সরকার বিদ্যমান আইনের সুযোগ নিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যখনতখন বরখাস্ত করছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি বরখাস্তের এমন নজির এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদসহ প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচনে সরকারী দলের একতরফা ও অনৈতিক আধিপত্যের কারণে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রতীকে বিরোধীদলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলেও ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার মধ্য দিয়ে এ প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে সরকারীদলের প্রভাবশালী প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ¦›িদ্বতা করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা দিয়ে বরখাস্ত করার সরকারী ট্রেন্ড দেশের নির্বাচনব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সরকারের কমিটমেন্টকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলন চলাকালে দেশের কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়রদের সরকার কর্তৃক বরখাস্তকরণের সংবাদ বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং জনগণের রায়ের প্রতি সরকারের অবস্থান সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের মধ্যে আবারো বিরূপ ধারণার জন্ম দিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সরকারী দলের প্রার্থীদের প্রশাসনের আনুকূল্য বা বাড়তি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি প্রশ্নাতীত। তারপরও জনগণ যখন বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচিত করছেন, সরকার তাদের বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বরখাস্ত করছে। এভাবেই গত ৪ বছরে গাজীপুরের নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ স্থানীয় সরকারের চার শতাধিক নির্বাচিত প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকে দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পর দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার পরও পুনরায় আইনী জটিলতা সৃষ্টি করে অথবা ভিন্ন মামলায় জড়িয়ে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বারিত করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কৌতুক করে বলা হয়েছে, নির্বাচিত মেয়র বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে সরকার গিনেস রেকর্ড সৃষ্টি করতে চলেছেন। একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায় সরকার, অন্যদিকে একের পর এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেই এক ধরনের জনঅনাস্থার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে সরকার। বিরোধীদলের প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হলেও রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার ও সাময়িক বরখাস্তের সম্মুখীন হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের দলীয় প্রভাবে সরকারীদল থেকে প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করা হয়। মেয়র বরখাস্ত বা গ্রেফতার হওয়ার পর এসব প্যানেল মেয়র দোর্দÐ প্রতাপে মেয়রের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। নির্বাচিত মেয়ররা বরখাস্ত হচ্ছেন এবং কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়ে সরকারী দলের লোকদের মেয়রের দায়িত্ব পালনের এই উদাহরণ আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা শাসকদের গড়িমসি ও টালবাহানার কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ডাক দিতে হয়েছিল। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের অন্যতম দাবী ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এবারের ৭ই মার্চের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে কাজ করার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার আহŸান জানিয়েছেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে প্রধানমন্ত্রীর আহŸানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের পুনরায় বরখাস্তের ঘটনা জনমনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত দীর্ঘদিন ধরে আইনী লড়াই শেষে পদ ফিরে পাওয়া মেয়রদেরকে নির্বাহী ক্ষমতাবলে পুনরায় বরখাস্ত করার ঘটনা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় বরখাস্ত হওয়ার পর হাইকোর্টে রীট করে আবারো ক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন। একইভাবে রাজশাহী মেয়র এবং হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গাউসও আদালতের মাধ্যমে স্বপদে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ লাভ করেছেন। নির্বাচিত মেয়রদের বরখাস্তকরণ এবং আদালতের রায়ে পদ ফিরে পাওয়ার এই প্রতিযোগিতা যেন এক প্রকার রশিটানাটানিতে রূপ নিয়েছে। কোন গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের বাস্তবতা সুষ্ঠু স্বাভাবিক রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিচায়ক নয়। এই মুহূর্তে শত শত নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি রাজনৈতিক কারণে বরখাস্তের শিকার হয়ে ঝুলে আছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ পরিহার করতে হবে। যে আইনী ধারা ব্যবহার করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হচ্ছে তার অপপ্রয়োগ বন্ধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে এই অগণতান্ত্রিক ও অনাকাক্সিক্ষত প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন