বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম যাচাই ও নিবন্ধনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে দেশব্যাপী মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধন যাচাই করার প্রক্রিয়া চলছে। গত ডিসেম্বর থেকে মোবাইল ব্যবহারকারীদের সিম যাচাইয়ের এ প্রক্রিয়া সরকার বাধ্যতামূলক করেছে। এপ্রিল পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি গ্রাহককে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে সিম যাচাই করতে হবে। ইতোমধ্যে প্রায় দেড় কোটি গ্রাহক এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন। আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে সিম যাচাইয়ের এ প্রক্রিয়া নিয়ে ইতোমধ্যে ইতি এবং নেতিÑ এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক দিক তুলে বেশ প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। কেউ কেউ আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার সময় বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে দেখতে বলছেন। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এতে একজন গ্রাহকের ব্যক্তিনিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। এটি খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তারা বলছেন, ফিংগার প্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ একমাত্র রাষ্ট্র ও এর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংরক্ষণ করতে পারে। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কোনো বেসরকারি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তা রাখতে পারে না। কারণ তার সার্ভার থেকে যদি কোনো কারণে আঙ্গুলের ছাপ প্রকাশ হয়ে পড়ে, তবে তা গ্রাহকদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে দেশি বা আন্তর্জাতিক দুষ্ট চক্র ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করে যে কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। দেখা যাবে, কারও আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে কোনো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, অথচ ওই ব্যক্তি কিছুই জানে না। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের বেশির ভাগ মোবাইল কোম্পানি বিদেশি হওয়ায় আঙ্গুলের এই ছাপ দেশের বাইরে পাচার হওয়ারও আশঙ্কা করছেন অনেকেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো যতই বলুক, তারা অতি যতেœ ও গোপনীয়তায় গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করবে, তারপরও সন্দেহ থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। টেকনোলজির এ যুগে কে কখন কোন দিক দিয়ে ঢুকে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে নেবে, তার গ্যারান্টি পাওয়া খুবই মুশকিল। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি একই ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে একই কোম্পানির একাধিক সিম ব্যবহার করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব সিম অপরাধমূলক কর্মকা-েও ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলো কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। ফলে আঙ্গুলের ছাপ যে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রকাশিত হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিছুকাল আগে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন দেশের গোপনীয় তথ্য পাওয়ার জন্য নির্মাণের সময়ই নতুন কম্পিউটারের মধ্যে এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম চিপ বসিয়ে দেয়া হয়েছে, যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এই অপকর্মের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ওঠে। অভিযোগ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র কোনো কোনো দেশের আমদানিকৃত নতুন কম্পিউটারে মাইক্রোচিপ বসিয়ে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে সে ওইসব দেশের রাষ্ট্রীয় অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করে। শুধু কম্পিউটারই নয়, আমেরিকার তৈরি ব্ল্যাকবেরি ব্র্যান্ডের মোবাইলেও মাইক্রোচিপ বসিয়ে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে অনেক দেশের গোপন তথ্যাদি সংগ্রহ করার অভিযোগও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ওঠে। এ নিয়ে তুলকালাম কা- ঘটে যায়। কাজেই আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে, আমাদের জনগণের আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার কাজ যেভাবে বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তাতে তাদের আঙ্গুলের ছাপ কতটা নিরাপদ থাকবে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং তা উঠেছেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার নেতিবাচক দিকের বিবরণ উল্লেখ করে অনেকে গ্রাহককে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করা ঝুঁকিপূর্ণ। বেসরকারি বিদেশি কোম্পানিগুলো আমাদের ফিংগার প্রিন্ট সংগ্রহ করছে, যা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। আগামী দিনে যখন ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে পাসওয়ার্ড প্রথা উঠে যাবে এবং ফিংগার প্রিন্টের ব্যবহার শুরু হবে, তখন যে কেউ সহজে যে কারও গুরুত্বপূর্ণ একাউন্টের এক্সেস নিতে পারবে। তারা প্রশ্ন তুলে বলছেন, আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সরকার তার প্রয়োজনে জমা রাখতে পারে। বেসরকারি কোম্পানি কেন রাখবে? একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি স্বীকার করেছে, তাদের ডিজিটাল ফিংগার প্রিন্ট জমা করা ছাড়া বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন সম্ভব নয়। তাদের কাছে এ প্রযুক্তিও নেই। প্রতিষ্ঠানটির কথা অনুযায়ী, এরকম অরক্ষিত অবস্থায় ফিংগার প্রিন্ট দেয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলছেন, এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুন। জঙ্গি ও অপরাধী দমন করতে সিম নিবন্ধন করা অবশ্যই জরুরি। তবে সেটা করা হোক বিকল্প কোনো উপায়ে। অনেকে প্রশ্ন তুলে বলছেন, যে বিদেশি কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ভুয়া নিবন্ধন তৈরি করতে পারে, তারা যে গ্রাহকদের ডিজিটাল ফিঙ্গার প্রিন্টের অপব্যবহার করবে না, তার গ্যারান্টি কি?
দুই.
বায়োমেট্রিক কি তা হয়তো আমরা অনেকে পরিষ্কারভাবে বুঝি না। অক্ষর-জ্ঞানহীন তো বটেই, অনেক শিক্ষিত লোকজনেরও আধুনিক এ প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্মক ধারণা নেই। বায়োমেট্রিক একটি অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এর ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানে ভয়ংকর অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকরণ কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ পদ্ধতি ব্যবহার করে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত আলামত থেকে অপরাধীর ফিংগার প্রিন্ট সংগ্রহ করে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ফিংগার প্রিন্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। মিলে গেলে সহজেই তাকে শনাক্ত করা যায়। বায়োমেট্রিকে শুধু ফিংগার প্রিন্ট নয়, মানুষের চেহারা, হাতের গঠন, চোখের আইরিশ, রেটিনা, কণ্ঠস্বর, শিরা ও হাতের লেখাও অন্তর্ভুক্ত। এসব ব্যবহার করে একজন মানুষকে সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায়। বলা যায়, এসব এক ধরনের শনাক্তকরণ চিহ্ন। আমরা হলিউডের সিনেমায় এসবের ব্যবহার অহরহ দেখতে পাই। তবে আমেরিকায় সাধারণ মানুষের ফিংগার প্রিন্ট শনাক্তের এ প্রক্রিয়াকে তাদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বলে সেখানের মানবাধিকার কর্মীরা বরাবরই প্রতিবাদ করে আসছে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিংগার প্রিন্টের ব্যবহার সর্বপ্রথম শুরু করে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। ১৯২৪ সালে সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ফিংগার প্রিন্ট সংগ্রহ করা শুরু করে। এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও অপরাধীদের শনাক্ত করা। ফিংগার প্রিন্ট এমনই এক চিহ্ন যা কখনো পরিবর্তন করা যায় না। আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার পর এর ছবি সংরক্ষণ করা হয় না। সংরক্ষণ করা হয় আঙ্গুলের রেখাচিত্র। এ রেখাচিত্র বাইনারি পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। গণনা করে যে নম্বরটি পাওয়া যায়, তাই সংরক্ষণ করা হয়। এই নম্বর অন্য কারও আঙ্গুলের রেখাচিত্রের নম্বরের সঙ্গে মিলবে না। ফলে নির্ভুলভাবে যে কাউকে শনাক্ত করা যায়। বলা যায়, কোনো ব্যক্তির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে ফিংগার প্রিন্ট। এটি কেবলমাত্র ওই ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার নাগরিকদের এই ফিংগার প্রিন্ট সংরক্ষণ করতে পারে। এগুলো কেবলমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থার কাছে জমা থাকবে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে সংরক্ষণ করা যাবে না। আমরা দেখেছি, জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় আমাদের সেনাবাহিনী পুরো কাজটি সমাপ্ত করেছে। নাগরিকের যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্যসহ আঙ্গুলের ছাপও নেয়া হয়েছে। সে সময় এ নিয়ে তেমন প্রশ্ন উঠেনি। এর কারণ এটি সরকারের নিজস্ব সংস্থার মাধ্যমে করা হয়েছে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়নি। এবারের ফিংগার প্রিন্ট সংগ্রহের কাজটি করা হচ্ছে বেসরকারি বিদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। এখানেই সচেতন নাগরিকদের আপত্তি এবং শঙ্কা। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান যতই বলুক, গ্রাহকের ফিংগারপ্রিন্ট তারা সযতেœ রাখবে এবং কোনোভাবেই ফাঁস হবে না, তাদের এ কথায় সচেতন শ্রেণি নিশ্চয়তা ও আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ মোবাইল কোম্পানিগুলো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়। যে কোনো সময় যে কোনো কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে পারে, আবার মালিকানা পরিবর্তনও হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এসব মোবাইল কোম্পানি কোটি কোটি ভুয়া নিবন্ধনের মাধ্যমে সিম বিক্রি করেছে। তারা তো কখনো এসব সিম ভেরিফাই করেনি। এর কারণ হচ্ছে, তাদের মুখ্য উদ্দেশ ব্যবসা, দায়বদ্ধতা নয়। যত বেশি সিম বিক্রি হবে, তত বেশি তাদের লাভ। এমন দায়িত্বহীন বেনিয়া মনোবৃত্তির প্রতিষ্ঠানের কাছে কি জনসাধারণের ফিংগার প্রিন্ট নিরাপদ থাকতে পারে? আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, মোবাইলে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে। এখনও ছড়ানো হচ্ছে। ইউটিউবে এসব কথাবার্তার রেকর্ড অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। এতে গ্রাহকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে। তদ্রƒপ ফিংগার প্রিন্ট যে অন্যের হাতে চলে যাবে না, এ নিশ্চয়তা কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই যেসব সচেতন মানুষ বিষয়টি বুঝতে পেরেছে, তারা এর প্রতিবাদ ও অন্যদের সতর্ক করার দায়িত্ব পালন করছে। বলা যায়, তারা অনেকটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বই পালন করছে।
তিন.
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আলোচনা-সমালোচনা দেখে ফেসবুকের মাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আঙ্গুলের ছাপ এনআইড বা ন্যাশনাল আইডিতেও আছে, ছিল আগের সিম বা রিম রেজিস্ট্রেশন ফর্মেও এবং এগুলো সব অপারেটরের কাছেও ছিল। এখন কোন সিম কার সেই নিয়ম মেনে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ ভেরিফিকেশন করতে আপনাদের ভয় কিসের? সন্ত্রাসী এবং অপরাধী ছাড়া এই পদ্ধতি ভয় পওয়ার কথা নয়। আপনার সিমের মালিক যে আপনি সে জন্যই এনআইডির ডাটাবেজের সঙ্গে এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে শুধু আপনার আঙ্গুলের ছাপটি মিলিয়ে নেয়া হচ্ছে। সিম কিনলে আপনি সিমের মালিকানা কেন স্বীকার করবেন না? এই পদ্ধতি বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সব নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য। সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে এটা সবার জন্য প্রযোজ্য হতো না। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এই ডাটাবেজে প্রবেশ করতে পারবে। যা ইতোমধ্যে আপনার এনআইডিতেও আছে। এখন শুধু এই আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। একটি এনআইডির বিপরীতে পূর্বে যেমন ৬০ হাজার বা এর অধিক সিম পাওয়া গেছে সেটা এড়াতেই এখনকার এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। সুতরাং দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আপনারা সবাই এ পদ্ধতিতে সিম/রিম রেজিস্ট্রেশন করুন। কোনো মিথ্যা সংবাদে বিভ্রান্ত হবেন না। আপনারা আমাদের জনগণ, আমরা আপনাদের জনপ্রতিনিধি, আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।’ তারানা হালিমের এ ব্যাখ্যার সঙ্গে আপাত দৃষ্টিতে খুব বেশি দ্বিমত করা যায় না। তার কথার মূল নির্যাস হচ্ছে, রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা। এ হিসেবে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তবে কিছু বিষয়ের সঙ্গে সচেতন মানুষ দ্বিমত পোষণ করতেই পারে। তারা সরকারের এ উদ্যোগ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করছে না, বরং এটিকে স্বাগত জানাচ্ছে। আপত্তি শুধু বেসরকারিভাবে আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণ করার মধ্যে। মোবাইল সিম নেয়ার সময় কোম্পানিগুলোর কাছে শুধু গ্রাহকের ছবি ও এনআইডির ফটোকপি জমা দেয়া হতো। সরাসরি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নেয়া হতো না। অনেক সময় রিটেইলাররা কাগজপত্র জমা ছাড়া এমনিতেই দিয়ে দিত। এ ব্যাপারে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে আপত্তি করতে বা দায়িত্ব পালন করতে দেখা যেত না। কারণ তারা সিম বিক্রির বিষয়টিকেই বড় করে দেখত। এ প্রেক্ষিতে সচেতন মহল মনে করছে, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ মিলানোর মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি কোনোভাবেই বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত হয়নি। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির মাধ্যমে প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে করা যেত। এ কথাও বুঝতে হবে, মানুষের মধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিটি নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠেছে। এনআইডির সময় তো এ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি করেনি। এর কারণ, তারা জানত কাজটি সরকার করেছে এবং তাদের তথ্যাদির নিরাপত্তা সরকারই দেবে।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিংগার প্রিন্ট সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও সন্ত্রাসী চিহ্নিত করা। তবে সচেতন মহলমাত্রই জানে, যারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত, তাদের শনাক্ত করা খুব কঠিন কিছু নয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট তাদের তালিকা রয়েছে। ইচ্ছা করলেই সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করতে পারে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা বরাবরই দেখেছি অনেক মন্ত্রী-এমপির আশপাশে সন্ত্রাসীদের ঘোরাফেরা করতে। পত্র-পত্রিকায় গোল চিহ্ন দিয়ে তাদের ছবিও ছাপা হয়েছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখিনি। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের সঙ্গে তাদের সখ্যের কথাও কারও অজানা নয়। এ কথাও প্রচলিত, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছা করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিহ্নিত ও দাগী সন্ত্রাসীদের ধরে ফেলতে পারে। এ দক্ষতা ও যোগ্যতা তাদের রয়েছে। তাহলে ধরা হচ্ছে না কেন? কারণ সন্ত্রাসীরা বরাবরই ক্ষমতাসীন দলসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকে। তারা যদি পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়, তবে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- অনেক কমে যাবে। আর যে চিহ্নিত সন্ত্রাসী তাকে তো ধরাই হচ্ছে না বা ধরতে পারছে না। ধরতে পারলেই না কেবল তার আঙ্গুলের ছাপ মেলানো যাবে। প্রশ্রয়প্রাপ্ত পাকা ও দাগী সন্ত্রাসীদের আঙ্গুলের ছাপ নিলেই কি তাদের ধরা যাবে? একটা এনআইডির বিপরীতে আগে ৬০ হাজার সিম পাওয়ার যে কথা মন্ত্রী বলেছেন, এর বিপরীতে তো এ কথাও বলা যায়, এত অধিক সিম যেসব মোবাইল অপারেটর একই এনআইডিতে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? তারা কেন এত সিম এক ব্যক্তিকে দিল, তার জন্য কি কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়েছে? সবচেয়ে বড় কথা, এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে একজন গ্রাহক কয়টি সিম রাখতে পারবে, তার কোনো সংখ্যা তো সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয়নি। এখন একজন গ্রাহক যদি পাঁচটি মোবাইল কোম্পানির সিম নিতে যায়, তাহলে তো তাকে পাঁচবার আঙ্গুলের ছাপ দিতে হবে। আর একটি কোম্পানি থেকে যদি একাধিক সিম নেয়, তাহলেও তাকে একাধিকবার আঙ্গুলের ছাপ দিতে হবে। এই যে একজন গ্রাহককে এক বা একাধিক জায়গায় র‌্যান্ডম আঙ্গুলের ছাপ দিতে হচ্ছে বা দিতে হবে, তাতে কি এই ছাপ গোপন থাকবে? আর একজন গ্রাহককে একটি সিম যাচাই ও নিবন্ধন করতে কয়বার আঙ্গুলের ছাপ দিতে হবে? মোবাইল কোম্পানিগুলো যদি গ্রাহকের নিজস্ব নম্বরের সময় একবার এবং তার অজান্তে বিভিন্ন ছুঁতোয় একাধিকবার ছাপ নিয়ে অন্য নতুন নম্বরের রেজিস্ট্রেশন করে নেয়, তখন কী হবে? সিম বাণিজ্যের জন্য কোম্পানিগুলো যে এ সিম অন্য কারও কাছে বিক্রি করবে না এর গ্যারান্টি কোথায়? এ ছাড়া সরকার কি বলবে, একজন গ্রাহক শুধু একটি মাত্র সিম ব্যবহার করতে পারবে, একাধিক সিম ব্যবহার করতে পারবে না? এ নিয়ে ভাবার বিষয় রয়েছে।
চার.
সরকারের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিংগার প্রিন্ট নিয়ে রেজিস্ট্রেশন বা যাচাই কাজের উদ্যোগের বিরোধী কেউই নয়। বিরোধিতা শুধু বেসরকারি ও বিদেশি মোবাইল কোম্পানিকে দিয়ে কাজটি করানো নিয়ে। একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের কাজ সরকার না করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানো কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। সচেতন মানুষমাত্রই এ সিদ্ধান্ত মানতে পারে না। সরকার নিজে যদি করে, তাহলে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি কেউই করত না। একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তারা এর বিরোধিতা করছে। এর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, উন্নত বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো কীভাবে অন্য দেশের তথ্য সংগ্রহ ও ফাঁস করে দিয়েছে। আমরা যদি উইকিলিকসের কথা ধরি, তাহলে সহজেই বুঝতে পারব, কঠোর গোপনীয়তার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের স্পর্শকাতর বিষয় কীভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। আঙ্গুলের ছাপ বেসরকারি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়ার অর্থ তো একপ্রকার শেয়ালের কাছে মুরগি রক্ষার দায়িত্ব দেয়ার মতো। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত হবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির এ প্রক্রিয়া বাতিল করে নিজ উদ্যোগে তা পুনরায় শুরু করা। কারণ এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং রাষ্ট্রকেই তা সংরক্ষণ ও রক্ষা করতে হবে। ফাঁস হওয়ার ন্যূনতম শঙ্কা যেখানে রয়েছে, সেখানে কোনোভাবেই এ কাজ করতে দেয়া উচিত নয়। আমরা এটাও মনে করি, শুধু সিম নয়, মোবাইল সেট রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ একটি সিম যত সহজে নষ্ট বা ফেলে দেয়া যায়, একটি সেট তত সহজে ফেলে দেয়া যায় না। এতে অপরাধীর অবস্থান জানাসহ তাকে গ্রেফতার করার কাজটিও সহজ হবে। 

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন