প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন : চট্টগ্রাম ওয়াসা একটি আধা সরকারি এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীদের সেবায় ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাাম ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত চট্টগ্রাাম ওয়াসা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। নগরবাসীকে নিরবিচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ করা এবং উন্নত মানের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করাটাই ওয়াসার প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তার জনবল নিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সর্বদা তারা নগরবাসীর সেবায় নিয়োজিত। পানি ছাড়া মানব জীবন যেখানে প্রতি মুহুর্তেই অচল, সেখানে ঘরে ঘরে পানি পৌঁছিয়ে দিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নগরবাসীর জীবনকে প্রতিনিয়তই রেখেছে সচল। একই ভাবে পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থাকে সচল রাখার মাধ্যমে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ শহরের পরিবেশ রেখেছে নোংরা এবং দুর্গন্ধ মুক্ত, একই সাথে বসবাসের উপযুক্ত। সুতরাং নগরবাসীর জীবন ধারণে এবং জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনায় ওয়াসার ভূমিকা অপরিসীম। তাই ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা নগরবাসীরা কৃতজ্ঞ।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি মিশন এবং ভিশন থাকে। চট্টগ্রাাম ওয়াসারও আছে। চট্টগ্রাাম ওয়াসার ভিশন হচ্ছে- বাংলাদেশের মধ্যে দক্ষতম পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্র্তৃপক্ষ হওয়া। আর মিশন হচ্ছে- গুণগত মান সম্পন্ন পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন সেবা নি¤œতম খরচে পরিবেশ বান্ধব উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রদান। আর চট্টগ্রাাম ওয়াসার শ্লোগান হচ্ছে- দেশপ্রেমের শপথ নিন , দুর্নীতিকে বিদায় দিন। চট্টগ্রাাম ওয়াসার ভিশন, মিশন এবং শ্লোগান সবই যুগোপযোগী এবং বাস্তবতায় সমৃদ্ধ। আমরা আশা করব, চট্টগ্রাাম ওয়াসা তার ভিশন, মিশন এবং শ্লোগানের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে এবং নগরবাসীকে উৎকৃষ্ট সেবা প্রদানে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ থাকবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার সেবায় জনগণ কৃতজ্ঞ হলেও, সাম্প্রতিককালে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের পানি বরাদ্দ এবং পানির মুল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত নতুন ঘোষণায় জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের অভিযোগ, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পরিবার প্রতি অতিরিক্ত পানি বরাদ্দ করেছে এবং সেই বরাদ্দকৃত পানির ওপর মূল্য নির্ধারণ করেছে। আবার পানির মূল্যও বৃদ্ধি করেছে। ফলে অটোমেটিক্যালি পানির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। যার ফলে জনগণ কষ্ট পাচ্ছে। স¤প্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সরবরাহের একটি বৃহত্তর প্রকল্প অপারেশানে আসার পর বাসা-বাড়িতে সরবরাহকৃত পানির উপর নতুন মূল্য নির্ধারণ করেছে। বিগত বহু বৎসর যাবত চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির মুল্য একই ছিল। অথচ নিত্য ব্যবহারের পন্য সহ সকল জিনিসের মুল্য ইতিমধ্যে পাল্লা দিয়ে বহুগুণে বর্ধিত হলেও ওয়াসার পানির মূল্য স্থির ছিল। সংগত কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির মূল্যও দীর্ঘদিন পর বর্ধিত করে পুনঃ নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত। যেমন পূর্বের ১ কিউবিক লিটার (কি.লি.) পানির নির্ধারিত মূল্য ৫.১৫ টাকার স্থলে বর্তমানে ১ কি.লি. পানির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৬১ টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে যা সহনশীল পর্যায়ে আছে। এমনকি উক্ত মূল্য ১০০% বর্ধিত করলেও সহনশীল মর্মে গণ্য করা যেত।
কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে অন্য জায়গায়, আর সেটা হচ্ছে পরিবার প্রতি বরাদ্দকৃত পানির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি নির্ধারণ। চট্টগ্রাম ওয়াসা স¤প্রতি পরিবার প্রতি দৈনিক সর্বনি¤œ যে পরিমাণ পানির ব্যবহার নির্ধারণ করেছে বোধ করি পৃথিবীর সর্বোন্নত দেশগুলিতেও তার নজির বিরল। পূর্বে প্রতি পরিবারের মাসিক পানির সর্ব নি¤œ ব্যবহারের পরিমাণ নির্ধারিত ছিল ২০.৪৩ কি.লি. (বা ২০,৪৩০ লিটার)। বর্তমানে তা বর্ধিত করে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৮.১০ কি.লি. (বা ৬৮,১০০ লিটার)। অর্থাৎ বর্তমানে অতীত হতে ২৩৩ শতাংশ বেশি ব্যবহার হয় মর্মে ধরা হয়েছে যা কোন হিসাবেই মেলানো যায় না। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি ব্যবহারকারী অধিকাংশ পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৬ সদস্যের নীচে। তবুও সকল পরিবারকেই ৬ সদস্যের পরিবার হিসাবে ধরা হলে পূর্বের নির্ধারিত পরিমাণ (২০,৪৩০ লিটার) পানিতে দৈনিক মাথাপিছু ১১৩.৫ লিটার তথা ৬ সদস্যের পরিবারে দৈনিক ৬৮১ লিটার খরচ হয় মর্মে ধরা হয়েছে। এদিকে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ নি¤œবৃত্ত ও মধ্যবৃত্ত পরিবার।
মানুষ সাধারণত প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি পানি ব্যবহার করে না। তাই মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত হওয়ার ফলে খুবই নগণ্য পরিমাণে মানুষের পানি ব্যবহার বৃদ্ধি পায় যা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কারণ পানি কোন বিলাসী পণ্য নয় বরং এটি হচ্ছে অতি মাত্রায় প্রয়োজনীয়। এ অবস্থায় পানির প্রয়োজনীয় ব্যবহারের পরিমাণ এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় না এনে চট্টগ্রাাম ওয়াসা পানির ব্যবহার ২৩৩ শতাংশ বর্ধিত করে নিয়ম জারী করেছে। ফলে অটোমেটিক্যালি পানির মূল্য ও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পরিশোধ করতে গিয়ে অধিকাংশ নগরবাসীই হাপিয়ে ওঠেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশে¡র অধিকাংশ দেশের সহিত তুলনা করলে পরিবার প্রতি পূর্বের নির্ধারিত সর্বনি¤œ ব্যবহার ২০.৪৩ কি.লি. (অর্থাৎ ২০,৪৩০ লিটার) একান্তই সঠিক ও বাস্তব সম্মত ছিল। এদিকে পূর্বের সর্বনি¤œ পানির বিল ১২১ টাকা হতে একলাফে ৫৯৬ (প্রায় ৬০০) টাকায় উন্নিত করা হয়েছে, যা কোন অবস্থাতেই যুক্তিসংগত মনে হয়নি। চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমান গৃহীত এই সিদ্ধান্ত তাদের ভিশন, মিশন ও শ্লোগানের সহিত সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। আর এটা বর্তমান জনকল্যাণকামী সরকারের নিয়ম-নীতির সাথেও সংগতিপূর্ণ নয়। সুতরাং চট্টগ্রাাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা এবং পানি বরাদ্দ ও পানির মূল্য বাস্তব সম্মতভাবে নির্ধারণ করা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার এই সিদ্ধান্ত জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে মাথাপিছু বা পরিবার প্রতি দৈনিক পানি ব্যবহারের হার বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং বাস্তবতা বর্জিত। এ অবস্থায় জনগণের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে পূর্ববর্তী নিয়ম অনুযায়ী পরিবার প্রতি মাসিক পানির নির্ধারিত সর্বনি¤œ ব্যবহার ২০.৪৩ কি.লি. ঠিক রেখে কি.লি. প্রতি পানির বর্ধিত মূল্য পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
ষ লেখক : আহŸায়ক, সোসাইটি ফর হিউমিনিটি, চট্টগ্রাম
মন্তব্য করুন