প্রভাবশালীরা বেড পেলেও অসুস্থরা পায় না
হাসান-উজ-জামান : কেদ্রীয়সহ দেশের ৬৮টি কারা হাসপাতালের ১১৭টি পদের বিপরীতে ডাক্তার আছে মাত্র ৭ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ জন, কাশিমপুরে ২, সিলেট ও চট্টগ্রামে একজন করে ডাক্তার আছেন। দেশের বাকি কারা হাসপাতালে অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসা চলে জেলা সিভিল সার্জনের করুণার ওপর। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, বিষয়টি সরকারকে একাধিকবার অবহিত করার পরেও কোনো সুরাহা হয়নি। হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের শূন্য পদ পূরণে সরকারের দেয়া প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়িত হয়নি। জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, কারাগারে ডাক্তারের সঙ্কট পুরনো সমস্যা। কারাগারে ডাক্তারদেরকে পোস্টিং দিলেও কেউ থাকতে চায় না। এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কীভাবে এ সঙ্কট সমাধান করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বন্দিদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য কেন্দ্রীয়সহ দেশের প্রতিটি জেলা কারাগারে একটি করে হাসপাতাল নির্মাণ করেছে সরকার। এর মধ্যে কাশিমপুর কারাগারে ২শ’ শয্যাবিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। দেশের এসব কারা হাসপাতালে বেড, ওষুধ, যন্ত্রপাতিসহ চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু নেই শুধু চিকিৎসক। যে কারণে গুরুতর অসুস্থ বন্দিদের পাঠানো হয় বাইরের হাসপাতালে। অনেক সময় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে বন্দিকে বাইরের হাপাতালে পাঠাতে বিলম্বের কারণে অনেকের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কারা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গড়ে ৮ হাজারেরও বেশি বন্দির বিপরীতে ডাক্তার আছেন মাত্র একজন। কারাগারে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরাসহ মানসিক রোগীও আছে। কিন্তু একই চিকিৎসক সব ধরনের রোগীর ব্যবস্থাপত্র দেন।
সহকারি কারা মহা-পরিদর্শক (প্রশাসন) মোঃ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কারা হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কটের বিষয়টি সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। এ সঙ্কট নিরসনে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী অতি দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলকোড অনুযায়ী দেশের কারাগারগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী কারা অধিদফতর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ডাক্তারের চাহিদা জানায়। অতঃপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রেষণে নির্দিষ্ট সংখ্যক ডাক্তার কারাগারে নিয়োগ করে। কিন্তু কারাগারে পোস্টিং নিতে অগ্রহী নয় চিকিৎসকরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে যে ডাক্তার নিয়োগ করা হয় তারা সবাই বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ করে কারাগারের জেল সুপার। যারা বিসিএস কর্মকর্তা নন। কারা হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রয়েছে এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। যে কারণে দিন দিন কারাগারে ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সরাসরি চিকিৎসক নিয়োগ হলে এ ধরনের জটিলতা নিরসন ঘটবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, চিকিৎসক থাকা সাতটি বাদে বাকি সব কারাগারগুলোতে বন্দিদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন স্বাস্থ্য সহকারী ও নার্সরা। অধিকাংশ জেলা কারাগারে বন্দিরা এসব নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারীদের ডাক্তার হিসেবেই জানেন। যারা হাতে গোনা কয়েকটি সাধারণ রোগ ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা দিতে পারেন না। জেলা কারাগারগুলোতে থাকা ফার্মেসিতে ওষুধ পাওয়া যায় না। অভিযোগ রয়েছে, কারা হাসপাতালের অসাধু ডাক্তার ও নার্সরা কৌশলে বাইরে ওষুধ বিক্রি করেন।
এর পরেও প্রভাবশালী বন্দিরা মনে করেন, কারা সেলে থাকার চেয়ে কারা হাসপাতালে থাকা অনেক স্বস্তিদায়ক। তারা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে রোগী সেজে হাসপাতালের বেড বরাদ্দ নেন। আর প্রকৃত অসুস্থ সাধারণ বন্দিরা থাকেন হাসপাতালের ফ্লোরে। কারা চৌকায় রান্না খাবারের বড় অংশটাই চলে যায় সাজানো রোগীর কাছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিদর্শনকালে সাজানো রোগীরা হারিয়ে যান জেলের এখানে সেখানে। আর বেডে থাকেন অসুস্থ রোগী। যে কারণে পরিদর্শনকারীরা বুঝতেই পারেন না প্রকৃত সত্য।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কারা হাসপাতালের সবচেয়ে বড় অনিয়ম হলো ডাক্তারদের রোগী দেখার অনীহা, মারমুখী ও ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব। অনেক সময় রোগীর কথা ভালো করে না শুনেই ওষুধ লিখে দেন। সময়োচিত পদক্ষেপ না নেয়ায় কারা হাসপাতালে থেকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে বাইরের হাসপাতালে রোগী পাঠানো হয়। এতে অনেক রোগী মারা গেছেন।
এদিকে কারাগারে মানসিক রোগী থাকলেও এ বিষয়ে একজনও বিশেজ্ঞ চিকিৎসক নেই। কারা সপ্তাহ ২০১৭ উদযাপন উপলক্ষে এক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দিন জানিয়েছেন, সারাদেশে কারাগারগুলোতে পাঁচশ’র বেশি মানসিক রোগী বন্দি রয়েছে। কিন্তু তাদের সুচিকিৎসার জন্য নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। মানসিক রোগে আক্রান্ত কারা বন্দিদের বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পাবনা মানসিক হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।
গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল কেরানীগঞ্জের কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৪শ’জনের মতো। এর মধ্যে ২৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে সেখানের কারা হাসপাতালে কতজন রোগী রয়েছেন তা নিশ্চিত হতে কারা চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ঊর্ধ্বতন কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রতিটি কারাগারে অন্তত ১জন করে হলেও ৬৮ জন চিকিৎসক থাকা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন