শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিনিয়োগের বাধা দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আগামী ১৫ বছরে একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বিনিয়োগ অগ্রগতি (প্রমোশন)’ শীর্ষক সেমিনারে এ তথ্য দেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে পবন চৌধুরী বলেন, একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পর শুধু এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানই সৃষ্টি হবে না, বছরে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যও রফতানি হবে। এটি  আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। এতে সরকারের ভিশন-২০২১ এবং উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন ২০৪১-এর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। কেন বাংলাদেশে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে চান না, এর উত্তরে তিনি বলেন, আমরা বিনিয়োগ পাওয়ার পরিবেশ এখনও সৃষ্টি করতে পারিনি। এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক থাকতে হবে। বেজা সেটা পেরেছে। আর তার ফলেই আমাদের এই সাফল্য। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বিদেশি বিনিয়োগ না আসার কারণ সম্পর্কে শুধুমাত্র লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের অভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এর পেছনে যে আরো অনেক কারণ ক্রিয়াশীল রয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি। অন্তত পত্রপত্রিকার পাতায় সেগুলো আসেনি। তবে ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা বিনিয়োগ না আসার অনেকগুলো অর্থনৈতিক কারণ উল্লেখ করেছেন। বেসরকারি প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ, তারা স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এখনও স্থবির। তাদের মতে, বিনিয়োগের প্রধান বাধা হলো অস্থির রাজস্ব নীতি। এছাড়া সমস্যা রয়েছে জমির প্রাপ্যতা নিয়ে। আরো রয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও উন্নত যোগাযোগ সমস্যা। এসব অভাব আজকের নয়, বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যা চলে আসছে। তারা বলেন, ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করতে হবে, সরকার পরিবর্তন হলেও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে কোনো পরিবর্তন হবে না। এছাড়া বিদ্যমান যেসব আইন ও বিধির সঙ্গে ব্যবসা পরিবেশের অসামঞ্জস্য আছে, সেগুলো সংশোধন করতে হবে। একই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হলেই বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবেন।
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে জাপান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (জেডিআই) নির্বাহী পরিচালক সোয়িচি কোবায়েশি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি সারাদেশে একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছেন। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এতগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কিভাবে হবে। এখানে জমি অধিগ্রহণ অত্যন্ত জটিল কাজ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ দেয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা যাতে একই ছাদের নিচে সব সেবা (ওয়ান স্টপ সার্ভিস) পান, সেটি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। বিনিয়োগ না আসার কারণ সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিরা অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে কারণ সেটি তারা উল্লেখ করেননি। দেশি হোক বা বিদেশি হোক, বিনিয়োগের প্রধান পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এদেশে বিনিয়োগ না হওয়ার এটিই ছিল প্রধান কারণ। দেশে যে সরকারই থাকুক না কেন রাজনৈতিক অঙ্গন সবসময়ই অশান্ত ছিল। বিরোধী দলের পদচারণায় সারাদেশের রাজপথ এবং জনপদ মুখরিত থাকত। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক অঙ্গন সহিংস হয়ে উঠত। এসব কারণে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হয়তো প্রত্যাশিত বিনিয়োগ হয়নি। কিন্তু তার পর থেকে বিগত প্রায় তিন বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তাহলে এই আড়াই বা তিন বছরেও প্রত্যাশিত বিনিয়োগ হলো না কেন? বিদেশিরা পুঁজি নিয়ে এগিয়ে আসছে না। দেশের মধ্যে যারা পুঁজি লগ্নি করার সামর্থ্য রাখেন তারাও এগিয়ে আসছেন না। বরং বিপুল বিনিয়োগে সক্ষম অনেক উদ্যোক্তা এখন বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী। বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের জন্য তারা ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ, বিনিয়োগের সুযোগ- সুবিধা ইত্যাদি যাচাই করা শুরু করেছেন। বাংলাদেশ থেকে বাইরে পুঁজি স্থানান্তরের জন্য কেউ কেউ বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন, এমন কথাও শোনা যায়। আরেকটি বিষয় জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনার দাবি রাখে। দেশের ব্যাংকগুলোতে লক্ষাধিক কোটি টাকার নগদ অর্থ বা লিকুইডিটি অলস অবস্থায় পড়ে আছে। মানুষ, বিশেষ করে উদ্যোক্তারা, শত শত কোটি টাকা বা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ফেলে রেখেছেন। অথচ এই বিপুল অংকের অর্থ তারা বিনিয়োগ করায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সরকার একদিকে প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়িয়ে চলেছে, কিন্তু অন্যদিকে গত ৮ মাসের  রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি বড় প্যারাডক্স। বিনিয়োগ ক্ষেত্রে এমন নেতিবাচক অবস্থার পটভূমিতে সরকার ভ্যাট হিসেবে ১৫ শতাংশ বা তারও ঊর্ধ্বে আরোপিত কর আদায় করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।  
যে মুহূর্তে উন্নয়নের জয়গান গাওয়া হচ্ছে সেই মুহূর্তে অর্থনীতির প্রধান দু’টি খাতে দু’টি নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করে যাচ্ছে। ফরেন রেমিট্যান্স বা বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা দেশে যে টাকা পাঠান সেই অর্থ প্রেরণের পরিমাণ এবং রফতানি আয় কমে যাচ্ছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা যেমন মন্থর হয়ে পড়বে অন্যদিকে বিনিয়োগের সম্ভাবনা যেটুকু আছে সেটুকুও অপসৃত হবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একদিকে যে কোনো মূল্যে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে হবে, অন্যদিকে বাংলাদেশ যে বিনিয়োগের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান, এই বিষয়টি দেশি ও বিদেশিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। পাশাপাশি এটি খেয়াল রাখতে হবে যে, আগামীতে নির্বাচন উপলক্ষে যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হবে সে তৎপরতায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন বিনষ্ট না হয় এবং অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়।    

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন