মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য

| প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : বিশ্বের জাতীয় সংসদ সদস্যদের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম হিসেবে পরিচিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম বার্ষিক সম্মেলন গত ১ এপ্রিল থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে আজ ৫ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। শেরেবাংলানগরে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা এবং বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই সম্মেলনের মূল অধিবেশনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর পর এই ফোরামের সদস্যপদ লাভের ৪৫ বছর পর এটিই হলো বাংলাদেশে প্রথম আইপিইউ সম্মেলন। ফরাসি বিপ্লবের ঠিক একশ বছর পর ১৮৮৯ সালে ফরাসি ও বৃটিশ রাজনৈতিক নেতাদের প্রচেষ্টায় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে, এমনকি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট গঠিত হওয়ার পরও আইপিইউতে ইউরোপীয়দেরই প্রাধান্য বজায় রয়েছে। আইপিইউর ১২৮ বছরের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ১৩৬টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এর বেশির ভাগই হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোতে। এর মধ্যে একাধিকবার ভারতে, জাপানে, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকক, ভিয়েতনাম, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়া, উগান্ডার মতো দেশেও আইপিইউ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের মতো গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের লক্ষ্য নির্ধারণী সংস্থাটি ইউরোপীয় বৃত্ত থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর বিশ্বে তার লক্ষ্যকে বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রসারিত করতে চায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই জেনেভাভিত্তিক এই সংস্থা নতুন বৈশ্বিক মাত্রা অর্জন করছে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত ১৩১তম আইপিইউ সম্মেলনে সংস্থাটির ২৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার ব্রোনিন বিশপ, ইন্দোনেশিয়ার এমপি নুর হায়াত আলী আসগাফ এবং মালদ্বীপ পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার আব্দুল্লাহ শহীদের সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের ভোটে বাংলাদেশের প্রতিনিধি সাবের হোসেন চৌধুরী সম্মানজনক আইপিইউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সংস্থাটির ১২৫ বছরের ইতিহাসে এটি ছিল ব্যতিক্রমী আইপিইউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তবে সাবের হোসেন চৌধুরী এমন এক পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন যে দশম জাতীয় সংসদের বেশির ভাগ সদস্য বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতা ও বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। সরকার গঠিত হওয়ার ৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যে সংসদ আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বার বার একটি অংশগ্রহণমূলক ও ক্রেডিবল ইলেকশনের তাগিদ দেয়া হচ্ছে। আইপিইউর বর্তমান প্রেসিডেন্ট যদি এই পার্লামেন্টের সদস্য না হতেন, সম্ভবত আইপিইউর পক্ষ থেকেও বাংলাদেশে ক্রেডিবল ইলেকশনের মধ্য দিয়ে একটি কার্যকর সংসদ গঠনের প্রস্তাব বা তাগিদ উচ্চারিত হতো। তবে ১৩১টি দেশের সহস্রধিক সংসদীয় ও সরকারি প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত এমন একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সফল সমাপ্তি বাংলাদেশের মর্যাদা ও সক্ষমতা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা। আইপিইউর পাশাপাশি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনেরও (সিপিএ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বাংলাদেশ থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সিপিএর ৬২তম সম্মেলনটি ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা এবং কয়েকটি দেশের নাগরিকরা জঙ্গিবাদী হামলার শিকার হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এহেন বাস্তবতার উদ্ভব হয়। গত বছরের চেয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। গত কয়েক মাসে সংঘটিত আত্মঘাতী তৎপরতা এবং জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলোর খবর বিশ্বমিডিয়ায় প্রচার পাওয়ায় ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ১৩৬তম আইপিইউ সম্মেলন নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তার পাশাপাশি নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বহু স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন সফল করতে সক্ষম হয়েছে।
আইপিইউ সম্মেলন নিয়ে আলোকপাত করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল না। গত সাড়ে চার দশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক দূর অগ্রসর হয়েও শুধুমাত্র সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের পাশাপাশি দেশের একটি ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তোলার সন্ধিক্ষণ হিসেবে আইপিইউ সম্মেলনকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে তুলে ধরার সম্ভাবনাকেই এখানে প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যৌথ ও আলাদাভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তার নিরিখে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম আইপিইউ সম্মেলনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি মহলের পক্ষ থেকে একটি যুক্তি তুলে ধরা হতে পারে যে, বর্তমান জাতীয় সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি নেই। পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নই যেখানে আইপিইউর মূল এজেন্ডা, সেখানে চলমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকায় দেশের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের আইপিইউ সম্মেলনে অংশগ্রহণে বা তাদেরকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনাযোগ্য নয়। বাংলাদেশ যখন আইপিইউর প্রেসিডেন্ট এবং ১৩৬তম সম্মেলনের আয়োজক ছিল, সেখানে বাংলাদেশে বার বার ক্ষমতায় আসা ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট প্রধান রাজনৈতিক দলকে সাথে রেখে আগামী দিনে একটি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে ও সহাবস্থানের ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির নজির স্থাপন করতে পারত সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রয়াস বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রতিনিধিদের কাছে এ সরকারের রাজনৈতিক ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পেত। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যদি সরকারের ডাকে সাড়া না দিত সেটাও তাদের অসহযোগিতা ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা হিসেবেই বিবেচিত হতো।
এমন এক সময়ে ঢাকায় আইপিইউ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো যার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, ঢাকার র‌্যাব কার্যালয়ে কথিত আত্মঘাতী হামলা চেষ্টা, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে আতিয়া মহল নামের এক বহুতল বাড়ির নিচতলায় জঙ্গি আস্তানায় তিন-চার দিনের অভিযানে র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে কর্মরত একজন সুদক্ষ সেনা কর্মকর্তা ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির আগেই মৌলভীবাজারে একাধিক জঙ্গি আস্তানার খবর পাওয়া যায়। সেখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সোয়াত টিম ‘অপারেশন হিটব্যাক’ নামের অভিযান চালায়, তবে অপারেশন অকুস্থল পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই কথিত জঙ্গি আস্তানার ভেতরে অবস্থানরত আনুমানিক সাতজনের সকলেই আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। মৌলভীবাজারের বড়হাটে অপারেশন ম্যাক্সিমাস পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানেও বাড়ির ভেতর থেকে তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একই সময়ে কুমিল্লার কোটবাড়িতে কথিত জঙ্গি আস্তানা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দুই দিন ধরে ঘিরে রাখার পর জানা গেল সেখানে কোনো জঙ্গি নেই। তবে মৌলভীবাজারের জঙ্গি আস্তানায় নিহত সাত বা আটজনের মধ্যে দুজন নারী চার শিশু এবং একজন পুরুষ ছিল বলে খবরে জানা গেছে। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে এদের একেকটি দেহ ছিন্নভিন্ন মাংসপিন্ডে পরিণত হয়। মাথা, হাত-পাসহ কোনো লাশেরই পূর্ণাঙ্গ দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন দেহের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে ডাক্তাররাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। মৌলভীবাজারের জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী পরিবারের ৬ সদস্যই নাকি দিনাজপুর থেকে সেখানে গিয়েছিল।
সুদূর দিনাজপুর থেকে আসা একটি দরিদ্র পরিবারের পিতা-মাতা তাদের ৪টি শিশু সন্তানসহ ঘরের ভেতর বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন তথ্য সাধারণ মানুষের কাছেও বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। জনমনে নানা প্রশ্ন জন্ম দিচ্ছে, সেসব প্রশ্ন উঠে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আতিয়া মহল এবং মৌলভীবাজারের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকালে নিরাপত্তা বাহিনী ড্রোন ব্যবহার করেছিল বলা হলেও ড্রোন সেসব জঙ্গি আস্তানায় অবস্থানরতদের ভিডিও ফুটেজ বা ছবি সংগ্রহ করেছিল, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। জীবিত বা মৃত কোনো জঙ্গির ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় গণমাধ্যম কর্মীদের ধারেকাছে ভিড়তে না দেয়া, অতঃপর সেনাকর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তাদের মৃত্যু এবং আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নারী ও শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হওয়ার ঘটনা সমাজে নানা ধরনের বিতর্ক তৈরি করছে। অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্টরা যেমন জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিরোধী দলের নাম বলছে, একইভাবে বিরোধী দল বিএনপিও জঙ্গিবিরোধী অভিযানের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও সরকারি বাহিনীর জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান এবং ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনার অস্বচ্ছ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। তবে দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ একটি পুরো পরিবারের সব সদস্য একসাথে ঘরের ভেতর আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা সত্যিই বিরল ও বিস্ময়কর। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় নিহত প্রায় সকলকেই নব্য জেএমবির সদস্য বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও কোথাও এসব জেএমবি আত্মঘাতি সরকারের কাছে কোন দাবি-দাওয়া পেশ করেনি। কাউকে জিম্মি করেছে বলেও শোনা যায়নি। কোনো রকম ধর্মীয় বা রাজনৈতিক এজেন্ডা ছাড়াই কি ওরা আত্মঘাতী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে? এ প্রশ্নে সকলেই নীরব। গত ১ এপ্রিল আইন ও সালিস কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুসারে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও পুলিশ হেফাজতে ৫৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এ সময় অন্তত ২৫ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক রিপোর্ট অনুসারে শুধুমাত্র মার্চ মাসেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ২১ জন নিহত হয়েছেন। এ সময়ে ৩০টি শিশু নিহত, ৪৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার এবং সন্ত্রাসীদের হাতে ১২০ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
পার্লামেন্টারি বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য সাবের হোসের চৌধুরী যখন ২০১৪ সালে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, ঠিক একই সময়ে এই সংস্থার ১২৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে প্রথম একজন আফ্রিকান এবং অইউরোপীয় নাগরিক হিসেবে ক্যামেরুনের নাগরিক ও সাবেক পার্লামেন্টারিয়ান মার্টিন চুংগং আইপিইউ সেক্রেটারি হিসেবে মনোনীত হন। তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও সেক্রেটারি পদে এর আগে কখনো ইউরোপের বাইরের কাউকে নির্বাচিত করা হয়নি। বিশেষত গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই আইপিইউ গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যরা আইপিইউ সেক্রেটারি নির্বাচিত করে থাকেন। একেকজন আইপিইউ সেক্রেটারি বার বার ম্যান্ডেট পেয়ে দায়িত্ব পালন করার কারণে গত ১২৮ বছরে ২৮ জন আইপিইউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও এ পর্যন্ত সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র ৮ জন। প্রথম দিকের অন্তত ৮ জন আইপিইউ প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। ক্যামেরুনের নাগরিক মার্টিন চুংগং আইপিইউ সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ার আগে একজন পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে তার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বিভিন্ন দেশের কনফ্লিক্ট রেজ্যুলেশন এবং রাজনৈতিক সংলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে মার্টিন চুংগং অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন বলে জানা যায়। ঢাকায় আইপিইউ সম্মেলনের প্রস্তুতিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্টিন চুংগং বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তার মতে, সামাজিক অবিচার, বৈষম্য ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই জঙ্গিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে যে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে তার এক প্রান্তে রয়েছে সাম্রজ্যবাদের আধিপত্য ও লুণ্ঠনের রাজনৈতিক-অর্থনীতি। অন্যদিকে আছে সামাজিক-রাজনৈতিক অবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ এবং গোষ্ঠিগত রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্ব›দ্ব। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের এসব উপাদান কোথায় কীভাবে কাজ করছে তার কোনো ফিরিস্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
বলা হচ্ছে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আরো অনেকেই জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য একদিকে পশ্চিমা সাম্রজ্যবাদ অন্যদিকে সামাজিক-রাজনৈতিক অসাম্য ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক দল এবং থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর পক্ষ থেকেও জঙ্গিবাদ নির্মূলে জাতীয় ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কয়েক দিন আগেও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকাকে দায়ী করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। আইপিইউ সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনের ভাষণে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী শুধুমাত্র সামরিক শক্তির মাধ্যমে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বিশ্বপ্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে তার বক্তব্য রাখলেও তার এই বক্তব্য বাংলাদেশের চলমান অবস্থার ক্ষেত্রেও যথাপ্রযোজ্য বলে ধরে নেয়া যায়। ইতিপূর্বে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও তার লেখা এক নিবন্ধে শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের জড়িয়ে বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেয়ার যে জায়নবাদী তৎপরতা চলছে তখন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অনেক দার্শনিক অ্যাকাডেমিসিয়ান থেকে শুরু করে ক্যাথলিক খৃস্টান সম্প্রদায়ের পোপ, তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দলাইলামা পর্যন্ত বিশ্বে চলমান জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের সাথে ইসলাম বা মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন। এমনকি ব্যাপকভিত্তিক সংলাপই হচ্ছে আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীকে পরাজিত করার একমাত্র পন্থা বলে একবার মন্তব্য করেছিলেন দালাইলামা। দালাইলামা এবং পোপ ফ্রান্সিস উভয়েই ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। গত বছরের শেষদিকে ফ্রান্সের একটি গির্জায় আইএসের নামে হামলা চালিয়ে একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজককে হত্যা করার পর তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ক্যাথলিকরা যেমন হিংস্র নয়, তেমনি মুসলমানরাও হিংস্র নয়। জঙ্গিবাদের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তার মতে, বিশ্বে জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষকে ‘মানি ইজ গড’ বলে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়। আমরা যদি বাংলাদেশে চলমান জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি সম্ভাব্য সমাধান খুঁজতে চাই। প্রথমেই আমাদেরকে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐকমত্যের পথ অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে কোনো ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত বিরোধ নেই। কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক কায়েমি স্বার্থবাদী চক্র বাংলাদেশকে পদানত বা বশংবদ করে রাখার জন্য দুর্বল করতে চাইলে ধর্ম ও ক্ষমতার রাজনীতিকে ব্যবহার করে বিভক্তি ও সংঘাতে ঠেলে দেয়ার পন্থাই হয়তো তারা অনুসরণ করতে চাইবে। বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদের মতো ইস্যুগুলোকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা যখন বিশ্ব এবং কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি ফোরামে নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন বাংলাদেশে একটি অকার্যকর সংসদ এবং গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। শত প্রতিকুলতার মধ্যেও এ দেশের ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। জাতিকে বিভক্ত এবং সামাজিক রাজনৈতিক বিভেদ উসকে দিয়ে সে অর্জন ও সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার যে চক্রান্ত চলতে না রুখে দিতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন