মোস্তফা আনোয়ার খান : পাকিস্তানের আখ্যাত লেখক জুনায়েত আহমদের ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোজার’ বইটি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন, আলোচনা ও প্রতিবাদ জানানোর জন্য মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে পাকিস্তানী লেখক জুনায়েত আহমদের ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোজার’ বইটির প্রতিবাদ করেছেন- আমি আশা করবো ভারত থেকে প্রকাশিত ভারতীয় লেখক ডা. কালিদাস বৈদ্যের ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’ বইটিকেও তিনি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন, আলোচনা করবেন, প্রতিবাদ করবেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান কী চেয়েছিলেন এ বিষয়ে ভারতের সাহায্যে নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র পরামর্শদাতা, একান্ত আপনজন দাবিদার ডা. কালিদাস বৈদ্য তার ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’ বইয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের তৎকালীন ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি বরং পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য লে. জে. টিক্কা খানকে দিয়ে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত নি¤œ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এই সুযোগ ভারত গ্রহণ করে পাকিস্তান ভাঙ্গার সর্বাত্মক কার্যক্রম গ্রহণ করে।’
একই আধিবেশনে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, মাননীয় মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদ ও একজন সংসদ সদস্য এ বিষয়ে আপনার আলোচনার জন্য আপনার নিকট যে প্রস্তাব দিয়েছেন যা মার্চ মাসের যে কোন দিন আলোচনা হবে বলে আপনি সংসদে বলেছেন, সে দিন ভারত থেকে প্রকাশিত ভারতীয় লেখক ডা. কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’ নিয়েও আলোচনা হবে বলে আমি আশা করি। বইটিতে ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেয়া আজকের মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদেরও বিবরণ আছে। বইটিতে অনেক স্পর্শকাতর বক্ত্যব আছে, যা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। আর সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, রাজনীতিতে আরো অস্থিরতা বাড়াতে পারে। ইদানীং এড়ড়মষব ও সঁষফযধৎধনফ.পড়স সহ ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যমের বদৌলতে ব্যাপকভাবে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পরায় আজ বইটি আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বয়ান হিসেবে আলোচিত হচ্ছে, যা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে পারে এবং রাজনীতিতে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এই আশঙ্কায় আমাদের উৎক্ষণ্ঠিত হওয়াই স্বাভাবিক।
কালিদাস বৈদ্যের বইটির ভূমিকা লিখেছেন পবিত্র কুমার ঘোষ, যিনি সাংবাদিক ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত “দৈনিক বর্তমান” এর উপদেষ্টা। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “দেশ ভাগের সময় কালিদাস ছিলেন ছাত্র, অন্যদের সঙ্গে কোলকাতায় চলেও এসেছিলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন ঢাকায়, পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়ার ব্রত নিয়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাস করেন, ঢাকাতেই ডাক্তারি প্রাকটিস শুরু করে ভালো পয়সা জমিয়ে ফেলেন। কিন্তু তিনি মেডিকেল কলেজে ছাত্র থাকার সময় ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় গড়ে ওঠে তখন থেকেই।”
অন্যদিকে ‘লেখকের কথা’ অংশে কালিদাস বৈদ্য লিখেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করে মুজিবের স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ ও যুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারসহ নেতাদের আচরণ দেখে, আমরা বুঝেছিলাম, আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ। তাই যুদ্ধ শেষ হবার আগেই আমরা চৌদ্দজন হিন্দু নেতা একত্রে বসে নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। পরে খধি ঈড়হঃরহঁধঃরড়হ ড়ৎফবৎ ড়ভ ১৯৭১ জারি করে মুজিব বুঝিয়ে দিলেন যে তার সরকার পাকিস্তানের ঝঁপপবংংড়ৎ সরকার। তাতে সেখানে ইসলামিক জাতীয়তাবাদ স্বীকৃতি পেল। মুছে গেল বাঙালি মুক্তিযুুদ্ধের ইতিহাস।”
বইটিতে মুসলমানদের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিষয়ে ধারণা দিতে গিয়ে কালিদাস বৈদ্য লিখেছেন, “শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের অনীহার কারণও ইসলামের শিক্ষা। শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত এবং মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে সম্পদ সৃষ্টিতে কোনো প্রেরণা যোগায় না। ইসলামের শিক্ষা হল জেহাদ করে পরের সম্পদ ঘরে আনতে হবে। চুরি, ডাকাতিতেই ইসলামের প্রেরণা। ইসলামি মতে ইসলাম হল শ্রেষ্ঠ পথ। এই পথের পথিক বলে একজন মুসলমান পাহাড় প্রমাণ পাপ করলেও সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা পাবে। পরলোকে জান্নাত-স্বর্গবাসী হবে।”
সূরা তওবার ৫নং, সূরা নিসার ৮৯ নং আয়াত, সূরা আনফালের ৩৯নং আয়াত, সূরা মোহাম্মদ-এর ৪নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে তিনি আরো লিখেছেন যে, ’৭১ সালে এদেশের মুসলমানরা আল্লাহর হুকুম হিসাবে এই আয়াতগুলো তামিল করতে গিয়ে ত্রিশ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করেছে, হিন্দুদের বাড়িঘর লুন্ঠনের পর তা জ্বালিয়ে দিয়েছে। হিন্দু নারীদের নির্যাতনের পর ধর্ষণ করেছে।
শালীনতার সকল সীমা লংঘন করে ডা. কালিদাস বৈদ্যের তার বই “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব”-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অ¯্রাব্য ভাষায় তিরস্কারও করেছেন ১৪২-১৪৩ পৃষ্ঠায়।
আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশে কোন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেই। বাবু ডা. কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’-এ যাই লেখা থাকুক এদেশের কোন হিন্দু তার সাথে একমত নয়। সকল বিচারে তারা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
বাংলাদেশ মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ সকলের। ডা. কালিদাস বৈদ্য তার বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’-এ যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত স্পর্শকাতার। এ বিষয়ে হিন্দু নেতাদের কথা বলা দরকার। আমরা চাই বইটি বাজেয়াপ্ত করা হোক।
লেখক: সমাজ বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন