মোঃ আকতারুজ্জামান চৌদ্দগ্রাম থেকে : কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়নসহ উপজেলার সর্বত্র থামছে না ভারতীয় মোটর সাইকেলের দৌরাত্ম্য। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সীমান্ত দিয়ে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে মোটর সাইকেল আনছে চোরাকারবারিরা। এক কথায় রাস্তায় দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে লাইসেন্সবিহীন ও চোরাই মোটর সাইকেল। আর এসব মোটর সাইকেলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেকেই আহত ও নিহত হচ্ছেন। সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপকহারে চোরাই অর্থাৎ টানা হিসেবে পরিচিত মোটর সাইকেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ওইসব মোটর সাইকেল ব্যবহারকারিরা সরকারের নিবন্ধন ফি বাবদ রাজস্ব খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ফাঁকি দিচ্ছে। এ অঞ্চলের সড়ক পথে অন-টেস্টসহ হরেক রকম লেখা বিপুলসংখ্যক মোটর সাইকেলের ব্যবহার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় কোনটি বৈধ কিংবা কোনটি চোরাই বুঝা মুশকিল। আবার প্রায় সড়কের পাশে হোটেল-রে¯েঁÍারা, মার্কেট, ব্যাংক-বীমা কিংবা সরকারি-বেসরকারি অফিসের সামনে এমনকি অলি-গলিতে মোটর সাইকেল পার্কিং করে রাখায় জনদুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। এতে প্রায় সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বৈধ মালিক ও চালকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মোটর সাইকেল মালিক জানান, পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কে শত শত ভারতীয় চোরাই মোটর সাইকেল রয়েছে। এগুলোর কোনো সরকারি নিবন্ধন নেই। এ সকল গাড়ি বেপরোয়া চলাচলসহ জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে। বর্তমানে মোটর সাইকেল ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠায় দেশি ও বিদেশি কোম্পানির অনেক শো-রুম গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাজারে। এসব শো-রুম থেকে নগদ কিংবা সহজ কিস্তিতে মোটর সাইকেল কিনছেন ক্রেতারা। শো-রুমের গাড়ির চাইতে চোরাই বা ছিনতাইকৃত মোটর সাইকেল প্রায় অর্ধেক দামে পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক মালিক জানান, ‘মোটর সাইকেলটি দুই বছর আগে কিনেছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও সরকারি নিবন্ধন সনদ এখনো নেইনি। কি দরকার! গাড়ি নিরাপদেই চালাচ্ছি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তিনি জানান, ‘আমার মতো অনেকেই নম্বরবিহীন শত শত মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন। এ পর্যন্ত কারো কোনো ক্ষতি কিংবা অসুবিধা হয়েছে বলে জানা নেই। হরেক রকম ব্রান্ডের নামি-দামি মোটর সাইকেল এখন বিলাসিতার অন্যতম উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এসব এলাকায় সংঘটিত অপরাধের সাথে বেশিরভাগই অবৈধ মোটর সাইকেল অন্যতম উপাত্ত হিসাবে কাজ করছে। ছিনতাইকারী এবং চোর-ডাকাতরা মোটর সাইকেল ব্যবহার করছেন হরহামেশা। আবার এদের অধিকাংশেরই নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। প্রশাসনিকভাবে বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্টসহ বিশেষ অভিযান চালালেও এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যত্রযত্র মোটর সাইকেল ব্যবহার এত বেড়েছে যা বলার উপায় নেই। দুর্ঘটনা ছাড়াও দিন-রাত মোটর সাইকেলের আওয়াজে অনেক শিশু ভয়ে আতংকিতসহ পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। আবার অনেক মোটর সাইকেলের মালিক ও চালক মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত এবং চোরাই মোটর সাইকেল কেনা-বেচার ব্যবসাকে জমজমাট করে তুলেছে।
সূত্রটি আরও জানায়, এ ধরনের মোটর সাইকেলের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চোরাইকৃত কিংবা ভারত থেকে চোরাই পথে আনা। মোটর সাইকেলের পাশাপাশি আনা হচ্ছে মোটর সাইকেলের বিভিন্ন পার্টস ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। দামে স্থানীয় বাজারের শো-রুমের দামের তুলনায় অর্ধেক বিধায় এসব অবৈধ মোটর সাইকেল কিনতে ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন এক মোটর সাইকেল ক্রেতা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবৈধপথে আনা এসব মোটর সাইকেলের ভেহিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (ভিআইএন) মুছে পুনরায় পুরনো কোনো বৈধ মোটর সাইকেলের ভিআইএন নম্বর বসিয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে নিবন্ধন করিয়ে নেয়া হচ্ছে।
একাধিক হাতবদল হয়ে চলছে বেচা-কেনা। এসব মোটর সাইকেল চালকদের অধিকাংশই সমাজের বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। দেখা গেছে, অনেক মোটর সাইকেলের নম্বর প্লেট নেই, আবার অনেকের নম্বর প্লেটে ‘অন-টেস্ট’, ‘আবেদিত’, ‘প্রেস’, ‘সংবাদপত্র’, ‘সাংবাদিক’, ‘পুলিশ’ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে বছরের পর বছর সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করলেও প্রশাসন অনেকটা নীরব ভূমিকায়। এতে একদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, অপরদিকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দিন দিন রাস্তায় নামছে নতুন নতুন মোটর সাইকেল। ফলে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছেই।
অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি সংঘবদ্ধ চোরাই দলের সক্রিয় সদস্যরা নিয়মিত ভারত থেকে চোরাই পথে মোটর সাইকেল এনে এ অঞ্চলসহ ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করছে। চৌদ্দগ্রামে মোটর সাইকেল ভারত থেকে আনার নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কালিকাপুর ইউনিয়নের ছুপুয়া বাজার সড়ক, উজিরপুর ইউনিয়নের শিবের বাজার সড়ক ও ঘোলপাশা ইউনিয়নের মতিয়াতলী সড়ক।
স্থানীয় বিজিবি ও পুলিশ প্রশাসন অভিযান চালালেও বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে কয়েক বছরের তুলনায় মোটর সাইকেল চোরাচালান বেড়েছে দুই থেকে তিনগুণ। চোরাইপথে অবৈধভাবে এসব মোটরসাইকেল ও এর বিবিধ যন্ত্রাংশ ভারত থেকে মাত্র অর্ধেক দামে আনা হচ্ছে। ডিসকভার, পালসার ও হিরো ব্রান্ডের বিভিন্ন মডেলের মোটর সাইকেল আসছে চোরাইপথে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ীও সরবরাহ করা হচ্ছে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নির্দিষ্ট মডেলের গাড়ি। চোরাকারবারে জড়িত এক বিক্রেতার কাছে ক্রেতা সেজে জানা যায়, ১৫০ সিসির পালসার ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ১৩৫ সিসি ৯০ হাজার টাকা, ডিসকভার ১২৫ সিসি ৯০ হাজার টাকা, ১০০ সিসি ৭৫ হাজার টাকা, হিরো হোন্ডা ১০০ সিসি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া স্থানীয় বাজারে ডিসকভার মোটর সাইকেলের রিং পিষ্টন ৫ হাজার ২৫০ টাকা, সামনের সকেট জাম্পার ১০ হাজার টাকা, পেছনের সকার ৬ হাজার টাকা, মিটার ৫ হাজার টাকা, সাইলেন্সার ৮ হাজার টাকা, কার্বোরেটর সাড়ে ৫ হাজার টাকা, হেড লাইট ৩ হাজার টাকা, সামনের ও পিছনের চাকা ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
আর চোরাইপথে আনা ডিসকভার মোটর সাইকেলের রিং পিষ্টন ৩ হাজার টাকা, সামনের সকার সাড়ে ৩ হাজার টাকা, পেছনের সকার ২ হাজার ৭০০ টাকা, মিটার ২ হাজার টাকা, সাইলেন্সার ৭ হাজার টাকা, কার্বোরেটর ২ হাজার ৮০০ টাকা, হেড লাইট ২ হাজার টাকা, সামনের ও পিছনের চাকা ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন