! টুঁ পাইস কামানো। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে স্কুলে আর যেসব সার্ভিস আছে সেগুলো হলো : (১) হলিডে স্কুল (২) আফটার কেয়ার (৩) ইমার্জেন্সি সার্ভিস (৪) চাইল্ড কেয়ার ইত্যাদি।
এগুলোর একটাও বাধ্যতামূলক নয়। পিতামাতারা প্রায় সকলেই চাকরিজীবী বা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। তারা ৫টার পর বাচ্চাদের পিকআপ করতে পারেন। এই দুই ঘণ্টা তারা আফটার কেয়ারে থাকবে। বাচ্চাদেরকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নাই। ওদেরকে ফাস্ট এইড শেখানো হয়। শেখানো হয় কেমন করে স্বনির্ভর হতে হবে। শেখানো হয় ম্যানারিজম বা আচার-ব্যবহার। মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হয় এক্সকার্সন ট্যুরে। আমাদের দেশে দাদি-নানী না হলে বাচ্চার মায়েরা কাজে যেতে পারেন না বা বাচ্চাকে মনের মতো করে মানুষ করতে পারেন না। ওইসব দেশে দাদি-নানীর প্রয়োজন হয় না। এসব আমাদের দেশে স্বপ্ন। তাই বলে সেগুলো চিরদিন কি স্বপ্নই থেকে যাবে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন