আমিনুল হক, মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে
দিনমজুর হতদরিদ্র তারিকুল ইসলামের জীবনচিত্র পাল্টে গেছে। ৪টি আধুনিক পাম্প টিউবওয়েল উদ্ভাবন করে খুঁজে পেয়েছেন সুখের ঠিকানা। একের পর এক অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন-সংগ্রামের সৈকতসম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে বসে পড়েন। শুরু করেন স্যালোমেশিনের মেকানিক্যালের কাজ। ৫ বছর মেশিনের কাজ করে এলাকাজুড়ে সুনাম অর্জন করেন স্যালো মেকার হিসেবে। এ কাজ করার পাশাপাশি তারেক চিন্তা করতে থাকেন নতুন কিছু তৈরি করার। ভাবতে ভাবতে মাথায় বুদ্ধি আসে নতুন রূপে দেশীয় মেশিনের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে টিউবওয়েল তৈরি করার। পুরনো স্যালোমেশিনের যন্ত্রপাতিগুলো ফেলে না দিয়ে কাজে লাগানো। তারপর বাড়িতে বসেই শুরু করেন পুরনো স্যালোমেশিনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা। স্যালোমেশিনের পুরনো লায়নার, রিকশা-ভ্যানের পুরনো এক্সেল, বেয়ারিং, পুরনো লোহার পাইপ, মেশিনের ওয়ারস্যালন প্রভৃতি সংগ্রহ করেন। লায়নার দিয়ে টিউবওয়েলের বডি, রিকশার এক্সেল দিয়ে হাতল, পাইপ দিয়ে টিউবয়েলের গোড়ার অংশ, এয়ারগ্যালন দিয়ে উপরের অংশ তৈরি করে ঝালাই দিয়ে বেয়ারিং লাগিয়ে তৈরি করেন টিউবওয়েল। প্রথমে নিজের বাড়িতে লাগান এই টিউবওয়েল। এই টিউবওয়েলে পানি উঠে বেশি, শব্দ কম, খরচ কম, দেখতে ভাল দেখার কারণে আশপাশের গ্রামের মানুষেরা দেখতে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে টিউবওয়েলের খবর। নিজের পরিবার ও এলাকার মানুষের উৎসাহ বেড়ে যায়। প্রতিবেশীরা তারেকের তৈরি টিউবওয়েল পছন্দ করে। চারদিকে বাড়তে থাকে টিউবওয়েলের চাহিদা। এভাবে ৬ মাসে টিউবওয়েল তৈরির কাজে সুনাম কুড়াতে থাকে তারেক। তার একটি টিউবওয়েলের নাম রাখেন তারেক পাম্প। এভাবে ডায়বেটিস পাম্প, ফায়ার সার্ভিস পাম্প, সাধারণ পাম্প। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস পাম্প বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই সে এলাকায় ইটের বিল্ডিংয়ের একশ ফুট উঁচু পর্যন্ত এই টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি ¯েপ্র করে ভিজানো যায়। হাটবাজার, বাড়িঘর, দোকানপাটসহ কোথাও আগুন লাগলে এই পাম্পের সাহায্যে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা ছাড়াই অতি সহজে পাইপের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপক করা যায়। এতে যে এলাকায় রাস্তাঘাট খারাপ সে এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গাড়ি নিয়ে যেতে পারে না এবং পানির উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় সে এলাকায় তারেকের তৈরিকৃত ফায়ার সার্ভিস পাম্প ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। এ পাম্প বিভিন্ন হাটবাজার ও বসতবাড়িতে সাশ্রয়ী মূল্যে স্থাপন করে গৃস্থালির কাজের পাশাপাশি আগুন নেভানো কাজে ব্যবহার করছে। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরে অরণখোলা ও মির্জাবাড়ী ইউনিয়নের মধ্যবর্তী ভবানীটেকি গ্রামে ১৯৭৫ সালে তারেক জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আঃ ছামাদ। মাতার নাম জহুরা বেগম। ৬ ভাই ১ বোনের মধ্যে তারেক সবার ছোট। সরেজমিন ভবানীটেকি গ্রামে গেলে জানা যায়, তারেকের পাম্প টিউবওয়েল তৈরির মজার কাহিনী। ১৯৮৮ সালে তারেক পুরনো স্যালোমেশিনের ব্যবসা করতেন। পুরনো নষ্ট মেশিন কিনে তা মেরামত করে বিক্রি করতেন। এতে তার যে আয় হতো তা দিয়ে তারেকের সংসারের অভাব দূর হতো না। এভাবে কিছুদিন ব্যবসা করার পর তারেক চিন্তা করে বের করেন বন এলাকার মানুষের জন্য পানীয়জলের আধুনিক পাম্প টিউবওয়েল। তার পাম্প তৈরি দেখে প্রথমে এলাকার মানুষ তাকে অবহেলার চোখে দেখত। রাতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রথমে তৈরি করেন সাধারণ টিউবওয়েল (তারেক পাম্প)। এ পাম্প দিয়ে বেশি পরিমাণে পানি, দামে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা ও টিউবওয়েল চাপতে শক্তি কম লাগায় এর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তারপর ২০০২ সালে তার নিজ গ্রাম ভবানীটেকি চৌরাস্তা মোড়ে খুলে বসেন ছোট আকারের ওয়ার্কশপ। এরপর তৈরি করেন ২ পা দিয়ে চেপে পানি উঠানোর আধুনিক টিউবওয়েল। তার নাম দেন ডায়াবেটিকস পাম্প টিউবওয়েল। যাদের ডায়াবেটিক আছে তাদের জন্য এ টিউবওয়েল ব্যাপক উপকারী। তারেক জানান, এ টিউবওয়েল প্রতিদিন ১০/২৫ মিনিট চেপে পানি উঠালে গৃস্থালির পানির চাহিদা মিটবে এবং ডায়াবেটিকস অনেকটা আয়ত্বে আসবে। এ পাম্প থেকে প্রতি মিনিটে ৩০-৪০ লিটার পানি উঠানো সম্ভব। এ টিউবওয়েলের দাম ১০ হাজার টাকা। এভাবে ১ বছরের মধ্যে মাথা খাটিয়ে বের করেন যে এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই সে এলাকার বিল্ডিংয়ের ছাদের ট্যাংকে পানি উঠানোর জন্য তৈরি করেন ফায়ার সার্ভিস পাম্প। যত বেশি প্রেসার দিয়ে ফায়ার সার্ভিস পাম্পটি চাপা হবে তত বেশি উপরে পানি উঠবে। টিউবওয়েলের মুখে রাবারের পাইপ লাগিয়ে হাতলে প্রেসার দিতে থাকলে ১-২শ ফুট উপরে পানি উঠানো সম্ভব বলে তারেক জানান। এ তিনটি টিউবওয়েলেই ১শ ফুট গভীর থেকে পানি উঠনো যায়। স্থান উঁচু হলেও কোন সমস্যা নেই। পাম্প টিউবওয়েল তৈরির জন্য অক্সফাম সহায়তায় মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ ও মধুপুর গড় ক্যাম্পেইন গ্রুপ আয়োজিত “গ্রামীণ জীবনযাত্রা মেলা-২০১২” তে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক হিসেবে কৃষি সম্মাননা পেয়েছেন। তারেকের এ তিনটি পাম্প টিউবয়েল তৈরির ওয়ার্কশপের নাম দিয়েছেন হাসান ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। তার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে ২ জন কর্মচারীকে মাসিক বেতন হিসেবে কাজ করে। প্রথমে এলাকায় পাম্প টিউবওয়েলগুলো বিক্রি হলেও এখন আশপাশের জেলাগুলোতেও বাড়ছে তারেকের টিউবওয়েলের চাহিদা। তারেক জানান, সাধ আছে, সাধ্যের অভাব। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে টিউবওয়েল তৈরির উপকরণ ক্রয় করতে পারছি না। সরকারি ও বেসরকারি কাজে যদি আমার পাম্পগুলো একটু বেশি পরিমাণে বিক্রি করতে পারতাম তাহলে আমার এগিয়ে যেতে সহজ হতো। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে তার তৈরি টিউবওয়েলগুলো নেয়ার দাবি জানায়। মধুপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ডাঃ মীর ফরহাদুল আলম মনি জানায়, প্রত্যন্ত এলাকার বেকার যুবক তারেক সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এতে উৎসাহিত হয়ে আরও প্রযুক্তিভাবে কম দামে উন্নতমানের টিউবওয়েল তৈরি করতে পারবে। এক সময়ে অভাবী বেকার যুবক তারেকের এখন আর পিছে ফিরে তাকাতে হয় না। এখন তার মাসে আয় ১৫/২০ হাজার টাকা। বিভিন্ন উপজেলার কৃষি ও প্রযুক্তি মেলায় স্টল দিয়ে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে। ২০১০ সালের মধুপুর কৃষি মেলায় খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ডায়াবেটিক পাম্প টিউবওয়েল দেখে প্রশংসা করেন। এখন এলাকায় তারেক পরিচিত একটি নাম। ভবিষ্যতে তারেক সরকারি সহযোগিতা পেলে স্থির বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে জানান। তারেকের ২ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে হাসান ভবানীটেকি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণীতে পড়ে। ভবিষ্যতে তার ছেলে হাসান ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়। তারেক জানান, আমি যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়ার্কশপে গিয়ে কাজ করি। ঝালাই মেশিন ও হাতুড়ের আঘাতে তৈরি পাম্প দেখে আমার খুব ভাল লাগে। টিউবওয়েলের পানি ওঠা দেখে মনের কষ্টের কথা ভুলে যাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন