শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আজানে গাত্রদাহ কেন?

| প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী
‘আমি মুসলিম না। তাহলে কেন আজানের শব্দে আমার ঘুম ভাঙানো হবে?’ এ উক্তি ভারতের খ্যাতনামা গায়ক সনু নিগমের। তিনি মুসলমান নন বলে নিজেই স্বীকার করেছেন। সুতরাং মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবের কোনো ঠেকা পড়েনি তার ঘুম ভাঙানোর। মসজিদে মাইকে আজান দেয়া নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে বিতর্কে ভারতের গায়ক সনু নিগম শিরোনামে গত মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাবে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি বাংলার বরাতে বলা হয়েছে, ভারতের খ্যাতনামা গায়ক সনু নিগম মাইকে আজান দেয়ার বিরুদ্ধে মন্তব্য করে বড় ধরনের বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। সোমবার ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর তিনি টুইটারে একের পর এক মন্তব্য পোস্ট করতে থাকেন। ভারতীয় অমুসলিম গায়কের আজানবিরোধী বক্তব্যে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ভারতে এরূপ ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব নতুন কিছু নয়। অহরহ সেখানে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং বিদ্বেষ ছড়ানো নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। সেখানে ‘গোমাতার’ নামে কি না হচ্ছে? মুসলমানদের গরু জবাই, কোরবানিকে গো-হত্যা নাম দিয়ে সরকারিভাবে গরু জবাই সেখানে নিষিদ্ধ এবং গরুর গোশত ভক্ষণের দায়ে মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন চলে, সেখানে একজন অমুসলিম গায়ক আজানকে বিদ্রæপ করবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারতে কোরআন হাদিস ইসলামের নানা বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের, যা এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আজানের কথায়ই আসা যাক। কয়েক সপ্তাহ সংবাদপত্রে এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছিলÑ ইসরাইল সরকার সেখানে আজান নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। খবরে রাতের আজান নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়। অর্থাৎ মাগরিব, এশা এবং ফজরের আজানকে রাতের আজান গণ্য করা হয়। জোহর ও আসর দিনের অন্তর্ভুক্ত। ইহুদিদের এ ঘৃণ্য পদক্ষেপের কোনো প্রতিবাদ নিন্দা আরব দেশগুলোতে হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। আমাদের এখানেও কোনো উচ্চবাচ্য দেখা যায়নি।
বলতে গেলে, বাংলাদেশেও আজানবিরোধী একটি চক্রকে মাঝে-মধ্যে সরব হয়ে উঠতে দেখা যায়। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে তারা আজানের শব্দে বিব্রতবোধ করে এবং মুঘ ভাঙার অভিযোগ করে। তারা যে শ্রেণীর লোকই হোক না, ইহুদি প্রেতাত্মাগুলো ওদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে কিনা, এরূপ প্রশ্ন অনেকেরই। তারা আজানে পরিবেশ দূষণের প্রভাব না কি দেখতে পায়। কিন্তু দেখতে পায় না হাজারো রকমের পরিবেশ বিনাশী তৎপরতা। আজানের শব্দ শুনলে যাদের ঘুম ভেঙে যায় এবং গা-জ্বালা হয়, তারা একবারও ভেবে দেখেছে যে, আজানে এমনকি বিষাক্ত মন্ত্রতন্ত্র রয়েছে, যা তাদের শান্তির ঘুম বিনাশ করে। কথিত আছে যে, সমাজে একশ্রেণীর লোক আছে, যারা আল্লাহু আকবর ধ্বনি শুনলে পালাতে থাকে। এ পলায়ন কিসের লক্ষণ। আজানের শব্দ শুনে ইবলিশ শয়তান পলায়ন করে বলে পবিত্র হাদিস হতে জানা যায়। সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে থাকে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অর্থাৎ যখন আজান দেওয়া হয় তখন শয়তান এত উচ্চ শব্দে পশ্চাদপসারণ করে যে আজানের শব্দ তার পাদের উচ্চ শব্দে শোনা যায় না। আজান শেষ হয়ে গেলে সে আবার আসে। ফের জামাতের জন্য যখন তাকবির বলা হয় তখন শয়তান আবার পালিয়ে যায়। একামত শেষ হয়ে গেলে সে পুনরায় আসে এবং নামাজিদের অন্তরে কুমন্ত্রনা দিতে থাকে। বলে, অমুক কথা স্মরণ কর, অমুক বস্তু স্মরণ কর, যা তার প্রথম হতে মনে আসছিল না। এমনকি নামাজি মনে করতেই পারছে না সে কত রাকাত নামাজ পড়েছে। (বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়ী)।
শয়তানের ‘দোরাত’ বলতে কী বোঝায়, এ সম্পর্কে মোহাদ্দেছীনের ব্যাখ্যা আছে। অনেকে বলেছেন, ‘খুরুজেরীই’ অর্থাৎ বায়ু নির্গত হওয়া, যা প্রচলিত অর্থে ‘পাদ’কে বোঝায়। এতে স্পষ্ট যে, আজানের শব্দে শয়তান ভীষণভাবে ভীত ও বিচলিত হয়ে ওঠে, স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে না, সে নোংরা বদবু-দুর্গন্ধ বিকটভাবে ছড়াতে থাকে, যাতে আজানের শব্দ তার কানে প্রবেশ করতে না পারে। কাজেই বলা যায়, শয়তানের দোসররাই আজানে ভয় পায়।
মানুষকে কোনো খবর বা বিষয় অবহিত করার জন্য ইসলামের পূর্বে প্রচলিত যেসব নিয়মরীতি অনুসৃত হতো সেগুলো কোনো না কোনো রকম বুতপুরস্তি প্রতিধ্বনিত করত এবং তা তাওহীদের পরিপন্থী ছিল। ইসলাম যেহেতু একটি বিশ্বধর্ম, এই ধর্মের ইবাদতের জন্য প্রয়োজন ছিল মানুষকে আহŸান করার এবং অবহিত করার, এমন একটি সহজ সরল নিয়ম প্রবর্তন করা, যাতে তাওহীদের আহŸান ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে মনোভাব প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ, ইসলাম প্রচারের ঘোষণায় সর্বজনীন আহŸানের মাধ্যমে প্রত্যেক বসতি এলাকার নিকটবর্তী লোকদের কান পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত বিনা প্রতিবন্ধকতায় অতি সহজে পৌঁছে দেয়াই ছিল ‘আজান’ প্রথার আসল লক্ষ্য, যাতে মুক্তির দিশাও রয়েছে। ইসলামের সমস্ত এবাদতের মূল কেন্দ্র যেহেতু ঐক্য ও সমষ্টির ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত জামাতে নামাজ আদায় করার কোনো নির্দিষ্ট আলামত না থাকায় এই উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব ছিল না; তখন পর্যন্ত লোকে অনুমানের ভিত্তিতে নামাজ আদায় করতÑ যা হুজুর (সা.) পছন্দ করতেন না। সেহেতু এসব লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম একটি প্রথা চালু করার প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। হুজুর (সা.) প্রথমে মনে করলেন যে, নামাজের সময় হলে ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদেরকে ডাকার জন্য কিছু লোক নিয়োগ করা উচিত। কিন্তু এতে কিছু অসুবিধা দেখা দেয়ায় হুজুর (সা.) সাহাবাগণকে পরামর্শ করার জন্য একত্রিত করেন যে, মানুষকে নামাজের জন্য সমবেত করার লক্ষ্যে কোন নিয়মের অনুসরণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্নজনে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেন। এতদ-সম্পর্কিত উত্থাপিত বিভিন্ন প্রস্তাবের সারমর্ম এইÑ (১) মজুসী (অগ্নি উপাসকদের) ন্যায় কোনো উচ্চ স্থানে অগ্নি প্রজ্বলিত করা। (২) নামাজের সময় মসজিদের একটি পতাকা উত্তোলন করা। (৩) শিঙ্গায় ফুৎকার করা যেমনÑ ইহুদিরা করে। (৪) খৃস্টানদের ন্যায় ঘণ্টা বাজানো। এসব পদ্ধতির সবটাই ছিল ইহুদি, খৃস্টান ও মজুসীদের মধ্যে প্রচলিত। এর কোনোটাই রাসূলুল্লাহ (সা.) পছন্দ করলেন না।
সুতরাং প্রথম দিনের এই বৈঠকে কিছুই সিদ্ধান্ত হলো না। পরের দিন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এসে তারও একটি মত ব্যক্ত করেন। কিন্তু হজরত উমর (রা.) ঐ সময় হুজুর (সা.)-এর খেদমতে আরজ করেন যে, তিনি স্বপ্নযোগে আজানের প্রচলিত শব্দগুলো অবগত হয়েছেন। বোখারীর বর্ণনা মতে, হজরত উমর (রা.) বলেন : ‘আওয়া তাবআছুনা রাজুলান ইউনাদি বিছছালাতি”। অর্থাৎ নামাজের আহŸান করার জন্য একজন লোক প্রেরণ করা হোক। হজরত উমর (রা.)-এর এই আহŸান সকলের মত থেকে ভিন্ন ছিল এবং হুজুর এই মতই পছন্দ করেন। কোনো কোনো ছহীহ হাদিস গ্রন্থে আছে যে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাইদ (রা.) আজান স্বপ্নে অবগত হন এবং হুজুর (সা.)-কে তা জানান। মোট কথা, রাসূলুল্লাহ (সা.) অহীর মাধ্যমেও প্রচলিত আজানের কথা অবগত হয়েছিলেন।
তাই তিনি হজরত বেলাল (রা.)-কে ডেকে উচ্চৈঃস্বরে আজান দিতে নির্দেশ দেন। হুজুর (সা.) নিজেই ‘আছছালাতু জামেয়াতুন’ বলে আজানের কথা ঘোষণা করেন। এভাবে কয়েকজন সাহাবির স্বপ্ন হজরত উমর (রা.)-এর প্রস্তাব এবং হুজুর (সা.) অহীর মাধ্যমে প্রচলিত আজান পদ্ধতি চালু করেন। এটি হিজরী ২/৬২২ সালের ১২ ই অক্টোবরের ঘটনা।
আজানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হলো। বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মুসলিম সমাজে আজান কেবল নামাজের জন্য আহŸানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ ঐতিহ্য সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বিশেষত কোনো মুসলিম পরিবারে সন্তান জন্মলাভ করলে এ নবজাতকের কানে আজান একামত দেওয়া ছাড়াও অগ্নিকাÐের সময়, ভূমিকম্প দেখা দিলে এবং বালা মুসিবত তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে ও বিপদ আপদের সময় আজান দেওয়ার প্রথা প্রচলিত, যা ইসলাম সম্মত বিধান বটে। আজানের ধর্মীয় গুরুত্ব তো আলাদা। যারা মুসলমান হিসেবে মুসলিম রীতি প্রথা অনুসারী তারা আজানের গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারে না। এমনকি ধর্মকর্মে যারা বিশ্বাসী কিন্তু তা পালন করে না তারাও দেখা যায় ঘরে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে আলেম বা মসজিদের মুয়াজ্জিনের শরণাপ্ন হয় নবজাতকের কানে আজান দেয়ার জন্য।
আজান আল্লাহর এক অপূর্ব অবদান এবং তা কেবল মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট। নামাজের জামাতে শরিক হওয়ার জন্য আজানের ভূমিকা অতুলনীয়। আজানের শব্দ যতদূর পর্যন্ত পৌঁছবে তত বেশি লোক (নামাজি) শ্রবণ করবে এবং জামাতে অংশগ্রহণ করে অনেকে সৌভাগ্যবান হতে পারে। দুই কানে অঙ্গলি দিয়ে আজান দিলে আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেকালে মাইকের মতো কোনো আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমানে মাইকে আজান দেয়ার সুন্দর সুব্যবস্থা চালু হওয়ায় তা পছন্দ নয় যাদের, তারা তাতে বিব্রত বোধ করবে এটা অস্বাভাবিক নয়। যেসব লোক এবাদতে খলল বা ওয়াস ওয়াসা সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত তারা এবং তাদের অনুসারী চেলাচামুÐারা আজানের শব্দ সহ্য করতে পারে না। শয়তান ‘ইউওয়াস ভিমু ফিছুদুরিন নাস’Ñ শয়তান মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়, যা তার অভ্যাস। সুতরাং শয়তানের খপ্পরে পড়ে যারা হাবুডুবু খায় তাদের পক্ষে আজানের শব্দ হজম করা সম্ভব নয়।
মাঝে মধ্যে আমাদের দেশেও আল্লাহদ্রোহী, আজানবিরোধী, কিছু লোককে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যায়। এমন কি কারো কারো ধ্বংসাত্মক তৎপরতা হতে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনগণও নিরাপদ থাকেন না। অতএব আজানবিরোধী চক্র হতে সাবধান সতর্ক থাকা যেমন প্রয়োজন, তাদেরকে চিহ্নিত করাও তেমনি প্রয়োজন। আজানকে নিয়ে বিদ্রæপ করা, মশকরা করা ইত্যাদি গোস্তাখি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আলেম সমাজ ও ইসলামদরদী সকলকে সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে এবং যারা বোঝে না তাদেরকে উত্তম রূপে বোঝাতে হবে। তাদেরও উচিত হবে আজানের মর্মবাণী অনুধাবনের চেষ্টা করা এবং আজানকে উপহাস-অবজ্ঞা করা হতে বিরত থাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন