তারেকুল ইসলাম : সম্প্রতি আসন্ন ১৪ এপ্রিলের পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষকে ঘিরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করাকে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ দেশের জনগণের একটি বড় অংশ আদর্শিকভাবেই এই শোভাযাত্রার পক্ষে নয়, তদুপরি মঙ্গল শোভাযাত্রাকে এভাবে বাধ্যতামূলক করে তা জোর করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গতকারণেই দেশের দায়িত্বশীল ওলামায়ে কেরাম ও বৃহত্তর তৌহিদি জনতা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিয়ে প্রশ্ন নয়, বরং যখনই ভুঁইফোড় ও মুসলমানদের ঈমানবিরোধী মঙ্গল শোভাযাত্রাকে এটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত করা হয়, তখনই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব নির্দিষ্ট মূর্তি প্রদর্শন করা হয়, সেগুলোর অধিকাংশই হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। একইসাথে বিভিন্ন রাক্ষস-খোক্ষসের প্রতিকৃতি ও মুখোশও প্রদর্শন করা হয়। রাক্ষস-খোক্ষস নিশ্চয়ই মঙ্গলের প্রতীক হতে পারে না, বরং অশুভ ও অমঙ্গল তথা শয়তানের প্রতীক বলা যেতে পারে; তাহলে কেন এসবের প্রদর্শনী? বস্তুতপক্ষে, রাক্ষস-খোক্ষসের প্রতিকৃতি ও মূর্তি নিয়ে এত মাতামাতির প্রচ্ছন্ন অর্থ হচ্ছে স্যাটানিজম তথা শয়তানের উপাসনা। প্রাচীনকালে দেব-দেবতার উপাসনা করার পাশাপাশি শয়তানেরও উপাসনা করা হতো তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য, যাতে কোনো কারণে রুষ্ট হয়ে শয়তান অমঙ্গল বা অকল্যাণ না ঘটায়। মঙ্গল শোভাযাত্রা মানে নতুন বছরে মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা করা, এর ফলে অমঙ্গল দূরীভ‚ত হবে বলে আশা করা হয়; অথচ প্রতিবছর দেশব্যাপী অঘটন, দুর্ঘটনা ও অমঙ্গলজনক ঘটনাবলি একের পর এক অব্যাহতভাবে ঘটেই চলছে, কিছুতেই থামছে না। কার্যত এভাবে তো অমঙ্গল দূরীভ‚ত হয় না; অন্ততপক্ষে মুসলমানদের ঈমান-আকিদার সাথে এই শোভাযাত্রা সাযুজ্য নয়, বরং বিরোধী। মুসলমানরা একমাত্র আল্লাহতায়ালার কাছেই মঙ্গল কামনা করেন এবং অমঙ্গল দূরীকরণের জন্য তারা আল্লাহর কাছেই পানাহ চান। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা অবশ্যই র্শিক।
পহেলা বৈশাখের সময়কার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঐতিহ্য বলাও ভুল এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও; কেননা বিগত ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে ক্ষমতা ও মঙ্গলের প্রতীক হিন্দুদের পৌরাণিক দেবদেবীর বাহনের মূর্তি নিয়ে এবং বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পরে ‘বর্ষবরণ শোভাযাত্রা’ নামে ব্যাপক ঢোলবাদ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হয় ‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’!
মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের গণেশপূজার উৎসব। আর এই শোভাযাত্রাকে ‘বাঙালি’র সার্বজনীন ঐতিহ্য আখ্যায়িত করে যখন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে চতুরভাবে অঙ্গীভ‚ত করা হয় এবং এ ব্যাপারে প্রচারণাও চালানো হয়, ঠিক তখনই এর ক‚টরাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধরা পড়ে; কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো পৌত্তলিক রিচুয়্যাল তথা ধর্মীয় আচারকে যদি ‘সার্বজনীন’ বলে কোনো জাতীয় উৎসবের মধ্যে স্থাপন করা সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালিদের মধ্যে বিরাজমান তাওহিদভিত্তিক বা একত্ববাদভিত্তিক স্পিরিচুয়াল চেতনাকে (ঈমান) দুর্বল করার সম্ভাবনা প্রবল হবে এবং এভাবেই আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার রাজনৈতিক আত্মপরিচয়কে বিনাশ করা সম্ভব হবে।
ধর্ম ভেদে বিশ্বাসব্যবস্থা বিভিন্ন রকমের হওয়া স্বাভাবিক; ফলে ইসলামের বিশ্বাসব্যবস্থা (তাওহিদ ও ঈমান) এবং এর নির্দেশিত রিচুয়্যাল্স বা ধর্মাচারসমূহও অন্যান্য ধর্মের তুলনায় স্বতন্ত্র। ইসলামে বিশ্বাসব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য ও মৌল ভিত্তি হচ্ছে, চিরন্তন নিখাদ একত্ববাদ বা তাওহিদ। এই জায়গাটা নিষ্কলুষ রাখার ক্ষেত্রে আপসহীন বলেই ইসলাম নির্দেশিত রিচুয়্যাল্স তথা ধর্মাচারসমূহও স্বতন্ত্র। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্রখ্যাত নেপালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীÑ উভয়কেই একই সময়ে, একই মন্দিরে সম্মিলিতভাবে একই দেবমূর্তির আরাধনা বা পূজা করতে দেখা যায়। এর কারণ হলো, উভয় ধর্মের বিশ্বাসগত অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে একই, কারণ উভয়ই মূলগতভাবে পৌত্তলিক; ফলে উভয় ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের অবমোচন ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই। সুতরাং বিশ্বাসব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য বিবেচনায় ইসলাম কোনোভাবেই তাওহিদভিত্তিক ঈমানের জন্য ক্ষতিকর বা হুমকিস্বরূপ এমন কোনো রিচুয়্যাল বা উৎসবকে গ্রহণ করবে না এবং সঙ্গতকারণে প্রশ্রয়ও দেবে না।
মঙ্গল শোভাযাত্রা ইতোমধ্যে সেক্যুলার রিচুয়্যালে পরিণত হয়েছে, এমনটা বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ ব্যাপক দার্শনিক অর্থে সেক্যুলারিজম আর ম্যাটারিয়ালিজম (প্রকৃতিবাদ বা জড়বাদ) একে অপরের পরিপুরক। পৌত্তলিক রিচুয়্যাল ও ধ্যান-ধারণা দার্শনিকভাবে সেকুলারদের বিরোধী নয়; তাই সেক্যুলারদের কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রার গ্রহণযোগ্যতা স্বাভাবিক। এই তথাকথিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় মঙ্গল কামনা করা হয় সাধারণত হিন্দু ধর্মমতে ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন ও কাল্পনিক পুরাণের বর্ণিত রাক্ষস-খোক্ষসের প্রতিকৃতির কাছে; ফলে এটা যে স্পষ্টত প্রাচীন সনাতনী কুসংস্কার, তা বলাবাহুল্য। আর যখন এই পৌত্তলিক রিচুয়্যালকে সেক্যুলাররা বিনা দ্বিধায় স্বাগত জানায় এবং গ্রহণ করে, তখন এটা বলা সঙ্গত যে, এই শোভাযাত্রা আধুনিক যুগের একটি বঙ্গীয় সেক্যুলার কুসংস্কারে পর্যবসিত হয়েছে। সুতরাং বাঙালি-অবাঙালি-দেশি-ভিনদেশি কোনো মুসলমানের পক্ষে এই শোভাযাত্রার কুসংস্কার লালন করা তার একত্ববাদী ঈমানের বরখেলাপ।
যদি আসলেই বাঙালির ঐতিহ্য হয়েই থাকে, তাহলে আজ অবধি মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বারবার ‘সার্বজনীন’ বলে প্রচারণা চালানোর মূল হেতু কী? এই সার্বজনীন বলার মতলবটা আগে বোঝা দরকার। বাংলার রেনেসাঁসের (পড়–ন হিন্দু রেনেসাঁস) অগ্রনায়ক রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দরাই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের কেতন ওড়ানো শুরু করেন এবং একে অবলম্বন করেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক উত্থান ঘটেছিল। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্মবাদীরা মনেপ্রাণে ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী। তারা সেক্যুলার ছিলেন না, ফলে তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই যে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথাবার্তা’, সেটা বিখ্যাত লেখক এম আর আখতার মুকুলও তার ‘কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ বইয়ে লিখেছিলেন। কট্টর হিন্দুত্ববাদকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণে বাঙালি মুসলমানদের শরিক করার কোনো সুযোগই রাখেননি তারা; কারণ বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে তীব্র মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতেন এবং পরবর্তী শরৎচন্দ্রদের মতো ঔপন্যাসিকরাও বাঙালি মুসলমানদের ‘মোহামেডান’ বলে সম্বোধন করতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, সেকালে হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালি মুসলমানদের ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করতো না। লক্ষণীয় যে, আজকে যখন হাজার বছরের বাঙালি কিংবা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের কথা বলা হচ্ছে, তখন আমাদেরকে সচেতনভাবেই বুঝে নিতে হবে যে, হাজার বছরের সেই ‘বাঙালি’ হচ্ছে হিন্দু, মোটেও সে মুসলমান নয়।
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কিংবা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ইত্যাদির আবরণে হিন্দুদের এই পৌত্তলিক রিচুয়্যাল মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘সার্বজনীন’ বলাটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতÑঅর্থাৎ বাংলাদেশের মুসলমানদের মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয়কে ভুলিয়ে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। আর ঐতিহাসিকভাবেই এমন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বাঙালি মানেই হলো হিন্দু, আর হিন্দু মানেই বাঙালি, যেমনটা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মুসলমানরা একমাত্র বেয়াদব, যাহারা হিন্দু পরিচয় স্বীকার করিবে না” (সাম্প্রদায়িকতা, সলিমুল্লাহ খান, ২০ অক্টো. ২০১২, দৈনিক বণিক বার্তা)। এছাড়া আবুল মনসুর আহমদ তাঁর বিখ্যাত বই ‘আমার দেখা পঞ্চাশ বছরের রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছিলেন, “হিন্দুরা চাহিত আর্য-অনার্য, শক, হুন যেভাবে ‘মহাভারতের সাগর তীরে’ লীন হইয়াছিল, মুসলমানেরাও তেমনি মহান হিন্দুসমাজে লীন হইয়া যাউক। তাহারা শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, ‘হিন্দু মুসলমান’ (হিন্দুরূপী মুসলমান) হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দুসভার জনতার মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও মত ছিল’ (পৃষ্ঠা-১৫৯)। গোঁড়া হিন্দুদের পাশাপাশি ব্রাহ্মধর্মবাদী রবীন্দ্রনাথরাও পুরো ভারতবর্ষকে শুদ্ধ হিন্দুর দেশরূপে কল্পনা করতেন। হিন্দু রেনেসাঁসের গুরু বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের মূল নির্যাসও ছিল হিন্দুত্ববাদ এবং মহা হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রেরণা, যা আজও জাতীয় সঙ্গীতের নামে ভারতের মুসলমানদের ওপর জোরজবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। সুতরাং বাঙালি-অবাঙালি সব মুসলমানকে হিন্দু বানানোর প্রকল্প ঐতিহাসিক এবং কয়েক শতাব্দীর বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রকল্প। এজন্যই হিন্দুধর্মের রিচুয়্যাল বা ধর্মাচার পালনের বেলায় ‘সার্বজনীনতা’র বিভ্রম তৈরি করা হয়। সুতরাং বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের মুসলমানদেরকে সেক্যুলারিজম, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও সার্বজনীনতার বিভ্রমের মধ্যদিয়ে এবং মন-মগজে হিন্দুত্ববাদের বীজ বপণ করে তাদের মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয়কে বিনাশ করার ষড়যন্ত্র অধ্যাবধি চলমান।
মোঘল আমলের সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতিগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। বাংলার মুসলিম নবাবদের শাসনামলে বাংলাভাষী বৃহৎ একটি জাতিগোষ্ঠীর মর্মেও ইসলাম স্থান করে নিয়েছিলÑ হিন্দুধর্মের অমানবিক বর্ণপ্রথা ও জাতপাতের বৈষম্যের বিপরীতে সাম্য ও মানবতার জয়গান গেয়ে। কিন্তু হিন্দুপ্রবণ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা কখনোই মুসলমানদেরকে এখানকার স্থানীয় জনমানুষ বলে স্বীকার করেনি; এমনকি যারা নৃতাত্তি¡কভাবে বাঙালি এবং এখানকার স্থানীয় অধিবাসী কিন্তু যদি তারা মুসলমান হয়, তাহলে আর তাদেরকে বাঙালি বলা যাবে না বরং আগন্তুক হিসেবে ভাবতে হবেÑ এমন উদ্ভট মত পোষণ করতো সেকালের বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা।
ভারত ভাগের সময়েই উপমহাদেশের বাঙালি-অবাঙালি সকল মুসলমানের মুসলিম জাতিসত্তার রাজনৈতিক পরিচয় নির্মিত হয়েছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালিরা পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদ ও জুলুমতন্ত্রের প্রতিরোধ করে নিজেদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করেছিল, এই সশস্ত্র গণলড়াই ছিল ফ্যাসিবাদ ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে জাতীয় মুক্তির রাজনৈতিক লড়াই। অথচ আজ একশ্রেণির সেক্যুলার বামরা বলছেন, ‘দ্বিজাতিতত্তে¡র বিরুদ্ধে’ এবং ‘একটি সেকুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’র জন্যই নাকি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল! হা হতোস্মি! ভ‚-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, একাত্তরে যদি দ্বিজাতিতত্তে¡র চেতনার বিরুদ্ধেই আমরা যুদ্ধ করে থাকতাম এবং মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় ত্যাগ করে সেক্যুলারিজমকে মনেপ্রাণে চাইতাম, তাহলে আজকে ভারত থেকে আমাদের আলাদা থাকার কথা ছিল না। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে দেশভাগ না হলে পাকিস্তান হতো না, আর পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলাভের রাজনৈতিক পরিণতিও আসতো নাÑ ইতিহাসের এই বাস্তব সমীকরণ অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাদের এহেন মিথ্যাচার ও বিকৃতি মূলত ইসলামবিদ্বেষপ্রসূত। ভারতভাগ ও বাংলা ভাগের সময়েই আমাদের রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল, তাই আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় শুধু ধর্মীয় নয়, ভ‚-রাজনৈতিক পরিচয়েরও মূল ভিত্তি। এজন্যই ভারতের অঙ্গরাজ্য কলকাতার অধিবাসীদের সাথে আমাদের নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য থাকলেও প্রধানত ভ‚-রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলেই আমরা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে তাদের থেকে আলাদা। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের অধিকারী, তারা নয়।
সেক্যুলারিজমের মুখোশধারী বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই নব্য মুৎসুদ্দীরা আজ বাংলাদেশের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বিনাশকল্পে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো একটি পৌত্তলিক রিচুয়্যালকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। পহেলা বৈশাখে এ যেন আমাদের মুসলিম জাতিসত্তা ও আত্মচেতনার কেবলাকে হাজার বছরের প্রাচীন হিন্দুয়ানি সনাতনধর্মিতার দিকে প্রত্যাবর্তন করানোর এক অপচেষ্টা! অথচ এই বঙ্গীয় সেক্যুলাররা এতই অদূরদর্শী যে, তারা বুঝতে চায় নাÑ এই মুসলিম জাতিসত্তার রাজনৈতিক পরিচয় পরিত্যাগ করে সেক্যুলারিজম গ্রহণপূর্বক ‘হিন্দুরূপী মুসলমান’ হলে আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের আগ্রাসন আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্র্য হরণপূর্বক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশকে একটি করদরাজ্যে পরিণত করবে।
ষ লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন