কামরুল হাসান দর্পণ : গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের ওপর দিয়ে বেশ বড় ধরনের সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের কোনো মন্ত্রীকে নিয়ে এতটা সমালোচনার ঝড় আগে বইতে দেখা যায়নি। বলা যায়, মন্ত্রীকে এক প্রকার হোয়াইট ওয়াশ করা হয়েছে। এমন এমন তীর্যক মন্তব্য করা হয়েছে যা সব সময় প্রকাশযোগ্য নয়। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্ত্রীকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলেও মন্ত্রী বা তার পক্ষ হয়ে এর প্রতিবাদ বা যুক্তি দিতে কাউকে দেখা যায়নি। দেখা যাওয়ার কথাও নয়, কারণ মন্ত্রীকে নিয়ে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা দেশের মানুষ জানে। এক কথায় বলতে গেলে গত সপ্তাহে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য মন্ত্রীকেই দায়ী করা হয়। তার ইশারাতেই নাকি পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে এবং সারা দেশ অচল করে দেয়। একটি দৈনিকে তো সরাসরিই প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রীর বাসায়। মন্ত্রীকে এ সংবাদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। তার অর্থ হচ্ছে, ঘটনাটি সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীর উপস্থিতিতে কেন পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়? এর সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে, চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মনিরের গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যে চালক দুর্ঘটনা ঘটায় এবং তারা মারা যান, আদালত সেই চালকের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন। সাভারের আরেক ঘটনায়, ট্রাকচালক এক নারীকে চাপা দিয়ে হত্যা করায় চালকের মৃত্যুদন্ড হয়। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পরিবহন শ্রমিকরা। আর এতে পরোক্ষভাবে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ ওঠে মন্ত্রী শাজাহান খান ও আরেকজন প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এর পেছনে যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে বা কেউ জড়িত থাকে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সে বিষয় দেখবে। কারও অবস্থান বা সম্পৃক্ততা থাকলে সে বিষয়ে দেখবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিষয়টি যখন ওপেন সিক্রেট, তখন পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার হাত অতদূর পর্যন্ত যাবে কিনা? কারণ, ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, পরিবহন ধর্মঘটের নামে রাজধানীর গাবতলীতে পুলিশের ওপর হামলা, ট্রাফিক বক্সে আগুন, রেকার পোড়ানো এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মূল আসামিদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, অফিস করছে। পুলিশ বলছে, তারা পলাতক। এই যখন পরিস্থিতি, তখন যাদের পরোক্ষ সিদ্ধান্তে পরিবহন ধর্মঘট হলো, তাদের টিকিটি স্পর্শ করা পুলিশের পক্ষে যে অসম্ভব তা বলাবাহুল্য। নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান পরিবহন শ্রমিকদের কান্ডারি হয়ে আছেন। তিনি পরিবহন শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সোচ্চার। তারাও তার কথায় ওঠা-বসা করে। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেন, তার বাইরে এক পা-ও তারা যায় না। পরিবহন শ্রমিকদের ওপর তার এতটাই প্রভাব। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এই যে পরিবহন ধর্মঘট হলো এবং সারা দেশ অচল হলো, তা করা হয়েছে আদালত কর্তৃক দুজন অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার বিরোধিতা করে। অর্থাৎ আদালতের রায়কে অনেকটা চ্যালেঞ্জ করে এবং এ রায় প্রত্যাখ্যান করে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। এর অন্য অর্থ হচ্ছে, আইন না মানা। এই না মানার পেছনে সরকারের একজন মন্ত্রীর পরোক্ষ সমর্থনের অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রী যখন পরোক্ষভাবে আইন না মানার মতো অনৈতিক প্রতিবাদে সমর্থন দেন, তখন আমাদের দেশের আইন সবার জন্য সমান কিনা, তা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। ইতিবাচক দিক হলো, সরকার পরিবহন শ্রমিকদের দাবির সাথে আপস করেনি। সরকারের আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে লড়ার কথা বলেছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, পরিবহন শ্রমিকদের এই যে অরাজকতা, সম্পদ বিনষ্ট এবং দেশের আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক অর্থনীতির যে ক্ষতি হলো- এর দায় কে নেবে? সরকারেরই একজন মন্ত্রীর পরোক্ষ ভূমিকার কারণে যে ক্ষতি হলো, এর দায় কি মন্ত্রীর ওপর পড়ে না? নিশ্চয়ই পড়ে। মন্ত্রী এ দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমরা লক্ষ্য করেছি, মন্ত্রীর দায় থাকা সত্তে¡ও সরকার তার প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল আচরণ করেছে। তাকে ন্যূনতম ভর্ৎসনাও করা হয়নি। এখানেই প্রতিভাত হয়, আইন সবার জন্য সমান নয়। প্রভাবশালীরা আইনের ঊর্ধ্বে।
দুই.
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করা নিয়ে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন নিয়ে আমরা সরকারি দলের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত তীব্র সমালোচনা শুনি। বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল থেকে শুরু করে তার নেত্রীকে হেন কোনো অপবাদ নেই, যা দেয়া হচ্ছে না। আন্দোলন ব্যর্থ হলে যা হয় এবং যে খড়গ নেমে আসে, তার সবই দলটির ওপর দিয়ে বইয়ে দেয়া হচ্ছে। শীর্ষ নেত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এখন কোর্ট-কাচারি যে যাতায়াত করতে করতে হয়রান-পেরশান অনেকে গ্রেফতার এড়াতে দিনের পর দিন বাড়িছাড়া হয়ে রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন এবং মহাসচিবসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে সরাসরি এবং পরোক্ষ হুকুমদাতা হিসেবে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় নেতাদের একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে। এক মামলায় মুক্তি পেলে অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। জেল টু বাসা, বাসা টু আদালত- এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের দিনযাপন করতে হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মী আছে, যারা অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সরকারি দলের লোকজনের সাথে ভাঁজ দিয়ে চলছে। কিছু করার নেই। বাঁচতে তো হবে! এর বিপরীত চিত্র দেখি শাসক দলের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে। শিক্ষাঙ্গনে প্রকাশ্যে পিস্তল, রামদা ও লাঠিসোঁটা নিয়ে দাবড়ে বেড়ালেও এবং অরাজকতা সৃষ্টি করলেও তাদের টিকিটি পুলিশ ধরতে পারে না। এই যে রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্তৃক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা দাবি করা নিয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল, তাতে কি পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেছে? করেনি। কারণ তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। পুলিশের হাত অতদূর পর্যন্ত যাবে না। আবার অনেক এমপি আছেন যারা অপরাধ করলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। এমনকি আদালতে সাজা হলেও অচিরেই ফুলের মালা গলায় দিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। তখন সাধারণ মানুষের সরল প্রশ্ন হতে পারে, কীভাবে কী হয়? সরকারে যারা থাকেন, তাদের অপরাধ বলে কি কিছু নেই? অপরাধ করলেও আইন তাদের ধরতে ও ছুঁতে পারে না! বাস্তবতা তাই। আমাদের দেশের সংস্কৃতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার আইন করে এবং প্রয়োগ করে, তবে তা সরকারি দলের লোকজনের জন্য নয়। এখানে আইনের অনেক মারপ্যাঁচ ও ফাঁকফোকর রেখে দেয়া হয়। তবে বিরোধী দলের নেতাকর্মী হলে সেখানে আইন বড়ই কড়া এবং কোনো ধরনের ফোকর থাকে না। সেখানে আইনের শাসন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ হয়। আমরা বলছি না, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ধোয়া তুলসি পাতা। তারাও অপরাধ করে এবং করতে পারে। তবে তাদের আইনের ন্যূনতম প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয় না, যেভাবে সরকারি দলের লোকজনের ক্ষেত্রে দেয়া হয়। বিরোধী দলের ক্ষেত্রে আমরা এমন নজিরও দেখেছি, কোথায় কোন ময়লার ট্রাক পুড়েছে, তার দায় এসে পড়েছে দলের মহাসচিবের ওপর। বিষয়টা এমনভাবে বলা হয়েছে যে, মহাসচিব সাহেব যেন নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে ট্রাকে আগুন দিয়েছেন। পুলিশ এতটাই দূরদর্শী ছিল যে কালবিলম্ব না করে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে রেটরিক কথাবার্তা নতুন কিছু নয়। এগুলোকে মাঠে-ময়দানের রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ ধর্তব্যের বিষয় নয়। এমন একটা অপসংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দল রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও তাতে মামলা হয়ে যায়। আন্দোলনের সময় বিএনপি মহাসচিব একবার বলেছিলেন, আগামীকাল থেকে কোনো বাস বা গাড়িঘোড়া চলবে না। দেখা গেল পরদিন বাসসহ পরিবহনে ভাঙচুর হয়েছে, ব্যাস, তার বিরুদ্ধে হুকুমের আসামি হিসেবে মামলা হয়ে গেছে। অথচ অতীতে আমরা আন্দোলনের সময় এমন অনেক কথা শুনেছি। হরতালের সময় জ্বালো, জ্বালো আগুন জ্বালো, সরকারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে, গাড়ি ঘোড়া চলবে না, বাসের চাকা ঘুরবে না- এমন অনেক শ্লোগান শুনেছি। তখন আগুন জ্বললেও এবং বাস পুড়লেও শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে দেখা যায়নি। এখন তা অহরহ দেখা যায়। অবশ্য এটা ভালো। আন্দোলন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি হবে- এটা মানা যায় না। এ অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে প্রশ্ন জাগে তখনই যখন, দেখা যায় সরকারি দলের লোকজন এমন কাজ করলে কিছু হয় না। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কাউকে গ্রেফতার দূরে থাক, মামলা পর্যন্ত হয় না। বিরোধী দল করলে যেভাবে আইনকে সচল করা হয়, সরকারি দলের কেউ করলে সেভাবে সচল হয় না। আইনের যখন সুবিধামতো ব্যবহার হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে, আইন সবার জন্য সমান নয়।
তিন.
আমরা দেখেছি, বর্তমান সরকারের বিগত আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় তার অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গণহারে মামলা তুলে নিতে। এমনকি খুনের মতো মারাত্মক অপরাধের মামলাও তুলে নেয়া হয়েছে। অথচ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক মামলা ছিল, সেগুলো বিবেচনায়ই নেয়া হয়নি। অপরাধের তালিকায়ই রেখে দেয়া হয়। এ থেকে দেশের মানুষ বুঝতে পারে, ক্ষমতার কাছে আইন অসহায়। ক্ষমতাবানরাই আইন প্রণয়ন করে এবং তা প্রয়োগ করা হয় বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের ওপর। অর্থাৎ আইন থাকলেও তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ তারা ক্ষমতাসীন এবং তাদের পেছনে মন্ত্রী-এমপিসহ ক্ষমতাবানরা রয়েছে। ক্ষমতাবানদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন থাকলে একজন সাধারণ মানুষেরও অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এই যে নজিরবিহীন পরিবহন ধর্মঘট হয়ে গেল গাড়ি ভাঙচুর হলো, পুলিশের রেকার ও পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেয়া হলো এবং একজন শ্রমিক নিহত হলো- এসব ঘটনায় কি উল্লেখ করার মতো কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে? পাঁচ মামলা হলেও মূল আসামিদের কি ধরা হয়েছে? পরিবহন ধর্মঘটে যে নিদারুণ জনদুর্ভোগ হলো, এর জন্য কাউকে কি দায়ী করা হয়েছে? হয়নি। আমরা তো দেখেছি, বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় গন্ডায় গন্ডায় নেতাকর্মীদের মাঠ ও বাসাবাড়ি থেকে কোমরে রশি দিয়ে বা হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুকুম দেয়ার অভিযোগ এনে মামলা করতে। পরিবহন ধর্মঘটে যে বিরাট ধ্বংসযজ্ঞ হলো, অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ল, শত শত কোটি টাকা ক্ষতি হলো, এ ব্যাপারে তো সরকারের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। টেলিভিশন ফুটেজে আমরা দেখেছি কী তান্ডব চালানো হয়েছে, এমনকি যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন, তাদেরও নাজেহাল হতে হয়েছে। অর্থাৎ জনসাধারণের চলাচলের যে স্বাভাবিক অধিকার তা বাধাগ্রস্ত করতে চরম পন্থা অবলম্বন করা হয়। এর বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা গেল না। সরকারি দলের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে কড়া কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। এর কারণ কি, পরিবহন শ্রমিকদের পেছনে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী যুগলের পরোক্ষ সমর্থন থাকা? তারা আছে বলে কি, আইন সেখানে কার্যকর করা যাবে না? তারা আছে বলে কি, সড়কে সড়কে যেসব পরিবহণ শ্রমিক ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তাদের প্রতিহত বা কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না? বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় যেমন নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত করে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা হয়ে যায়, এক্ষেত্রে কেন হবে না? সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যে ধর্মঘট পালন করা হলো, তার ভিত্তি কি ছিল? আদালত কর্তৃক দুজন সাজাপ্রাপ্ত আসামির সাজা মওকুফের জন্য নয় কি? এটা কি আইন ও আদালতের বিরোধিতা করা নয়?
চার.
আমাদের দেশের রাজনীতিটাই এমন যে এখানে নিজের অনুক‚লে গেলে সব ভালো, আর সমস্যা হলে সব খারাপ। আইনকে নিজস্ব গতিতে সব সময় চলতে দেয়া হয় না। আইনের মধ্যেই অনেক ফাঁকফোকর রেখে দেয়া হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই ফাঁকগুলো ভালো জানে। কাকে ফাঁক গলিয়ে বের করে দিতে হবে, কাকে ফাঁক বন্ধ করে আটকে রাখতে হবে- এ কৌশল তারা বেশ ভালো করেই জানে। লোক বুঝে আইনের প্রয়োগ করা হয়। অথচ আইন যদি তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারত, তবে যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, তারাও ধরা পড়ত। এতে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার যেমন কমত, তেমনি আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হতো। যখন দেখা যায় দুর্নীতির দায়ে এক এমপির তিন বছরের জেল হওয়ার পরও তাকে জেল খাটতে হয়নি, তখন দেশের মানুষ এই বার্তাই পায়, আইন ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আবার যখন দেখে পরিবহন ধর্মঘটে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়ার পরও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে ও প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে এবং পুলিশ বলে পলাতক, তখনও বোঝা যায় আইন সবক্ষেত্রে কার্যকর নয়। এসব ঘটনায় দেশের মানুষ যদি ভাবে, বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা-মোকদ্দমা দেয়া হয়েছে এবং বিচার চলছে, সেগুলো সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ, তাহলে তাদের দোষ দেয়া যাবে না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ওপর আইন তার চোখ খোলা রেখে চললেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। বলা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে আইনের চোখ সবসময় খোলা রাখে। সবচেয়ে বড় কথা, ক্ষমতাসীন দলের যারা অপকর্ম করে বেড়ায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা সবই দেখে এবং খোঁজখবর রাখে, নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। তবে তারা ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। এমনকি সব জেনেও কিছু করতে পারে না। কারণ তারা ভালো করে জানে, আমাদের দেশের আইন তার নিজস্ব শক্তিতে নয়, ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাবানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী গতিপ্রাপ্ত হয়। তা নাহলে পরিবহন ধর্মঘটের নামে যে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটে গেল এবং জনগণের দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হলো, এর আইনি প্রতিকার পাওয়া যেত।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন