ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : মনে হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমরা এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। এই পরীক্ষা আমাদের ধর্মীয় বিশ^াস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আদর্শিক চেতনা ও জাতিসত্তার পরিচয় মুছে ফেলার প্রশ্নে। যারা দেশের বৃহত্তর মুসলিম সমাজের সম্মুখে এই পরীক্ষার প্রশ্নমালা ছুঁড়ে দিয়েছেন তাদের অবস্থান রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে। সারাদেশে ধর্মীয় মহল প্রতিবাদমুখর হলেও তারা নির্বিকার, নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়। মনে হচ্ছে, জাতির কাছ থেকে এই কঠিন পরীক্ষাটি না নেয়া পর্যন্ত তারা পিছু হঠবেন না। অনেক হিসাব-নিকাশ করে ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত পীর আউলিয়ার পদধূলিতে ধন্য এই পুণ্যভূমিকে মূর্তিপূজার স্বর্গভূমি বানানোর খায়েশ নিয়ে তারা গ্রিক দেবির মূর্তিটি স্থাপন করেছেন এবং তার জন্য বেছে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখস্থ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি।
একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হচ্ছে আদালত চত্বর এবং বিচার বিভাগ। দেশের নতুন প্রেসিডেন্টকে শপথ পড়ানোর দায়িত্ব বিচারপতির ওপর। পার্লামেন্টের যে কোনো সিদ্ধান্তকে সংবিধানের মাপকাঠিতে রদ করে দেয়ার ক্ষমতা বিচার বিভাগে সংরক্ষিত। সম্প্রতি আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৭টি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হলেও অবিলম্বে তার এই আদেশ কার্যকরী হয়। কিন্তু সে দেশের আদালত প্রেসিডেন্টের আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করে দেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও দেশের আদালতের সে রায় মেনে চলতে বাধ্য হন। তার মানে যে কোনো দেশে রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিধর তিনটি বিভাগের একটি হচ্ছে বিচার বিভাগ।
ক্ষমতাসীন বা পেশিশক্তির জোর-জুলুমের বিরুদ্ধে মানুষ যখন সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ে তখন তাদের একমাত্র আস্থার স্থান থাকে বিচারালয়। দেশের সর্বোচ্চ আদলত প্রাঙ্গণকে তাই অনেকে পবিত্র স্থান বলে উল্লেখ করে থাকেন। পবিত্র ও পবিত্রতা পরিভাষাটি আমরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। কাজেই সুপ্রিম কোর্ট চত্বরকে পবিত্র স্থান না বলে জাতির আস্থার স্থান ও প্রতীক বলে আখ্যায়িত করাই অধিকতর যৌক্তিক। যারা সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে মূর্তি স্থাপন করেছেন, তারা জেনেশুনেই আমাদের বিশ^াস, দীর্ঘদিনের জীবনাচার ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। তারা আমাদের শিরায় হাত রেখে ধমনীতে ঈমান কতখানি আছে, নিরীক্ষা করতে চান। আল্লাহর ওপর বিশ^াসী মুসলমান হিসেবে বাঁচতে হলে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ছাড়া দেশবাসীর সামনে বিকল্প কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না।
জাতীয় জীবনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে প্রথমে তার জন্য কানাঘুষা চলে, প্রস্তাব ওঠে। কোনো মহল থেকে দাবি উত্থাপিত হয়। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়। তারপর সংসদে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়। এরপরই জনগুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অথচ গ্রিক দেবির বেলায় দেখা গেল, কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ একটি কাল্পনিক গ্রিক দেবিকে শাড়ি পরিয়ে জনগণের আস্থার স্থানটিকে কলঙ্কিত করা হলো। জাতীয় জীবনে বড় কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তার জন্য অন্তত নিজস্ব মহলে আলোচনা হয়। অথচ আমরা জানতে পারলাম না, আমাদের জাতীয় জীবনে এমন কী সমস্যা দেখা দিল, যা মেটানোর জন্যে সুপ্রিম কোর্টের সামনে মূর্তি স্থাপন করতে হলো। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এতকাল এদেশে ন্যায়বিচার ছিল না, যা নিশ্চিত করার জন্য নতুন করে এই মূর্তি স্থাপন করতে হলো? আর তাও করা হলো, গোপনে সন্তর্র্পণে সুপ্রিম কোর্টের ছুটি চলাকালীন।
দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হলে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মূর্তির পক্ষে সাফাই গেয়ে যে অভিমত দিয়েছেন তা আগাগোড়াই বিভ্রান্তিকর। তিনি গ্রিক দেবির মূর্তিকে ভাস্কর্য বললেও এ কথা পরিষ্কার করেননি যে, কোন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বা কার সাথে শলাপরামর্শের ভিত্তিতে এমন স্পর্শকাতর একটি পদক্ষেপ নেয়া হলো। কিংবা দেশের বিচার ব্যবস্থায় এমন কি অরাজকতা চলছিল, যা নিরসনের জন্য গ্রিক দেবির আশীর্বাদ নিয়ে তিনি সংকট উত্তরণের স্বপ্ন দেখেছেন? গ্রিক দেবির মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, দেবির দুই চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকার মানে হচ্ছে, বিচারের বেলায় ন্যায়বিচারে কোনো পক্ষপাতিত্ব না করার সংকল্প। আসলে আমাদের আপত্তিটা এখানেই। মূর্তিপূজার সাথে মুসলমানদের চিন্তার বৈপরীত্যের কারণও এটিই। তিনি গ্রিক মূর্তিকে ন্যায়বিচারের সূচক হিসেবে দেখানোর কসরত করেছেন। তার কথার অর্থ দাঁড়ায়, হাতে তৈরি নিষ্প্রাণ কাল্পনিক গ্রিক মূর্তি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে পারে, মানুষের কল্যাণ বা অকল্যাণ সাধন করতে ও দেশে ন্যায় ইনসাফ নিশ্চিত করতে পারে। এখনেই দেশের তওহীদি জনতার চিন্তা, বিশ^াস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক চেতনার সাথে মূর্তিপূজারীদের শিরকি দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ। আমাদের প্রশ্ন হলো, মূর্তি স্থাপনের আগে কি তিনি এমন যুক্তিতর্ক আদালতে বা জনগণের আদালত মিডিয়ায় রেখেছেন। আমরা তার কাছে জানতে চাই, কোন মহলের দাবিতে বা কাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিংবা রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন মহলের কার সাথে শলাপরামর্শ করে এত বড় একটি কাজ করা হলো?
যদি বলা হয়, দেশে তো বৃটিশ আইন চলছে, কাজেই তাদের ন্যায়বিচারের প্রতীক দেবিকে শাড়ি পরানোতে আপত্তি কেন? থেমিসকে শাড়ি পরিয়ে আপনার অন্দর মহলে বা পূজার বেদিতে রাখলে কারো আপত্তির কারণ ছিল না। কোনো বড় কবির কবিতার ভাষায় বা শব্দমালায় কারো মনমতো পরিবর্তন করা সাহিত্যের আদালতে মস্তবড় অপরাধ। আপনি যে মূর্তিশিল্পীর কল্পনা আশ্রিত থেমিসকে শাড়ি পরিয়ে বাঙালি ললনা বানালেন তা শিল্পসংস্কৃতির আদালতে নিশ্চয়ই অমার্জনীয় অপরাধ। জানি না, এই সাংস্কৃতিক বিকৃতির জন্য ইউনেস্কো কোথাও কোনো রিট করেছে কিনা।
দীর্ঘদিন থেকে একটি প্রচারণা চলে আসছে, আমাদের আইন-আদালত বৃটিশদের প্রবর্তিত এবং কোরআন ও হাদিসের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কাজেই এখানে বিচারক হওয়া, ওকালতি করা, বিচার চাওয়া হারাম, কুফরির অন্তর্ভুক্ত। অনেক আগে ‘সত্যের সাক্ষ্য’ শিরোনামের একটি বই পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে। বইটি পড়ে সরলপ্রাণ মানুষের মনে এ ধরনের মনোভাব সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কয়েক বছর আগে যারা বোমা মেরে দুজন বিচারককে হত্যা করেছিল তাদের মাথায়ও সেই চিন্তাটি উগ্রভাবে ভর করেছিল বলে অনুমান করা যায়। যারা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী বলতে চায় কিংবা যারা বৃটিশ বিচার ব্যবস্থার ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে গ্রিক দেবিকে শাড়ি পরিয়েছেন তাদের সাথে সঙ্গত কারণেই আমরা একমত নই। কেননা, আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার মূল কাঠামো ইসলামী এবং বৃটিশ আইন এখানে পরগাছা।
প্রথম তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রথম যে ভাষণটি বেতার ও টিভিতে একযোগে প্রচারিত হয়েছিল তার একটি কথা আমার এখনো মনে আছে। তার বক্তব্য ছিল মোটামুটি এরূপ : ‘বৃটিশরা এদেশ দখলের পর দেখল যে, এখানে মোঘলদের প্রবর্তিত মুসলমানদের সুন্দর বিচার কাঠামো বলবৎ আছে। ফলে দুইশ বছর বিশাল ভারতবর্ষ শাসন করলেও তারা মুসলিম আমলের বিচারব্যবস্থা ও কাঠামো বহাল রাখে। তারা এই কাঠামের মধ্যেই বৃটিশ আইন চালু করে।’
ছোটবেলায় দেখতাম, হঠাৎ কোনো ফলজ গাছের মাথায় হলুদ বর্ণের মনোলোভা রঙিন লতার ঝোপ। মনে হতো কোথাও থেকে এই লতাগুল্ম উড়ে এসে গাছতরুণীর মাথায় টোপর হয়ে বসে আছে। আমাকে কৌত‚হলী দেখে এক মুরব্বি বলেছিলেন, এগুলোর শিকড় নেই, মাটির সাথে যোগাযোগ নেই। দেখতে মনকাড়া হলেও অল্প দিনেই এই গাছটি মাথার দিক থেকে খেয়ে শেষ করবে। তারপর চলে যাবে। হ্যাঁ, পরগাছা বৃটিশ আইন মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক বিচার ব্যবস্থাকে এমনভাবে খেয়ে ফোকলা বানিয়েছে, যার ফলে আজকের অ্যাটর্নি জেনারেলও বৃটিশ আইনের ঐতিহ্য আমদানির দোহাই দিয়ে গ্রিক দেবির পক্ষে সাফাই গাইছেন।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান উদাহরণ হিসেবে মোঘল ঐতিহ্যের স্মারক দেওয়ানি আদালত ও ফৌজদারি আদালতের ন্যায় আরো কিছু বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। তার কথার প্রমাণ এখনো আমাদের বিচার বিভাগে বিদ্যমান। ইসলামী বিচার ব্যবস্থার ঐতিহ্যবাহী প্রচুর ফারসি শব্দসম্ভার এখনো আমাদের বিচার ব্যবস্থায় প্রচলিত। যেমন দেওয়ানি ও ফৌজদারি, এজলাস, হুকুম, নাম, জারি, নামজারি, জনাব, হুজুর, আইন, গ্রেফতার, কানুন, হক, হকশফি, আদালত, মুনসেফ, হাকিম, উকিল, মুখতার, মুহুরি, পেশকার, কানুনগো, মোহাফেযখানা, আসল, নকল, নকল নবিস, রায়, হুকুম, ফায়সালা, ইনসাফ, আর্জি, সুরতহাল, ওকালতনামা, সেরেশতাদার, দলিল দস্তাবেজ, সরেজমিন প্রভৃতি আরো অনেক শব্দ।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থা বলতে কি বুঝায় বা আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে কীভাবে ইসলামীকরণ করা যায় সে সম্পর্কে দুটি কথা বলতে চাই। ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় পাঁচটি দন্ডবিধি আল্লাহ ও তার প্রিয়নবীর পক্ষ হতে চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত। এগুলোতে কোনোরূপ রদবদল বা হেরফের করার অধিকার কারো নেই। সেগুলো হচ্ছে, কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যা কিংবা অনুরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ। চুরির শাস্তি বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কাটা যাওয়া। জেনা-ব্যভিচারের শাস্তি একশ ঘা দোররা বা বিবাহিত ব্যভিচারীর ক্ষেত্রে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ড। মদ্যপানের শাস্তি বেত্রাঘাত ও কোনো সতিসাধ্বি নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপের কঠিন শাস্তি আশিঘা বেত্রাঘাত।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন