মোহাম্মদ আবদুল গফুর : সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্ষমতায় না থাকলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকর্মী সম্মেলনে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, অবৈধ পথে সম্পদ অর্জন করলে তাদের কেউ শেষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকতে পারবেন না। ক্ষমতার বাইরে যাবার পর তাদের অবৈধ টাকা নিয়ে পালিয়ে থাকতে হবে অথবা দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।
জনাব ওবায়দুল কাদেরের এ হুশিয়ারী উচ্চারণ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। এজন্য তাঁকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েও বলবো, তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে কঠোর বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্প্রতিকালে এ দু:খজনক প্রবণতা দেখা দেয়ার কারণও যদি স্পষ্টভাবে নির্দেশিত হতো তা হলে তাঁর এ বক্তব্য আরও অর্থপূর্ণ হতো।
অবশ্য জনাব ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের মধ্যেই অস্পষ্টভাবে হলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষমতায় থাকার সুযোগেই যে দলের নেতাকর্মীরা অবৈধ পথে সম্পদ আহরণ করে চলেছে তার ইঙ্গিত রয়ে গেছে। তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে অবৈধ সম্পদের কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পালিয়ে থাকতে হবে অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। এর অর্থ এই যে, অন্যায় পথে সম্পদ অর্জনকারীরা শুধু দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার কারণে অবৈধ পথে সম্পদ আহরণ করেও নিরাপদ থেকে যায়, এজন্য দায়ী তারাও যারা দলের নেতৃত্বে থেকে শুধু মাত্র দলের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনকারীদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। এটা দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অধ:পতনের একটা প্রমাণও বটে।
এখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্যের উপর কিছুটা আলোকপাত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আওয়ামী লীগের জন্ম হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। যে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয় তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন। এর অর্থ হলো আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কর্মীদের একাংশের দ্বারা। সে নিরিখে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ধারাবাহিকতার ইতিহাস ঢাকায় জন্ম নেয়া নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সূচনা পর্ব ১৯০৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
আওয়ামী লীগের এই সুদীর্ঘ সাংগঠনিক ধারাবাহিকতার কারণে স্বাভাবিকভাবে এই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলীয় সংহতি যথেষ্ট মজবুত। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টি (বিএনপি)-এর জন্ম বাংলাদেশ আমলে হওয়ায় এবং এ দল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলছুট অংশ ও অন্যান্য অরাজনৈতিক লোকদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় এ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাংগঠনিক সংহতি বোধ আওয়ামী লীগের তুলনায় অনেক কম।
কিন্তুু আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির বয়স এত কম হওয়া সত্বেও এত অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপি বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটিতে উন্নীত হয়ে উঠতে পেরেছে, এটাও বিএনপির জন্য কম কৃতিত্বের কথা নয়। সে নিরিখে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে বিএনপির অবদান মোটেই কম নয়। অথচ নির্মম বাস্তবতা এই যে, আওয়ামী লীগের জন্ম যেখানে পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক কর্মীদের সম্মেলনে, সেখানে বিএনপির জন্ম এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার উদ্যোগে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণাুুু বিএনপির এই অভাবনীয় সাফল্যের মূলে ছিল এর প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তি জীবনের আদর্শবাদী বৈশিষ্ট্য যার অনেকটাই পরবর্তীতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আর তেমন ভাবে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে দেশের কল্যাণকামী নেতাকর্মীদের এবং রাজনীতি সচেতন জনগণের অনেক কিছুই শিক্ষা গ্রহণের রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে এদেশের জনগণের সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অবদান থাকলেও বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল বন্ধ করে দিয়ে একমাত্র একটি সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই অকল্পনীয় কার্যটি সমাধা হয় এমন এক নেতার শাসন আমলে, যাঁর সারা জীবন কেটেছে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে। অনেকের মতেই একদলীয় বাকশালীব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর নিজের ছিল না। এর পেছনে ছিল বাকশালী ব্যবস্থার অন্যতম নেতা কমরেড মনি সিংহের মূল ইন্ধন। কারণ তিনিই বাকশালী ব্যবস্থার সমর্থনে এক পর্যায়ে বলে ছিলেন, বাকশাল কোন একাংক নাটক নয়, বহু অংকের নাটক। এর শেষ অংকের শেষ দৃশ্য না আসা পর্যন্ত এর প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করা যাবে না। সম্ভবত মনি সিংহ তাঁর “স্বপ্নের” আদর্শ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলেই বাংলাদেশে গড়তে চেয়ে ছিলেন অথচ বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করার ফলে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরির্বতনের সুযোগের অনুপস্থিতিতে তার নির্মম খেসারত দিতে হয় বঙ্গবন্ধুকে।
যাই হোক পরবর্তীতে বহু অকল্পনীয় ঘটনাবলীর পর দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুন: প্রতিষ্ঠিত হবার পর একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্ত্রনুুুু সেবা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা। এটা বাস্তবে সম্ভব হয়েছিল হয়তো এই বিবেচনায় যে ঐ উৎত্থাত হওয়া নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এটা কিন্তু আওয়ামী নেত্রীর গণতন্ত্র-প্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
এভাবেই শুরু হয়েছিল জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈর শাসন। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল এরশাদের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেও বহু দিন আওয়ামী লীগ এ আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগও এক পর্যায়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু ততদিনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আপোষহীন নেত্রী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। পরবর্তীতে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দয়ীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে একমত হয় দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
যেমনটা আশা করে গিয়েছিলো, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নিজের ভোটকেন্দ্রে ভোট দানের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন এর মধ্যে আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষে দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিএনপি। শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে।
এরপর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। খালেদা সরকারের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত শেখ হাসিনার দাবির মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়। এই বিধান মতে দেশে বেশ কটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং পর পর দুই প্রধান দল জয়ী হয়ে পালাক্রমে সরকার গঠন করে। এর পর এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হওয়ায় বিএনপি অতীতের সমঝোতা ভঙ্গের অভিযোগে নির্বাচন বয়কট করে।
দেশের একটি প্রধান দল নির্বাচন বয়কট করায় নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হয়। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকারী দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মী ইচ্ছামতো ব্যালটপত্রে সিল মেরে বিপুল ভোটে সরকারী দলের প্রার্থীদের ‘জয়ী’ হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সাধারণ মানুষ এই নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন আথ্যা দেয়। সেই ভোটার বিহীন নির্বাচনে জয়ী সরকারই বর্তমানে দেশ চালাচ্ছে।
উপরোক্ত পরিস্থিতির নিরিখে বলা যায় বাংলাদেশে বর্তমানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন। স্বাভাবিক কারণেই শাসকদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে অবৈধভাবে সম্পদ আহরনের একটা প্রকট প্রবনতা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের আওয়ামী নেতা কর্মীদের মধ্যকার এই অশুভ প্রবনতার মূল কারণ দূর না করে শুধু মৌখিক হুশিয়ারী উচ্চারণ করেই এই অবাঞ্ছিত প্রবনতা দূর করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন