শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

আওয়ামীলীগের জোয়ার আসতে লেগেছিল একুশ বছর

| প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জাহাংগীর আলম : ‘অহংকার পতনের মূল’ প্রবাদটি বেশ পুরনো। কীভাবে পতন হয়, সেটা বোঝা যায় না। তবে এই অখ্যাত নিবন্ধকারের ধারণা- অহংকারে জন্ম নেয় অন্ধত্ব। অন্ধত্ব জন্ম নেয় বলেই অহংকারী নিজকে যতটা না ততটা উঁচু ভাবে আর প্রতিপক্ষ হাতি হলেও মশা মনে করে। রাজনীতিতে এর প্রমাণ ভূরি ভূরি। একাত্তর সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরাজয় ডেকে এনেছিল তাদের অহেতুক অহংকার। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে বাংলার রাজনীতি থেকে অহংকারের কালিমা মুছে যায়নি। তাই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ বোলচাল অহম শব্দে ভরা থাকে। আর থাকে বিরোধী দলকে হেয় করার ভাষা। আগে ছিলেন আওয়ামী নেতা মাহবুব আলম হানিফ। এখন তাকে ছাড়িয়ে গেছেন মন্ত্রী মো. নাসিম ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তারা প্রায়ই বলেন, বাটি চালান দিয়েও নাকি বিএনপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রশ্ন জাগে, মন্ত্রী নাসিম সাহেব কি দেখছেন না বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এবং কোনো বিএনপি নেতার মৃত্যু শোকে কত মানুষ জমা হচ্ছে। সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক মামলা-হামলা যদি না থাকত তবে নিশ্চয় বিএনপির সমাবেশ মিছিল আরো বড় হতো। অতএব, মন্ত্রী মহোদয় বিএনপির মরা গাঙ্গে জোয়ার আর আসবে না বলে যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন তা ভিত্তিহীন। কারণ আওয়ামী লীগের গাঙ্গে ’৭৫ সালে স্রোত হারিয়ে জোয়ার আসতে সময় লেগেছিল ২১ বছর (৭৫-৯৬)। বিএনপির মাত্র ১০ বছর গেল।
মন্ত্রী মহোদয়গণের ঐসব মন্তব্য ইঁদুর-বিড়াল খেলাকে মনে করিয়ে দেয়। মামলা- হামলা আর কারা নির্যাতনে কোণঠাসা বিরোধী দল আজ আহত রোগীর মতো। বিএনপি দুর্বল নয়, দুর্বল করা হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিরোধী দলকে গৃহবন্দি করে নিষ্ঠুর হাসিতে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। পরিহাস আরো বড় হয় যখন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনী খেলায় বন্দি ইঁদুরের মতো অংশ নিতে চাপ দেয়া হচ্ছে বিএনপিকে নতুবা নিবন্ধন বাতিলের হুমকি দিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায় এহেন হুমকির যথার্থ প্রতিবাদ করে বলেছেন কিয়ামত হলেও শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করবে না বিএনপি
সঙ্গত কারণেই বিএনপি নেতার এই প্রতিবাদ। চৌদ্দ সালের জানুয়ারি নির্বাচনে নেহাত আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। আর এখনতো বিএনপির হাতে আওয়ামী দুর্ভোগ হয়রানি, ভোট ডাকাতির সচিত্র দলিলসহ হতাশামূলক প্রমাণের অভাব নেই। বিশেষ করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী কর্মীরা প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতি করেছে। এরপর বিএনপি জ্ঞান থাকতে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে কি না সেটা ভেবে দেখার বিষয়। সরকার হয়তো ভাবছে, নতুন সার্চ কমিটি দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশনার বানানো হয়েছ, তাই ‘সব কুচ ঠিক হ্যায়’। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের চেহারা বদলানো মুখগুলো যে আওয়ামী ঘরানার তা সাধারণ মানুষের কাছেও এখন পরিষ্কার। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা বিএনপি সরকারের আমলে দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা ও জনতার মঞ্চে যোগদানকারী ছিলেন। তিনি যে, বিএনপির কপাল কতটা ধুয়ে দিবেন তা সহজেই বলা যায়। তিনি যতই বিএনপির ভুল ভাঙ্গানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন, অতীত সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তিনি আজ্ঞাবহ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিনের মতোই নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করে নির্বাচন সুষ্ঠু বলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে দেশবাসীকে ধোঁকা দিবেন ও ধিক্কার কুড়াবেন। কুসিক নির্বাচনকে অনেকেই উদাহরণ দিতে পারেন। তাদের জন্য বলা যায় আগের কমিশনের আমলে সিলেট সিটি, বরিশাল, রাজশাহী, গাজীপুর সিটি নির্বাচনও তো ছিল, কিন্তু তা দিয়ে কি ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের কারচুপি ঠেকানো গেছে?
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের খেসারতটা হয়তো বিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন তাই তিনি দলীয় কর্মী সভায় বলেছেন, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আর চান না। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ তার কর্মকাÐ যে প্রশ্নবিদ্ধ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কাজেই বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য নতুন হাতে পুরনো কৌশল প্রয়োগে যে নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ তার ফলাফল পুরনো বিতর্কে ফেলে দিবে সরকারকে। ক্ষমতার অহংকারে সরকার বিএনপিকে রাজনৈতিক গিনিপিগ রূপে ব্যবহার করে নির্বাচনী কলঙ্ক ঘোচাতে চাইছে। কিন্তু তিন মেয়াদে সুদীর্ঘ পনের বছর দেশ শাসন করা দলটি চাপের মুখে নতি স্বীকারের আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। স্বচ্ছ রাজনীতি করে আসা দলটি কেন পাতানো নির্বাচনী খেলায় যাবে? তাছাড়া অতীত তো তা বলে না, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলÑ বিএনপি নেয়নি।
বর্তমান সচেতনতা ও সচ্ছতার যুগে ছল-চাতুরির ফলাফল টেকসই হয় না। স্বাধীনতার গর্বিত নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগের ক‚টকৌশল প্রয়োগের দরকার কি? দেশের প্রতি আন্তরিক দায়িত্ব পালন করলে জনগণ তা মূল্যায়নে কখনো ভুল করে না। কাজেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দাবিদার আওয়ামীলীগ একলা চলার নীতি পরিহার করুক। বঙ্গবন্ধু সবাইকে নিয়ে চলতেন। একলা রাজত্বের বর্তমান চেহারা মোটেই সুখকর দেখাচ্ছে না আওয়ামী লীগের। সুন্দরগঞ্জের সুদর্শন এমপি লিটন হত্যা তার বড় প্রমাণ। নৃশংস এই ঘটনাটি উল্লেখ্য হওয়ার আরো কারণ হচ্ছে ঘটনা ঘটলেই জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করার অসারতা প্রমাণ। এমপি লিটন হত্যার দায় জামায়াতে ইসলামের উপর চাপালেও সত্য বেরিয়ে আসে পুলিশের আন্তরিক তদন্তে। প্রমাণসহ ধরা পড়েছে খুনিরা, যারা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী অথবা মহাজোটের কর্মী। কেউ জামায়াত-শিবিরের নয় তথাপি জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের ছাড়া হয়নি। আওয়ামী লীগের একলা চলার খায়েস পুরাতে জামায়াত বিএনপিকে আরো কত খেসারত দিতে হবে? শুধু এমপি লিটন হত্যা কেন এপর্যন্ত আওয়ামী লীগের যত কর্মী খুন হয়েছে সেসবের অভিযোগে আক্রান্ত জামায়াত শিবির, বিএনপির কাউকে আদালত এপর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি বরং দীর্ঘদিন কারা ভোগের পর অনেকে ছাড়া পান। এরপরও কিছু ঘটলেই বিরোধী শিবিরের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়া? এতেকি সরকারি দলের চরম ব্যক্তিত্বহীনতা প্রমাণ করে না? প্রকারান্তরে প্রমাণ করে অযোগ্যতাকেও। ঘটনা ঘটায় একজন, হাত বাঁধায় নিরীহ জনের।
জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের নির্যাতন মোকাবিলা লম্বা ইতিহাস আছে। জুলুম নির্যাতনের করুণ পরিণতিও দলটির দেখা আছে। সুদূর পাকিস্তান আমল থেকে। তারপরও কেন জুুলুমের পথ ধরে হাঁটতে চায় আওয়ামী লীগ। যে দলের আছে গণভিত্তি এবং বিস্তৃতি সাংগঠনিক কাঠামো- তার দরকার কি প্রতিপক্ষ নির্মূলের পথে হাঁটার? জামায়াত বিএনপি হাজারো হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত। তারা কেন যাবে খুনি হয়ে বিপদ বাড়াতে?
জঙ্গি দমনে সরকারের সাফল্য আছে। তবে এধরনের সাফল্য নতুন বা একক কিছু নয়। কারণ বিএনপি সরকারও জেএমবি শীর্ষ নেতাদের ধরে ফাঁসি দিয়েছিল। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হচ্ছে জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়নি, হওয়ার সম্ভবনাও কম। কারণ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ যখন বন্ধ করা হয় তখন সন্ত্রাস মাথা চাড়া দেয়ার সুযোগ পায়। সম্প্রতি নব্য জেএমবির উত্থান শোনা যাচ্ছে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে নব্য জেএমবির অন্তরালে আছে আওয়ামী ঘরানার নেতাকর্মীরাও নাসিরনগর ও সুন্দরগঞ্জের মন্দির ভাঙার ঘটনাগুলো তার প্রমাণ। এর চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে গত মার্চ মাসের জঙ্গি বিষয়ে ঘটনাবলী। সীতাকুÐের ঘটনাটি হয়তো পুরনো ধাঁচের যদিও মারাত্মক। কিন্তু গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আশকোনায় র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলাটি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ কালো করে দিয়েছে। আর এ হামলা থেকে যে বার্তাটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে সরকারের রাজনৈতিক অহমিকার সুযোগ কম, কারণ ঐ হামলার পর বিমানবন্দরসহ সমস্ত কারাগারে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। তাছাড়া সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভীবাজার, কুমিল্লার ঘটনাগুলো যেন আরও ভয়ানক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। মন্ত্রী শাহজাহান খান বলেছেন, জনগণের সহযোগিতা ছাড়া জঙ্গি দমন সম্ভব নয়। অতএব কূট-কৌশলের রাজনীতি পরিহার করা দেশের স্বার্থেই জরুরি। না হলে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের কারণে সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদগুলো বাড়তেই থাকবে। শান্তিপ্রিয় জনগণ এই জন্যই সামনে নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড আশা করছে সরকারের কাছে।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন