মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বৃহৎ প্রকল্পগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে

প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেহেদী হাসান পলাশ : বুধবার হঠাৎ করেই রাজধানীতে মৌসুমের প্রথম ঝড় বৃষ্টি উপভোগের অভিজ্ঞতা হয় রাজধানীবাসীর। দুই মেয়াদে মোট আধা ঘণ্টার মতো বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির সাথে হালকা ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। শিলাপাতও হয়। আধা ঘণ্টার এই বৃষ্টিতেই রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিমগ্ন হয়ে পড়ে। রাজধানীর শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলা, পল্টনের ভিআইপি রোডে ছোটখাট বৃষ্টিপাতে পানি জমে না। কিন্তু বুধবারের বৃষ্টিপাতে এই ভিআইপি সড়কের দুইপাশ ১-২ ফুট গভীর পানিতে ডুবে যায়। এই পথে চলতে গিয়ে রিক্সা উল্টে অনেক যাত্রী নোংরা পানিতে পড়ে যান। বিশেষ করে অফিস ফেরত অনেক মহিলা যাত্রী এভাবে পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। রিক্সা উল্টানোর কারণ অবশ্য বৃষ্টি বা পানিবদ্ধতা নয়, এই ভিআইপি সড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বড় বড় গর্ত। রাস্তা ভেঙে এ গর্ত সৃষ্টি হয়নি। মাস ছয়েক আগে এই সড়কে মেট্রো রেলের নির্মাণ উপলক্ষে কিছু দূর পর পর বড় বড় গর্ত করে পাইলিং করে গর্তগুলো খোলা রেখেই নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চলে গেছে। মেট্রো রেলের বাকি কাজ কবে হবে তা কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এই পাইলিংয়ের কাজগুলো ঢিমেতালে একটি একটি করে প্রায় বছরখানেক সময় নিয়ে করা হয়েছে। ফলে মেট্রোরেলের বাকি কাজ নিয়ে রাজধানীবাসীর সংশয় অযৌক্তিক নয়। এরমধ্যে খবর বেরিয়েছে, মেট্রোরেলের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প শুরুর আগেই ব্যয় বেড়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে দুর্নীতির। ফলে মেট্রোরেলে অর্থায়নকারী সংস্থা জাইকা অর্থ ছাড়ের প্রধান শর্ত দিয়েছে দুর্নীতিমুক্ত প্রকল্প পরিচালনা করার। বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্প রিভাইস বাজেট বা সাপ্লিমেন্টারি বাজেটের নামে কয়েক দফায় ব্যয় বেড়ে শেষতক দ্বিগুণ বা তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে বাস্তবায়নের সময়। সাথে সাথে জনগণের দুর্ভোগও বৃদ্ধি পায়। এভাবেই বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্প টাকা বানানোর উপলক্ষে পরিণত হয়েছে।
প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, এখন সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো সম্পন্ন হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানুষের জীবনযাত্রার মান আরো বেড়ে যাবে। এমনকি জিডিপি ১ শতাংশ হারে বেড়ে যেতে পারে বলেও ধারণা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের। তবে কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় যত বাড়ে, ততই তাতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। অনেক প্রকল্পের মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হলেও কাজের অগ্রগতি দেখা যায় না। আবার অনেক প্রকল্পের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর বড় কারণ সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় ও প্রকল্প নির্বাচনে দূরদর্শিতার অভাব ইত্যাদি। সরকার তার গত মেয়াদে কতকগুলো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। এর মধ্যে আছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, বিভিন্ন জাতীয় সড়কের চার লেন প্রকল্প, রাজধানীতে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার প্রকল্প ইত্যাদি। বিতর্ক সত্ত্বেও এগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বৈকি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন, জমি অধিগ্রহণ, অর্থায়ন, পরিবেশ-সংক্রান্ত অনুমোদন ও কারিগরি জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তাছাড়া কাজ না করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া বিল-ভাউচার, কমিশনের ভিত্তিতে কার্যাদেশ, টেন্ডার জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদিও প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথাসময়ে প্রকল্প শেষ না করা বাংলাদেশে একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশে এমন কোনো প্রকল্প বোধহয় নেই, যেটি যথাসময়ে ও প্রথমে বরাদ্দকৃত ব্যয়ে শেষ হয়েছে। বিশেষ করে ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি ধরাবাঁধা নিয়ম হয়ে গেছে।
পরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে ১৮৪২ সালে ইংল্যান্ডের নরউড জংশন রেলওয়ে স্টেশনে বিশ্বের প্রথম ফ্লাইওভার নির্মিত হয়। এরপর তা নিউইয়র্ক, প্যারিস, মস্কোর মতো উন্নত শহরগুলোতে পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তবে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পাতাল রেলের সাফল্যের পেছনে সুষ্ঠু পরিকল্পনার বড় ভূমিকা রয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া ফ্লাইওভার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা তো দুরে থাক বরং তা আরো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। চায়নার রাজধানী বেইজিং তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া যেভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রবণতা বেড়েছে তাতে আগামী কয়েক বছরে রাজধানী ফ্লাইওভারের জঞ্জালে পরিণত হতে পারে। বিশেষ করে এ পর্যন্ত যেসব ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে তা যানজট নিরসনে কতোটুকু ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে সে বিবেচনায় এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
সংবাদে প্রকাশ, উড়াল সেতুর সঙ্গে মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভারের মাধ্যমে রাজধানীবাসীর প্রথম পরিচয় হয়। ওই সময় মহাখালীতে ১১৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম রেলওভার উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়। ৬৬৭ দশমিক ৭৮ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০০৫ সালে। ফ্লাইওভারটি মহাখালী রেলক্রসিং থেকে কাকলী পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করেছে। ফলে এটির মাধ্যমে শুধু উত্তরা, বিমানবন্দর, খিলক্ষেতগামী গাড়িগুলো মহাখালী রেলক্রসিংয়ের দীর্ঘ সিগন্যাল থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে তা ফার্মগেট বিজয় সরণি হয়ে মহাখালী, গুলশান-১, বনানী, বাড্ডা রুটে চলাচলকারী পরিবহনের জন্য কোনো সুফলই বয়ে আনতে পারেনি। ফলে মহাখালী এলাকার চিরচেনা যানজট এখনও পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অন্যদিকে এই ফ্লাইওভার চাপ সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর গেইট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিগনালের উপর। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী যানজট।
২০০৫ সালেই ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও-বাসাবো ফ্লাইওভার খুলে দেয়া হয় যান চলাচলের জন্য। ৮১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই উড়াল সেতুর উপর দিয়ে সকল প্রকার যান চলাচল করলেও ২০১১ সালে ফ্লাইওভারটিতে ফাটল দেখা দেয়। এরপর বাস, ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবারও তা ভারী যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। তবে ফ্লাইওভারটির নকশাগত ত্রুটির কারণে খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ের যানজটে পড়তে হচ্ছে অধিকাংশ যানবাহনকে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নেয়া তেজগাঁও বিজয় সরণি রেলওভার ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০১০ সালে। নির্মিত ফ্লাইওভারটি কার্যত কোনো যানজট নিরসন তো করেইনি বরং বিজয় সরণিতে সৃষ্টি করেছে দীর্ঘ যানজটের। এসব ফ্লাইওভার নির্মাণের দফায় দফায় আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এ ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যখন এই ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব করা হয় তখন এর ব্যয় ছিল সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার কিছু বেশি। বিএনপি সরকারের শেষ দিকে এই ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটিতে সংশোধিত ব্যয় ২ হাজার ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের ব্যয় ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা যুক্ত হলে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াবে ৪ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ফ্লাইওভারের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়াবে ৪৪৪ কোটি টাকার বেশি। আর সিটি করপোরেশনের ব্যয় বাদ দিলে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ২১০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা রাজধানীর অন্যান্য ফ্লাইওভারের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি। অথচ রাজউকের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। ফ্লাইওভারটি নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। আর মিরপুর-বিমানবন্দর সড়ক ফ্লাইওভারের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১০৫ কোটি টাকা। আবার ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৯৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তাছাড়া ফ্লাইওভারটি রাজধানীর যানজট নিরসনে কতটুকু ভূমিকা রাখছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ফ্লাইওভারে নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই পূরণ হয়নি এই ফ্লাইওভার নির্মাণে। কেননা এই ফ্লাইওভারের নিচে বিপুল পরিমাণ রাস্তা ঘেরাও করে দেয়া হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও ফ্লাইওভারের সমপরিমাণ রাস্তা ঘেরাও করা হয়েছে। ফ্লাইওভারটি স্বামীবাগ অংশে এতো বেশি রাস্তা ঘেরাও করেছে যে, বড় কোনো গাড়ির সেখান দিয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। দুই বছরের অধিক সময় হয়ে গেলো ফ্লাইওভারটি চালু হয়েছে কিন্তু এর নিচের রাস্তা এখনো কোথাও কোথাও এতোই ভাঙাচোরা যে সেখান দিয়ে গাড়ি চালানো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। সেসব জায়গা নষ্ট গাড়ি ও নির্মাণ সামগ্রী রাখার গ্যারেজে পরিণত হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে এই রুটের গাড়িগুলো ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। এতে ফ্লাইওভার কোম্পানির রেভিনিউ বাড়ে। জনগণের কোনো লাভ হয়নি।
এদিকে ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘মগবাজার-মৌচাক (সমন্বিত) ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের সময় ছিল ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১৩। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে ২০১৪ সাল পেরিয়ে গেছে। ২০১৬ সালের পহেলা জানুয়ারি ফ্লাইওভার খুলে দেয়ার কথা ছিল। শুরুতে অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। পরবর্তীকালে ফ্লাইওভারের পরিধি সামান্য বাড়ানো হয়। সূত্র জানায়, পরিধি বাড়ানোর অজুহাতে ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিগুণেরও বেশি করা হয়। এই সময় ব্যয় ধরা হয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সর্বশেষ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পের সময়ও বাড়ানো হয়েছে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এদিকে ফ্লাইওভারটি নির্মাণের শুরু থেকে নানা জটিলতা তৈরি হয়। এর মধ্যে ১২২ বার পরিবর্তন করা হয় নকশা। আর নির্মাণ ত্রুটির কারণে ভেঙে ফেলতে হচ্ছে ৬০টি পিলার।
জানা গেছে, নকশা আছে। কিন্তু সেই নকশার সঙ্গে বাস্তবে কোনো মিল নেই। মাটি খুঁড়তে গেলেই পাইপ অথবা ক্যাবল পাওয়া গেছে। এ কারণে ১২২ দফা ফ্লাইওভারের (মগবাজার-মৌচাক) নকশা বদলাতে হয়েছে। গত ৫ মার্চ মগবাজার সানরাইজ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পাইলিং করতে যায় তমা কনস্ট্রাকশনের শ্রমিকরা। নিয়মানুযায়ী ৬ ফুট ম্যানুয়ালি (খুন্তি-কোদাল-শাবল ব্যবহার করে) খনন করা হয়। এরপর রিগ দিয়ে খনন করার কথা। কিন্তু মাত্র ৩ ফুট খনন করার পর সেখানে ২টি গ্যাসের পাইপ, সুয়ারেজের ৬টি, পানির লাইন ২টি, বিদ্যুতের ৩টি এবং বিটিসিএলসহ মোট ২৬টি পাইপ ও ভূগর্ভস্থ ক্যাবল পাওয়া গেছে। নকশা পরিবর্তন করে আবার শুরু হয় নির্মাণ কাজ। এছাড়া বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে নকশা প্রণয়ন করা হয় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের। আর সে ভুল নকশা মেনেই নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্লাইওভারটি। এতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও এখন আর ত্রুটি সংশোধন সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। কারণ ত্রুটি সারাতে গেলে ভাঙতে হবে ৬০টি পিলার।
জনগণ যখন ত্রুটিযুক্ত বা নকশা বহির্ভূত কোনো ইমারত নির্মাণ করে তখন রাজউক সেই ইমারত ভাঙার জন্য ইমারত মালিককে নোটিশ করে। ইমারত মালিক নিজে না ভাঙলে রাজউক নিজস্ব লোকবল দিয়ে তা ভেঙে ফেলে এবং ভাঙার খরচ ও ত্রুটিপূর্ণ ইমারণ নির্মাণের শাস্তিস্বরূপ জরিমানা করে। যারা মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণের নকশা করেছে, যারা নকশা নির্বাচন, তদারকি ও নির্মাণ কাজে প্রকল্পের সাথে জাড়িত ছিল তাদের ভুলে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয়, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন সকলের জন্য সমান হলে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে না? তাদের কাছ থেকে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া অতিরিক্ত অর্থ কেন শাস্তিস্বরূপ আদায় করা হবে না?
এভাবে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৭ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন পর্যন্ত ২৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময় যখন মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সমীক্ষা চালানো হয় তখন এর ব্যয় দেখানো হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। তবে ২০০৭ সালে একনেকে যখন পদ্মা সেতু প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় তখন মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানালে সরকার দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। নিজ উদ্যোগে প্রকল্পটির কাজ শুরুর আগেই প্রথম সংশোধনীতে ১০ হাজার একশ’ কোটি টাকা বাড়িয়ে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি আরো ৮ হাজার ২৮৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকায়।
তবে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি; উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প। ২০১০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পে এ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে ৪ বার। ফলে আড়াই বছরের প্রকল্প এখন লাগছে ৬ বছর। এ প্রকল্পে মোট ৪ দফায় ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা। নতুন করে আরো ১ বছর সময় ও ৬শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অনেক কাজই বাকি। একইভাবে দেশের প্রায় সকল চার লেইন প্রকল্প,ও ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পসহ বৃহৎ প্রকল্পগুলোর নিমার্ণ সময় ও ব্যয় দ্বিগুণ থেকে চারগুণ বেড়েছে যার বিস্তারিত বিবরণ এ লেখায় দেয়ার সুযোগ নেই।
প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষ যখন প্রতিনিয়ত নিজের গতি বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশে আমরা বিশেষ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্টো রথে চলেছি। চায়না মাত্র ৬ দিনে একটি ১৫ তলা ভবন নিমার্ণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেখিয়েছে। গত নভেম্বরে দিল্লির আজাদপুরের সর্ববৃহৎ সবজির পাইকারি বাজারের কাছে ১.৬ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাজেট ধরা হয়েছিল ২৪৭ কোটি রুপি। কিন্তু ঐ ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৪৩ কোটি রুপি। অর্থাৎ বাজেটের চেয়ে ১০৪ কোটি রুপি কম ব্যয় হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের দুইমাস আগেই এ ফ্লাইওভারটির নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে। এ নির্মাণ প্রসঙ্গে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দু কেজরিওয়াল বলেন, ‘আমি এরকম কথা মনে করতে পারছি না, যে ২৫০ কোটির কোনো প্রজেক্ট ১৫০ কোটিতে শেষ হয়েছে। আমি ২৫০ কোটির প্রজেক্ট ৫০০ কোটি অথবা এক হাজার কোটিতে যেতে দেখেছি। এর মধ্যে বাজেটের চেয়ে কমে অর্থ ব্যয় হওয়া আসলেই অলৌকিক ঘটনা। সাধারণত প্রজেক্ট চারবারের মতো বাজেট অতিক্রম করে থাকে। শুধু একটি সৎ সরকারই এটি অর্জন করতে পারে’।
বাংলাদেশে সরকারী- বেসরকারী বেশিরভাগ মানুষই বিদেশকে অনুকরণ করতে ভালবাসেন। চায়না ও দিল্লীর এ দৃষ্টান্ত থেকে তারা কি কোনো শিক্ষা নেবেন?
email:palash74@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
রাশেদ ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৩৩ পিএম says : 0
আমাদের দেশের উন্নতির জন্য দুর্নীতি-ই বড় অন্তরায়।
Total Reply(0)
ফিরোজ খান ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৩৪ পিএম says : 0
এই চিত্রগুলো তুলে ধরায় লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Total Reply(0)
মিলন খন্দকার ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৩৯ পিএম says : 0
যাদের ভুলে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয়, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে না? এটা আজকে দেশের ষোল কোটি মানুষের প্রশ্ন
Total Reply(0)
Bulbul Ahmad ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:৪২ পিএম says : 0
বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্প টাকা বানানোর উপলক্ষে পরিণত হয়েছে।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন