আফতাব চৌধুরী
হাজারো মামলার ভিড়ে কত রায়ে কত আবেগ লুকিয়ে থাকে, আমরা কেউ কি তার খবর রাখি? রাখি না বলে কত ঘটনা-দুর্ঘটনা প্রাত্যহিক প্রবাহের মতো আমাদের অলক্ষ্যে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। আবার কিছু কিছু ঘটনা মিডিয়ার বদৌলতে আমাদের কাছে এমন একটা ফ্লোবিয়ার জন্ম দেয়, যা আমরা ভুলে যেতে চাইলেও ভুলে যেতে পারি না। অথবা এসব ঘটনা সমাজের জন্য একটি সংকেতবাহী হয়ে থাকে বলে এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা নিরবচ্ছিন্নভাবে জারি থাকে। মানুষ অশেষ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে এসব ঘটনার পরম্পরার দিকে। সাম্প্রতিক কালে ভারতের দুই উচ্চ আদালতের দুটি পৃথক সিদ্ধান্ত আসমুদ্রহিমাচলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। নাড়িয়ে দিয়েছে কারণ, এই দুই সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভারতবাসীর আবেগ জড়িয়ে ছিল। ছিল অনেক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনাও। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই দুই ঘটনার অন্তিম পরিণতি বা ক্লাইমেক্স সে দেশের একাংশ মানুষকে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি বরং অনেক চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রত্যাশার বিপরীতে সিদ্ধান্ত হওয়ায় অনেকের মধ্যে আদালত এবং বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক অবস্থান নিয়ে কিছুটা অবিশ্বাসের অনাকাক্সিক্ষত বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার প্রতি নাগরিক সমাজের এহেন নেতিবাচক মানসিকতা মোটেই শুভ ইঙ্গিতবাহী নয়। অথচ আদালতের দুটি সিদ্ধান্তের অন্তরালে যে অনেক বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটা অনেকের কাছে ধোয়াশাচ্ছন্ন। ফলে জনমানসে এক অনভিপ্রেত অবিশ্বাসবোধ ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কেন এমন হবে? স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় কারও হস্তক্ষেপ চলে না। তাই বলে উচ্চ আদালতগুলো যদি কেবল নিজেদের নীরব দর্শক ভাবে তবে সেটাও দুর্ভাগ্যজনক। আইনের কাছে আবেগের স্থান নেই, সেটা সত্য কথা। কিন্তু আবেগের মধ্যে যদি গণমতের প্রতিফলন এবং দাবি প্রকট হয়, তা হলে সেটা আইনের অনুধাবন করার কথা। কারণ প্রতিটি আইন তৈরি হয় সমাজের সার্বিক স্বার্থে এবং মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে। তারপরও যদি কোনো আইন জনকল্যাণের সহায়ক না হয়ে বিপরীতধর্মী হয়ে ওঠে, তখন সেই আইনের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আইন আল্লাহর তৈরি নয়। মানুষের জন্য মানুষের বানানো আইনে মানুষের কল্যাণ নিহিত থাকতেই হবে। ভারতের প্রতিটি আইনের হোতা এবং প্রধান কারিগর সে দেশের জনগণ। জনগণের দ্বারা নির্বাচিতরাই আইন প্রণয়ন করেন। আদালত নামক প্রতিষ্ঠান সেই আইনকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। অথচ কার্যক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, অসংখ্য আইন কেবল লাইব্রেরির শোভাবর্ধন করে। বাস্তবে কোনো কাজে লাগে না। আবার এমন কিছু আইনও আছে যা পরোক্ষভাবে অপরাধকে উৎসাহিত করে। মেনে নিতে আপত্তি নেই যে, ভারতীয় আইন চায় দশটা অপরাধী খালাস পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরীহ মানুষকে অহেতুক জেলের ঘানি টানতে না হয়। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায়, কিছু আইনের শিথিলতা বিচারপ্রার্থীর ক্ষতবিক্ষত অন্তরের নিদারুণ যন্ত্রণাকে পরিহাস করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো হয়ে যায় যদিও সে ধরনের আইনকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
আদালতের রায়কে যথাযথ সম্মান জানিয়ে কেবল নাগরিক অধিকার থেকে বলতে হচ্ছে, এই দুটি বিচারের অন্তিম পর্যায়টা একাংশ মানুষের কাছে অভিপ্রেত হয়নি। এটা সত্য যে, আদালত প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত আইনের চার দেয়ালের সীমায় আবদ্ধ। বলাবাহুল্য, আদালতই একমাত্র ভরসা এবং বিশ্বাসের জায়গা। ফলে আদালতের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। বিচার ব্যবস্থায় খুব সন্তর্পণে দুর্নীতির বেনোজল ঢুকে গেলেও অন্যান্য স্তম্ভের মতো আদালতের ভিত এত নড়বড়ে হয়ে ওঠেনি এখনো। আর তাতেই জনগণ আদালতকে ন্যায়ের আলয় এবং বিচারকদের আল্লাহর দূত বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই বিশ্বাসবোধে যেভাবে চিড় ধরতে শুরু করেছে, সেই বিপজ্জনক প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অমঙ্গলই ত্বরান্বিত হবে, এটা নিশ্চিত। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার গরিমাকে অক্ষুণœ রাখতে আদালতকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। যাদের অদক্ষতা এবং উদাসীনতার জন্য বিচারব্যবস্থার মান তলানিতে যাচ্ছে বা বিচারপ্রক্রিয়া প্রহসনে পরিণত হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করতে আইনি এখতিয়ারের মধ্যে থেকে আদালতকে কিছুটা সদর্থক পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। আসমুদ্রহিমাচল কাঁপানো দিল্লিø গণধর্ষণ মামলা শুধু ভারত নয়, বলতে গেলে সারা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ধর্ষিতার হয়ে রাস্তায় নেমেছিল গোটা ভারতের ন্যায়প্রার্থী মানুষের প্রতিবাদী মিছিল। গণদাবির কাছে নতজানু হয়ে সরকার আইন বদলের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। ফলে গত ২০১৩ সালে সংশোধিত হয় ভারতীয় দ-বিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধির বেশ কটি ধারা। সংশোধনের পর বদলে যায় নারীঘটিত অপরাধের অনেক সংজ্ঞাও। কঠোর আইনি বেড়াজাল দিয়ে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের অপরাধকে হ্রাস করতে আইন সংশোধন কতটা কাজে লেগেছে, সেটা অবশ্য জানি না, তবে নির্ভয়ার পরও যে ভারত ধর্ষণের মতো অপরাধের মাত্রা কমেছে, সেটা বুকে হাত দিয়ে বলা যায় না। ক্রিমিনাল অ্যাক্ট সংশোধনের মাধ্যমে অন্তত শিথিল আইন অনেকটা শক্ত হয়েছে, সেটাই আসল কথা। এখন আর কোনো মেয়ের গায়ে অসৎ উদ্দেশ্যে হাত দিলে খুব সহজে বেরিয়ে যাওয়া যাবে না। সেটাই জনগণের বা ন্যায় আকাক্সক্ষীদের কাছে মস্ত প্রাপ্তি। নির্ভয়ার পর প্রতিবাদের ঢেউয়ে সরকার হাত-পা গুটিয়ে থাকতে পারেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তরা ধরা পড়ে। আর যথারীতি সাজাও ঘোষিত হয়। কিন্তু যে অপরাধী সবচেয়ে নৃশংসতা করেছে, তার শাস্তি বিচারপ্রার্থীদের হতাশ করেছে। আইনের ফসকা গেরোয় সে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র তিন বছরের জন্য তাকে চাইল্ড হোমে থাকতে হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এই সেদিন যখন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, তখন বিভিন্ন সংগঠন এমনকি নির্ভয়ার বাবা-মাকেও পথে নামতে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো ফায়দা হয়নি। আইনের গ-িবদ্ধতার কথা স্বীকার করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও তথাকথিত নাবালকের মুক্তি রদ করতে পারেনি। নাবালকের মুক্তির পর থেকে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে সঙ্গতকারণে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু আদালত যে একটা সীমারেখায় থেকে কাজ করে, সেই বাস্তবটা গণআবেগের কাছে চাপা পড়ে গেছে। অথচ সত্যিকার অর্থে এই মুক্তি কোনো অবস্থায় আটকাতে পারতেন না আদালত। সেটা করতে গেলে আদালত নির্ঘাত ভুল করে ফেলতেন। পরবর্তীতে আরও জটিলতা বাড়তে পারত। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো আইন বা আইনের ধারা বিধিগতভাবে বলবৎ থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই আইন অনুসারে আদালতকে চলতে হয়। যারা আইনপ্রণেতা, তারা যদি দেশের ক্ষতিকর বা অকল্যাণকর আইন বদল না করেন, তা হলে কেবল আদালতের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। আদালত প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যা করে এবং সেই আইনের মূল কাঠামোয় থেকে সেটার ব্যবহারকে কিছুটা প্রসারিত বা সঙ্কুচিতও করতে পারে। কিন্তু পুরো একটা আইনকে, যদি সেটা সাংবিধানিকভাবে বৈধ থাকে, তা হলে সেটাকে সরিয়ে নিতে পারে না। তবে হাইকোর্ট কিংবা সুুপ্রিমকোর্ট জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে আইনটির প্রয়োগ-প্রসার বা সংশোধনের জন্য সরকারকে নির্দেশ না হলে পরামর্শ দিতে পারে বা সরকারের অভিমত জানতে পারে। এর বেশি আদালতের এখতিয়ার নেই। নতুবা অতি সক্রিয়তা বা গ-ি অতিক্রমের জন্য আদালত সমালোচিত হতে পারে। তাই নাবালকের মুক্তি ঘটতে পেরেছে। জনগণ যদি এমন একটা সুবিধাজনক আইন না চায়, তা হলে অতি শীঘ্র যে সেই আইনের পরিবর্তন জরুরি, সেটা আইন বিভাগ, সরকার, ল’কমিশনের অনুধাবন করা উচিত আরেক চর্চিত মামলা থেকে খালাস পেয়ে গেছেন সালমান খান। টানা ১৩ বছর মামলা চলার পর তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আইনের ধোপে টিকতে পারেনি। নিম্ন আদালত তাকে শাস্তির সাজা শোনালেও উচ্চ আদালতে তিনি বেকসুর খালাস পান। এই মামলার রায়ও দেশের অনেক মানুষকে খুশি করতে পারেনি। দোষ যদি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হয় বা ট্রায়াল কোর্টের বিচারে বিচ্যুতি থাকে উচ্চ আদালত শাস্তির রায় খারিজ করে দিতে পারেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই মামলায় সালমান খানের জামিন নিয়ে উচ্চ আদালতের অতি তৎপরতার কথা এখনো কেউ ভুলে যাননি। নিম্ন আদালত সাজা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই জামিন পেয়ে ঘরে ফেরেন বলিউডের এই নায়ক। আর এবার হাইকোর্ট তাকে খালাস করে দেওয়ায় অন্তত এটাই মনে হচ্ছে, চরম অস্বস্তিকর টানাপড়েনের পর শেষ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ জয় পেলেন তিনি। অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক মামলার হাইপ্রোফাইল আসামিকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছেন আদালত। বহুচর্চিত হিট অ্যান্ড রান মামলায় বলিউডের হার্টথ্রোব সালমান খানের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থ সরকার পক্ষ। তাই আইনের স্বাভাবিক পথ ধরে অভিযোগ থেকে নিষ্কলুষভাবে বেরিয়ে গেলেন তিনি। নিম্ন আদালতের শাস্তির রায়কে খারিজ করে মুম্বাই হাইকোর্ট অভিনেতাকে সসম্মানে খালাস দেন। ফলে সঙ্গত কারণে খুশি খান পরিবার এবং তার অনুগামীরা। আর তার চেয়ে বেশি আনন্দিত বলিউড। শুধু কান্না লুকোতে পারেনি সেই পরিবার, যে এক নিকটজনকে হারিয়েছে। টানা এক দশকেরও বেশি সময় আইনি লড়াই এবং প্রতিনিয়ত এক অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে চলতে চলতে হয়রান হওয়া একজন মানুষ যদি অবশেষে মুক্তির স্বাদ পান, তা হলে আহ্লাদিত হওয়ারই কথা। এ তো একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। অভিনেতা সালমান খানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আদালতের রায় শুনে এজলাসে দাঁড়িয়ে থাকা সালমানের অশ্রুসিক্ত এবং আবেগাপ্লুত খুশির ধারা অন্তত সেটাকেই প্রতিফলিত করেছে। সালমান মামলা থেকে রেহাই পান, সেটা তার অগণিত ভক্তের প্রার্থনা ছিল। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার পর উচ্চ আদালতে মুক্তি একেবারে অপ্রত্যাশিত না হলেও কিছু কিছু মানুষের ধারণা ছিল, হয়তো ট্রায়াল কোর্টের রায়ই বহাল থাকবে। কিন্তু তার মুক্তি নিয়ে সে দেশের একাংশ মানুষের অন্তরে যে ভিন্নতর ভাবনার উদ্রেক করেছে কিংবা নিহতের পরিবারে যে হতাশার গহ্বর তৈরি হয়েছে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই। আর এই পেক্ষাপটেই আইন আদালত নিয়ে জনমানসে কিছুটা নেতিবাচক ধারণার জন্ম হচ্ছে। তবে এই মামলার বাদী-বিবাদীপক্ষ যেভাবে আদালতের রায়কে শিরোধার্য করে নিয়েছে, তাতে আমরাও সেই রায়কে সম্মান জানাচ্ছি।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন