মোবায়েদুর রহমান
রিসেন্টলি দেশদ্রোহিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহ নিয়ে দেশে এবং বিদেশের খবরের কাগজগুলোতে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। অনেকের মতে, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ নাকি গুণগতমানের দিক দিয়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংবাদপত্র। অনেকে সার্কুলেশনের বিচারেও এটিকে ১ নম্বর সংবাদপত্র বলেন। সে যাই হোক, নিউইয়র্ক টাইমস পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্র। তারাও রাষ্ট্রদ্রোহের ওপর একটি নিবন্ধ ছেপেছে। ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘টেলিগ্রাফ’ ইদানীং ইন্ডিয়া তথা এই অঞ্চলের অত্যন্ত মর্যাদাশীল। সেই ভারতীয় টেলিগ্রাফেও এবার রাষ্ট্রদ্রোহ নিয়ে লেখা ছাপা হয়েছে। আর বাংলাদেশে তো কথা-ই নেই। রাষ্ট্রদ্রোহী, পাকিস্তানের দালাল এবং রাজাকার বানানো হচ্ছে এখন পাইকারী হারে। মুক্তিযুদ্ধা এবং ৯ নম্বরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর জলিল তো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক রাজাকার উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তারপর অনেকে এলেন মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের অধিনায়ক জেনারেল জিয়াকে পাকিস্তানের দালাল বানানো হয়েছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও আওয়ামী ঘরানা কর্তৃক নব্য রাজাকার সাব্যস্ত হয়েছেন। এরপর সিরিয়ালে এলেন বেগম জিয়া, গয়েশ^র রায় প্রমুখ, যারা পাক বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করেছেন। গয়েশ^র নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সর্বশেষ মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে। এখন শাসক গোষ্ঠীর প্রিয় অপবাদ রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তবে এবারের দেশি-বিদেশি লেখালেখির ফলে আমার একটি সুবিধা হয়েছে। সেটি হলো, রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কে কিছু জানা হলো।
বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কে এই সমস্ত লেখার পেছনে যে কারণটি কাজ করেছে সেটা হলো- ‘ডেইলি স্টারের’ এডিটর এবং অন্যতম মালিক মাহফুজ আনাম। কি কুক্ষণেই যে তিনি তার পত্রিকার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘এটিএন বাংলার’ মুন্নি সাহার কাছে একটি স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। আর যায় কোথা? সাথে সাথেই তাকে খপ করে ধরলেন আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর সিনিয়র নেতা। মাহফুজ আনাম ঐ টিভি ইন্টারভিউয়ে একটি সহজ-সরল স্বীকরোক্তি দিয়েছিলেন যে, সাংবাদিক জীবনে তার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। ১/১১ অর্থাৎ মঈনুদ্দিন ফখরুদ্দিনের সরকারের সময় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই দেয়া খবর ছাপানো। তারা নিজেরাই কিছু খবর পত্র-পত্রিকায় প্রেরণ করতো। এই ধরনের ঘটনা অতীতেও যেমন ঘটেছে আজও তেমনি ঘটছে। গত ৩/৪ দিন ধরে সরকারপন্থী টেলিভিশন ‘চ্যানেল ৭১’-এর টকশোতে যেসব আলোচক আসছেন তারা সেই ধরনের কথাই বলেছেন। মাহফুজ আনাম তথা ‘ডেইলি স্টার’ ডিজিএফআইয়ের দেয়া এই ধরনের খবর যাচাই-বাছাই ছাড়াই ছাঁপিয়েছিল। এই ধরনের খবরের মধ্যে একটি ছিল শেখ হাসিনার কথিত দুর্নীতি সম্পর্কে। মাহফুজ আনাম এটিএন বাংলার মুন্নি সাহার কাছে স্বীকার করেন যে, শেখ হাসিনার দুর্নীতি সম্পৃক্ত ঐ রিপোর্টি তিনি কোনো প্রকার যাচাই ছাড়াই প্রকাশ করেছেন। আর এটিই হয়েছে তার সুদীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
তার ঐ স্বীকরোক্তিকে কেন্দ্র করে সারাদেশে তার বিরুদ্ধে অন্তত ৭৯টি মামলা বিভিন্ন থানায় দায়ের করা হয়েছে। সবগুলো মামলাই দায়ের করা হয়েছে হয় রাষ্ট্রদ্রোহ না হয় মানহানির অভিযোগে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়েছে অন্তত ১২টি আর বাকিগুলো মানহানি সংক্রান্ত।
মাহফুজ আনামের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ ইতিপূর্বেও অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্র্র্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের কারো কারো নামে মামলা হয়েছে আবার কেউ কেউ কোনো রূপ মামলা এবং চার্জসিট ছাড়াই মাসের পর মাস জেল খাটছেন। তাদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আবার কারো বিরুদ্ধে কিছুই করা হয়নি।
ডেইলি স্টারে হিজবুত তাহরীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপা হয়েছিল। সেটা নিয়েও এক শ্রেণীর সংবাদপত্রে তোলপাড় হয়েছিল এবং সরকারপন্থী পলিটিশিয়ানরা হৈ চৈ শুরু করেছিলেন। তারও আগে অর্থাৎ বছর ৩ আগে দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বহুবার রিমান্ডে নেয়া হয়। তখন পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, তাকে পুলিশ হেফাজতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আজ ৩ বছরের বেশি হলো তিনি জেলের ঘানি টানছেন। মান্নার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। ১ বছর হয়ে গেল মান্না জেলখানার মেঝেতে জীবন কাটাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে এই ১ বছরেও কোনো লিখিত অভিযোগ আনা হয়নি বা কোনো চার্জও গঠন করা হয়নি। কিন্তু জেলের ভাত খেয়েই যাচ্ছেন। আইনে আছে, বিনা বিচারে ৩ মাসের বেশি কাউকে আটক রাখা যাবে না। কিন্তু ঐগুলো সরকার মানছে না। তাই মান্না ১ বছর হলো বিনা বিচারে বন্দি জীবনযাপন করছেন।
॥দুই॥
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক ও শাহদীন মালিক। ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছেন, মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, সেটাকে আমি খুব খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছি। ১/১১’র সময় তিনি যে খবর পেয়েছেন, সেটা ছেপেছেন। ভুল হয়ে থাকলে ভুল হয়েছে। এখন সেই ভুল স্বীকার করেছেন। এরপর আর কী? এর মধ্যে কী এমন মহা অন্যায় হয়েছে? এর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কী আছে? কীভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়? এটা আমার বুড়ো বয়সে মাথায় কুলাচ্ছে না। এটা খুব দুঃখের বিষয়। এর মানে হয় না। সাংবাদিক খবর লিখলেই রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে গেল? কেউ কিছু বললেই যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়ে যায়, তাহলে তো কিছু করা যাবে না, লেখা যাবে না। আমার মনে হয়, ডেইলি স্টার গ্রুপকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পছন্দ করছেন না। অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এর জন্য এই চাপ হতে পারে।
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, যার মানহানি হয় তাকেই মানহানির মামলা করতে হয়। মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে যে মানহানির মামলা হয়েছে, তা আইনগতভাবেই ভিত্তিহীন। আর মাহ্ফুজ আনামের বক্তব্যে কীভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ হয়েছে, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। এগুলো আসলে কাল্পনিক অভিযোগ। এর কোনো আইনিভিত্তি নেই। অতএব সম্পূর্ণ হয়রানিমূলকভাবে ও প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে এসব মামলা করা হচ্ছে। এর পেছনে রাজনীতি রয়েছে। এগুলো বাকস্বাধীনতা সীমিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না।
ফৌজদারি আইনের ১২৪/ক ধারায় বলা আছে, আইনসঙ্গতভাবে স্থাপিত কোনো সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, ঘৃণা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া অপরাধ। এখানে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে কোনো শব্দই নেই। ১/১১’র পরের সরকারের আমলের ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। মাহ্ফুজ আনাম কি ওই সরকারের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বা বলেছেন? ওই সময় তো শেখ হাসিনার সরকার ছিল না। আসলে মানুষ ভুল করতে পারে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, ভুল স্বীকার করাই মহা অন্যায়।
॥তিন॥
ফৌজদারি দ-বিধি এবং সংবিধানের যে সমস্ত ধারা এবং অনুচ্ছেদ মোতাবেক দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হচ্ছে সেগুলো হলো- ফৌজদারি আইনের ১২৩, ১২৪ এবং ৫০৫ ধারা এবং সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) অনুচ্ছেদ।
১) দ-বিধি আইনের ১২১ ধারা মোতাবেক বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেষ্টা করা দ-নীয়।
(২) দ-বিধি আইনের ১২৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারকে আইনসঙ্গতভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা দ-নীয়।
খালেদা জিয়া, মান্না বা মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেগুলো সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী করা হচ্ছে বলে প্রতিয়মান হয়।
[৭ক। (১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়-
(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে ; কিংবা
(খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে-
তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।
(২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত-
(ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা
(খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে-
তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।
(৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দ-ের মধ্যে সর্বোচ্চ দ-ে দ-িত হইবে।
৭খ। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদ সমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ সমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।]
সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ যেরূপ ঢালাওভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তেমনটি আর অতীতে কখনও দেখা যায়নি। একদিকে দেশদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং অন্যদিকে রাজাকার ও পাকিস্তানের দালাল। জেড ফোর্সের অধিনায়ক, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এবং ৬ বছর ধরে রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল জিয়া কিভাবে পাকিস্তানের অনুচর হতে পারেন? মুক্তিযুদ্ধ কালে ৯ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল কিভাবে রাজাকার হতে পারেন? বঙ্গবীর খেতাব প্রাপ্ত বাঘা সিদ্দিকী কিভাবে নব্যরাজাকার হতে পারেন? তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া কিভাবে দেশদ্রোহী হতে পারেন? ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে চাকসু এবং ডাকসু সব মিলিয়ে ৩ বারের নির্বাচিত জিএস এবং ভিপি এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী হতে পারেন? মুক্তিযুদ্ধের মুখর প্রবক্তা মাহফুজ আনাম কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী হতে পারেন? মানুষ এগুলো বিশ^াস করে না। যেমন বিশ^াস করেনি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত জেনারেল ইয়াহিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। যেমন বিশ^াস করেনি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক মওলানা ভাসানী এবং শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। চূড়ান্ত পরিণামে দেখা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে তারা সকলেই দেশ প্রেমিক হিসেবে জনগণের স্বীকৃতি লাভ করেছেন। আজ বাংলাদেশে যাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হচ্ছে আগামী কাল তারা যদি জনগণ কর্তৃক দেশপ্রেমিক বলে বরিত হন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন