মুনশী আবদুল মাননান : বিএনপি ২০০১ সালে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং আমেরিকার যোগসাজশে ক্ষমতায় এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দুটি সভায় এ মন্তব্য করেছেন। দ্বিতীয়বার তিনি এ মন্তব্য করেছেন মাগুরায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায়। প্রথমবার করেন যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে। সেখানে তিনি আরো বলেন, ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারাতে র ও যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়েছিল। তখন র-এর প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোক বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় হাওয়া ভবনে বসে থাকতেন।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট, ঋজু ও দ্ব্যর্থহীন। সঙ্গতকারণেই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। তার মন্তব্যে দুটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। প্রথমত, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোক যোগসাজশ করে বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল। দ্বিতীয়ত, তারা আওয়ামী লীগকে হারাতে একজোট হয়েছিল। এ কথা সত্য হলে, একে একটি ভয়ংকর ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এদেশে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল আসবে না তা নির্ধারণ করার মালিক দেশের জনগণ। এটা নির্ধারণ করার পদ্ধতি হলোÑ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই গণরায় সংগৃহীত হয়। গণরায় যে দলের পক্ষে যাবে সে দল ক্ষমতাসীন হবে। যে দলের পক্ষে যাবে না সে দল ক্ষমতার বাইরে থাকবে, বিরোধী দলে থাকবে। ২০০১ সালের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল, দেশের মানুষ সেটাই জানে। নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সন্তুষ্ট ছিল, কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ওই তরফে পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হলে বলতেই হবে, সেদিন দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা দেখেছিল, জেনেছিল সেই দেখা ও জানা সম্পূর্ণ ছিল না। এও অবশ্য উল্লেখ করা দরকার, ২০০১ সালের নির্বাচনে র ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোকেরা যে যোগসাজশ করে একটি দলকে ক্ষমতায় এনেছিল। অন্য দলকে হারিয়ে দিয়েছিল সে কথা আওয়ামী লীগের তরফে তখন বলা হয়নি। অন্য কোনো তরফ থেকেও জানা যায়নি। কেন এতদিন পরে সেই গোপন কথা প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী আগামী মাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সফরে ভারতে যাবেন। এ সফর উপলক্ষে নয়া দিল্লিতে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। তার এ সফর কালে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কয়েক ডজন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে জানা গেছে। এমন একটি সময়ে তিনি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোকদের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযোগ এত স্পষ্ট ভাষায় করলেন কেন, তা তিনিই ভালো জানেন এবং বলতে পারবেন।
ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে হৃদ্যতাপূর্ণ। দুই দেশের তরফেই দাবি করা হয়, এ সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ও অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয়, তাহলে ওই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সম্পর্কের সমূহ অবনতির ঝুঁকি নিয়েও প্রধানমন্ত্রী তার অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন। অভিযোগ র ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোকদের সম্পর্কে উত্থাপিত হলেও মূলত দেশ দুটির বিরুদ্ধেই উত্থাপিত হয়েছে। কারণ র ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোকেরা যা কিছুই করুক, দেশ দুটির পক্ষ থেকে এবং সুনির্দিষ্ট নীতিনির্দেশ মোতাবেকই করেছে। তাদের স্বাধীনভাবে কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া বা কাজ করার কোনো সুযোগ বা এখতিয়ার নেই। ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী দেশ। আর যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ। এই দুটি প্রভাবশালী দেশের বিরুদ্ধে খোলাখুলি ওই ধরনের অভিযোগ করা একদিকে দুঃসাহসের পরিচায়ক, অন্যদিকে তাদের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কাও এতে বিদ্যমান।
এটা স্বাভাবিকভাবেই স্বীকার করে নিতে হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ভিত্তিহীন অভিযোগ করেননি। নিশ্চয়ই অভিযোগের পক্ষে যথোপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ তার কাছে আছে। ধারণা করা গিয়েছিল, এত বড় একটি অভিযোগের পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে। যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে তা তাদের ভাবমর্যাদার জন্য মোটেই অনুক‚ল নয়। একটা বড় রকমের দোষারোপ তাদের প্রতি করা হয়েছে। অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ, বলে একটি কথা আছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ চুপ থাকা থেকে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যে অভিযোগ এনেছেন তা ভিত্তিহীন নয়। আর ভিত্তিহীন যদি না হয়, তাহলে আমাদের দেশের জন্য, জাতির জন্য সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে স্বীকার হয়, আমাদের দেশে কে বা কোন দল ক্ষমতায় যাবে আর কোন দল যাবে না, তা নির্ধারণ ও নির্দেশ করার ক্ষমতা জনগণের হাতে নেই, তা চলে গেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহিঃশক্তির হাতে। এও একই সঙ্গে স্বীকার করে নিতে হয়, দেশের রাজনীতির ওপর বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রক ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি ভয়ংকর আশঙ্কার কথা। যে কোনো দেশের পরিচালন-ক্ষমতা রাজনীতির ওপর ন্যস্ত। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ পরিচালনা করে। এ কথা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে যেমন সত্য ও বাস্তব, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। কোনো কোনো দেশে কখনো কখনো এর কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় বা ব্যতিক্রম ঘটে থাকে; তবে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির কাছেই ফিরে আসতে হয়। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি ইত্যাদি সব কিছুই করে সরকার এবং সেই সরকার রাজনীতি ও জাতীয় স্বার্থবিযুক্ত হতে পারে না। সরকার বসানো ও নামানোর ক্ষমতা যদি বহিঃশক্তির হাতে চলে যায়, রাজনীতি ও সরকার যদি নিয়ন্ত্রিত হয় বহিঃশক্তির দ্বারা, তবে সেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব স্বমহিমায় বহাল থাকে না। যে কোনো মুহূর্তে সেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হরিত হতে পারে। এমন নজির বিশ্বে বিরল নয়। কীভাবে সিকিম স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ভারতভুক্ত হয়ে যায়, সে ইতিহাস অনেকেরই জানা। রাজনৈতিক দলসমূহ, যারা ঘুরেফিরে ক্ষমতাসীন হয়, সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনা করে, তারা যদি বহিঃশক্তির অঙ্গুলি হেলনে চলে, তার বা তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাহলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ নিরাপদ হতে বা থাকতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য বা অভিযোগের ব্যাপারে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র নীরব থাকলেও বিএনপি নেতারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বিএনপি বহিঃশক্তির সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছিল। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন হয়েছিল এবং নির্বাচন ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। তাদের মতে, ভিত্তি, সত্যতা ও প্রমাণ ছাড়া কোনো বিবৃতি কেউ দিয়ে থাকলে তাকেই তা প্রমাণ করতে হবে। তারা প্রশ্নও তুলেছেন, তাহলে পরেরবার তিনি বা তার দল আওয়ামী লীগ কি কোনো মুচলেকা বা কিছু দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন? বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারেক শামসুর রেহমান এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় গেয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে বিএনপিকে ২০০১ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেÑ এ রকম কোনো খবর আমাদের কাছে নেই। তবে এটা ঠিক, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেন তখন বুঝতে হবে তার কাছে এ বিষয়ে অকাঠ্য তথ্য প্রমাণ রয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ‘র’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একত্রিত হয়ে যদি প্রভাব খাটিয়ে একটি দলকে ক্ষমতায় বসায় তাহলে তা নিঃসন্দেহে খারাপ দৃষ্টান্ত। এ ঘটনা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।’
২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়। বিএনপিসহ কোনো কোনো মহলে নির্বাচন নিয়ে কিছু কিছু প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করা হলেও তা সর্বমহলে গ্রাহ্যতা পায়নি। সামগ্রিক বিবেচনায় ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বহিঃশক্তির প্রভাবের কথাও শোনা যায়নি। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচন সম্পর্কে এ দাবি করা যাবে না যে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিংবা তাতে বহিঃশক্তি কোনোরূপ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেনি। সংক্ষেপে বলা যায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি সরকার না মানায় তারা নির্বাচন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয়। এ অবস্থায় নির্বাচন না হওয়ার বা উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন যাতে সরকার নির্ধারিত তারিখেই হয় সে জন্য ভারত সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে নির্বাচনের পক্ষে তৎপরতা চালান এবং এইচ এম এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টিকে রাজি করাতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন। এসব কথা দেশ-বিদেশের মানুষের অজানা নেই। তারা এও জানে, ভোট গ্রহণের আগে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে যান। নির্বাচনের দিন যেসব আসনে ভোট হয়, সেসব আসনে ভোট পড়ে স্বল্পসংখ্যক। বলা যায়, ভোটারবিহীন, ভোটবিহীনভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচনটির দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ার কারণ, তা না ছিল অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশ ওই নির্বাচন সমর্থন করেনি, গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করে নেয়নি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বহিঃশক্তির প্রভাব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তা পাওয়া গেছে। কেউ যদি প্রশ্ন করে, ভারতের সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতার পেছনে কোনো লেনদেনের সম্পর্ক ছিল কি? এ প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নেই। তবে আমরা লক্ষ্য করেছি, মহাজোট ও বর্তমান সরকারের আমলে ভারতের যা কিছু চাওয়া ও প্রত্যাশা ছিল তার প্রায় সবকিছু সে পেয়ে গেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতবাদীদের’ দমনে সহযোগিতা, তথাকথিত ট্রানজিটের নামে করিডোর, সমুদ্র বন্দর ব্যবহার সুবিধা ইত্যাদি ভারত পেয়েছে। সব শেষ তার চাওয়া ছিল দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি। সেটা হওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়। দেশের সর্ব মহলে ওই চুক্তির ব্যাপারে বিরোধিতা জোরদার হওয়ায় জানা গেছে, চুক্তি নয় হবে সমঝোতা স্মারক। অথচ বাংলাদেশ এই সময়ে ভারতের কাছ থেকে তার চাওয়ার কিছুই পায়নি। তিস্তাচুক্তি হয়নি, হচ্ছে না। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হয়নি। অভিন্ন অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনে কোনো খবর নেই। বাণিজ্য অসমতা দূর হওয়া তো দূরের কথা, আরো বেড়েছে।
বাস্তবতার এই প্রেক্ষাপটের র বা ভারতের প্রতি অভিযোগপূর্ণ মন্তব্যটি প্রধানমন্ত্রী কেন করলেন তা খুঁজে বের করতে পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকগণ গলদঘর্ম হচ্ছেন। কারো কারো ধারণা, দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলে বহিঃশক্তির প্রভাব বা ভূমিকা সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা ও তার সপক্ষে তথ্য প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে মজুদ আছে। ভবিষ্যতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যাতে কোনরূপ যোগসাজশ করে অন্য কোনো দল বা পক্ষকে ক্ষমতায় আনতে সক্রিয় হয়ে না ওঠে, সে জন্য তিনি তাদের অতীত ফাঁস করে দিয়েছেন, সতর্ক করে দিয়েছেন। অনেকে আবার মনে করেন, ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে শুরুতে যে ধরনের টানাপোড়ান ছিল, তা কাটিয়ে উঠতে হয়তো তিনি এ অভিযোগ এনেছেন। বিজেপিকে বার্তা দিতে চেয়েছেন, ২০০১ সালের মতো ভুল যেন বিজেপি ও ভারত না করে। এই শেষোক্ত অভিমত ভারতীয় বিশ্লেষক সুবির ভৌমিকের। তার এ মত সম্পর্কে অন্য অনেকের দ্বিমত রয়েছে। তাদের বক্তব্য, অতীতের কংগ্রেস সরকারের চেয়ে বর্তমান বিজেপি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক অনেক গভীর। এ ব্যাপারে তাকে বার্তা দেয়ার কিছু নেই। তারা বরং মনে করছেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের ভূমিকা ও অবস্থানকে জোরদার করতে পারে। তারা একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করছে এবং এদেশে তাদের কূটনীতিকরা ইতোমধ্যে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠছেন। তাদেরকেই মূলত বার্তা দেয়া হয়েছে। ভারতের মনোভাব থেকেও এটা বুঝা যায়। এতবড় একটা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হলে তার মধ্যে কোনো বিকার বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। উল্টো বরং নয়া দিল্লীতে শেখ হাসিনাকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা ও আতিথেয়তা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
কোনো দেশের রাজনীতিতে বহিঃশক্তির প্রভাব বা হস্তক্ষেপপ্রবণতা সেই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ। বহিঃশক্তির প্রভাবাধীন ক্ষমতাসীনরা কখনোই জাতীয় স্বার্থের পক্ষে সঠিক, ন্যায্য ও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœœ ও ব্যাহত হয়। প্রধানমন্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন, তার সূত্র ধরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। ক্ষমতার লোভে কোন বহিঃশক্তির সঙ্গে গাটছাড়া বাঁধা বা মুচলেকা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনীতিকে একটি সার্বভৌম সত্তায় পরিণত করতে হবে। ক্ষমতার জন্য বহিঃশক্তির নয়, জনগণের রায়ের ওপর ভরসা স্থাপন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন