শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ষবরণ ও আনন্দোৎসব

| প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ : তাহজিব’ ‘তামাদ্দুন’ শব্দ মুসলিম সংস্কৃতির ধারণা দেয়। ইসলামি সংস্কৃতি তাওহিদ, রিসালাতের চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ-পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষে নিবেদিত। সংস্কৃতির আরবি প্রতিশব্দ ‘সাকাফাহ্’ অর্থ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ পাওয়া, সফল হওয়া অর্থাৎ পরিশীলিত, মার্জিত, সজ্জিত, রুচিসমৃদ্ধ হওয়া ইত্যাদি
সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ঈঁষঃঁৎব অর্থ হচ্ছে কর্ষণ করা। জমিকে যেমন কর্ষণ করে মসৃণ ও উৎপাদন উপোযোগী করা হয় তেমনি সদাচার ও ধার্মিকতার অনুশীলনের মাধ্যমে যখন ব্যক্তি বা জাতি পরিশীলিত হয়ে ওঠে তখনই ঈঁষঃঁৎবফ সধহ বা ঈঁষঃঁৎবফ হধঃরড়হ বলা হয়। সুস্থ-সংস্কৃতি হলো মানব মননের সুকোমল অভিব্যক্তি, যা ভূগোল ও বিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে পরিশীলিত ঐক্য ও বিবেকের জাগরণ ঘটায়।
আরবে আইয়্যামি জাহিলিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য বোঝাতেও তিনটি ‘ড’ অক্ষরের চমৎকার ব্যবহার ইতিহাসে লক্ষণীয়- মদ (রিহব) নারী (ড়িসবহ) যুদ্ধ (ধিৎ)। আইয়্যামি জাহিলিয়্যাতে আরবদের কৃষ্টি-সাংস্কৃতিক প্রয়াস অব্যাহত ছিল। তাদের কতগুলো আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। আইয়্যামি জাহিলিয়্যাতের আরবরা যুদ্ধবিদ্যা, অতিথি সেবা, পশুপালন, দেশভ্রমণ, আন্তঃদেশীয় ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ছিল বিখ্যাত। শিল্প-সাহিত্যেও তারা কম যায়নি। সে সময়ের ইতিহাস খ্যাত ছিল ‘উকাজের মেলা’। কবিতা উৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ সাতটি কবিতা স্থান পেয়েছিল পবিত্র কা’বার দেয়ালে; যাকে বলা হয় ‘সাবউল মুয়ল্লাকাত’। ছিল নববর্ষ পালন ও ঘৌড় দৌড় উপলক্ষে প্রচলিত দু’টি উৎসব ‘নিরোজ’ বা ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরগান’। এত সব কিছুর মধ্যে ছিল না মানবতা-নৈতিকতার ছোঁয়া। বরং ছিল সংস্কৃতির নামে অপ-সংস্কৃতির অবাধ্যতা।
প্রিয়নবীর (স.) নবুওয়াৎপূর্ব ‘মূর্খতার যুগে’ আনন্দ-বিনোদন ইত্যাদির আড়ালে মদ, মূর্তি, জুয়া, লটারি, অবৈধ পণ্যের বিপণনে মানুষের জীবন-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হতো। উৎসবের বেলেল্লাপনার শিকার হয়ে বিশিষ্ট ও বয়োঃজ্যেষ্ঠ একজন সাহাবি গুরুতর আহত হওয়ার পটভূমিতেই সুরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াত নাযিলের মাধ্যমে মদ, মূর্তি, জুয়া, লটারিকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি একে ‘ঘৃণিত শয়তানের কাজ’ বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, জানিয়ে দেওয়া হলো ইসলামের সুস্পষ্ট ও শ্বাশত অবস্থান “শয়তান এই মদ ও জুয়ার মধ্যে (ফেলে) তোমাদের মাঝে শত্রæতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিতে চায় এবং এভাবে সে তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে দূরে সরিয়ে রাখে; তবুও কি তোমরা ফিরে আসবে না”? (মায়েদা: ৯১)।
প্রিয়নবীর (স.) নবুওয়াৎপূর্ব সময় ‘মূর্খতার যুগে’র উৎসবের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে এগুলো চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইসলামে বছরে দু’টি ঈদের প্রচলন করা হয়। ঈদের আনন্দ প্রকাশে রণ কৌশল প্রদর্শন একটি ইসলামি ঐতিহ্য। আরবের ‘হাবশি’দের এমন প্রদর্শনী প্রিয়নবী (স.) পছন্দ করতেন, হযরত আয়েশাকে (রা.) নিয়ে এমন প্রদর্শনী দেখে বললেন “হ্যাঁ, এটা খুবই উত্তম আনন্দ... ”(বুখারি)। ঈদের আনন্দ প্রকাশের জন্য রণ কৌশল প্রদর্শনকে ‘তাগ্লীস’ বলা হয়। অর্থাৎ দফ বাজানো, তরবারি চালনা, বল্লম চালনা ইত্যাদি
ইসলাম নিথর-নির্জীব জীবনবোধের স্থলে ইবাদতের মাধুর্যে শরীর-স্বাস্থ্যের বিকাশকে উৎসাহ দেয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, রণনৈপুণ্যের প্রয়োজনে তীর নিক্ষেপ, বর্শা চালনা, দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদিকে ইসলাম সমর্থন করে। প্রিয়নবী (স.) বলেন “ঘোড়া অথবা তীর নিক্ষেপ অথবা উটের প্রতিযোগিতা ব্যতীত (ইসলামে) অন্য প্রতিযোগিতা নেই” (তিরমিযি)। প্রিয়নবী (স.) আরো বলেন “তোমাদের জন্য তীর নিক্ষেপ শিক্ষা করা কর্তব্য। কেননা, এটা তোমাদের জন্য একটি উত্তম খেলা” (ফিকহুস্ সুন্নাহ্, ২য় খ. পৃ ৬০)। হযরত ইবনু ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত ‘রাসূল (স.) হাফইয়া থেকে সানিয়াতুল বিদা পর্যন্ত সীমানার মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়াসমূহের দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করেছেন। স্থান দু’টির দূরত্ব ছিল ছয় মাইল’ (বুখারি)। বর্ণিত আছে ‘হযরত আলীর (রা.) দৌড়ের গতি ছিল খুব বেশি’। দেহ মনের আনন্দের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা.) বলতেন ‘অন্তরকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবকাশ ও শান্তি দান কর। কেননা, অন্তরের অস্বস্তি অন্তরকে অন্ধ করে ফেলে’।
বাংলা নববর্ষ পালনে ইরান, আরবের নববর্ষ ‘নওরোজে’র যোগসূত্র লক্ষণীয়। মুসলিম শাসকগণের ‘ফসলী ও ভূমি কর’ আদায়ের সুবিধার জন্যই বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়। ‘বিশ্ব ঐতিহ্য পয়লা বৈশাখ’ ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তির সীমা পেরিয়ে সর্বত্র একাকার। কাজেই, বাংলা নববর্ষও হতে পারে আমাদের নাযাতের মাধ্যম। যেমন ১. নববর্ষকে আল্লাহ্র নিয়ামত মনে করে শুকরিয়া আদায়। ২. নববর্ষের আনন্দ দুঃস্থ-দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগ করা। ৩. নববর্ষে অভাবী মানুষের খোঁজ-খাতির, তাদেরকে খাদ্য, পোশাক দান করা। ৪. পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। ৫. পহেলা বৈশাখ দেনা-পাওনা হালনাগাদ করবার দিন।
নববর্ষে মেহনতি কৃষক খাজনা আদায়ের আগ্রহে বলতো ‘আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি...’ কিন্তু বর্তমানে নববর্ষের গর্বিত অতীত ভুলে তা পালিত হয় শহুরে ঘরানায়। হাড়ভাঙ্গা শ্রমেক্লান্ত যে কৃষক ঋণে জর্জড়িত তার কাছে বাংলা নববর্ষের আবেদন কতটুকু? অন্যদিকে খাদ্যের সঙ্গে মিশে থাকা চুল, কাঁকড় জাতীয় বস্তু যেমন অখাদ্য, তেমনি সংস্কৃতির মধ্যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশও অযৌক্তিক।
উৎসবের আবহে নারী-পুরুষের অবাধ-অবাধ্য মেলামেশা ইসলামে অনুমোদিত নয়। পর্দা বজায় রাখা একটি ‘দায়েমি ফরজ’ বা সার্বক্ষণিক বাধ্যতামূলক বিধান। বিনোদন যেন অপচয়ের কারণ না হয় তাও খেয়াল রাখা জরুরি। মহান আল্লাহ্ বলেন “আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ” (বানি ইসরাইল: ২৬, ২৭)। বিজাতীয় অনুকরণও ইসলামে সমর্থিত নয়। প্রিয় নবী (স.) বলেন “যে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ বা সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে” (আবু দাউদ, হাদিস: ৩৫১২)।
প্রাণ ও প্রকৃতির সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। আমরা ভাগ্যবান; আমাদের বর্ষপুঞ্জি আছে, ইংরেজদের নেই। তারা ব্যবহার করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। ‘সন’ ‘তারিখ’ আরবি শব্দ, ‘সাল’ ফার্সি শব্দ স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা সনের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পৃক্ততা। স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৪।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
saif ১২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০৩ পিএম says : 0
ধন্যবাদ স্যার
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন