নুরুল আবছার চৌধুরী, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) থেকে : কর্ণফুলী পেপার মিলস লি: ব্যবসায়ীদের বকেয়া পাওনা বাবদ প্রায় সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা দেনার ভারে কারখানাটি জর্জরিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মিলে উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ১০-২৫ টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস পাওয়ায় কারখানাটি যে কোন মূহুর্তে চিরতরে বন্ধ হতে পারে। মিলের মেহনতি শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা গত প্রায় ২/৩ মাস যাবত বন্ধ রয়েছে। অবসরে যাওয়া প্রায় ২৫০ শ্রমিকের পাওনা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ মিল কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করতে পারছে না। সম্প্রতি কর্ণফুলী কাগজ কলে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা মারা গেলে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে দাফন করা হচ্ছে। অথচ মিলের নিকট এসব শ্রমিকদের পাওনা রয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। ঐতিহ্যবাহী মিলকে বাঁচাতে ইতিমধ্যে শ্রমিক, কর্মচারী ও সাধারন জনতা মিলে ‘কেপিএম বাঁচাও ঐক্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কর্ণফুলী কাগজ কলের কাঁচামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারদের কোটি কোটি টাকা পাওনা আদায়ের লক্ষে এবং মৃতপ্রায় কর্ণফুলী কাগজ কলকে রক্ষার দাবিতে ২৩ মে ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিশাল মানববন্ধন করার উদ্দ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কেপিএম আর্থিক সংকটের কারনে পার্বত্যঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ একাবারে কমে গেছে। যার ফলশ্রæতিতে গত এক মাস ধরে বাঘাইছড়ি উপজেলার অতি দুর্গম সাজেকে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনাহারে শতশত মানুষ দিনাতিপাত করছে বলে জানা গেছে। কেপিএমের কন্ট্রাকটার মোহাম্মদ ফরিদ আহমদ জানান, মিলের ৪৫ হাজার একর নিজস্ব ক‚প এরিয়ায় প্রায় ৭শ’ পরিবারের দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বাঁশ আহরণ ও পরিবহন এবং জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পার্বত্যঞ্চলের বাঁশ ও নরম কাঠের পরিবর্তে বর্তমানে কেপিএমে বিদেশী পাল্প ব্যবহার হচ্ছে। দেশীয় পাল্প কারখানায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় সাজেক, বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর, কাউখালী, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী উপজেলায়, খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা, মানিকছড়ি, দীঘিনালা, পানছড়ি, লক্ষীছড়ি, মহালছড়ি, রামগড় এবং বান্দরবান জেলা সদর, থানচি, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম, রোয়াংছড়ি সহ কেপিএমের ক‚প এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক মানবেতর দিনযাপন করছে। বাঁশ ব্যবসায়ী হাজী আব্দুস সাত্তার বলেন, কাঁচামাল সরবরাহকারী ঠিকাদাররা তাদের সব্বোচ্চ পুঁজি বিনিয়োগ করে এখন প্রায়ই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বকেয়া পরিশোধ করার ব্যবস্থা নেয়া হলে আবারও ঘুঁরে দাঁড়াতে পাারে কর্ণফুলী কাগজকল। কর্ণফুলী কাগজ কলের বর্তমান শ্রমিক সংখ্যা ৫শ’ হলেও শ্রমিকদের বরাদ্দকৃত ৩ হাজার বাসায় শ্রমিকেরা মিল কর্তৃপক্ষ ও সিবিত্র যোগসাজসে অবৈধভাবে বসবাস করছে। উক্ত বাসা সমূহে মিলের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারের কারনে মিল কর্তৃপক্ষ প্রতিমাসে কোটি অপচয়ের মাধ্যমে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
কেপিএম সূত্রে জানা যায়, বাৎসরিক ৩০,০০০ টন ধারণক্ষমতা নিয়ে ১৯৫৩ সালে মিলটিতে উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৯১ সালে কেপিএম নিজের রুগ্নতা কাটিয়ে উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে কাগজ রপ্তানি করতে সক্ষম হয় এবং ওই বছরে ৪,১০২ জন শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ১৯৯০-৯১ সালে কেপিএম-এর সংস্থাপিত ধারণ ক্ষমতা ছিল ৩৩,০০০ টন, প্রাক্কলিত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৮,৪৩৮ টন ও প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০,২১৬ টন। কেপিএম-এর উৎপাদিত কাগজের মধ্যে রয়েছে লেখার কাগজ, ছাপা ও মুদ্রণের কাগজ, করোগেটেড বোর্ড, মোমের প্রলেপযুক্ত কাগজ, আঠাযুক্ত ফিতা এবং বিটুমিন কাগজ। ২০০৯-১০ সালে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪,২০১ টন। বর্তমানে কর্ণফুলি পেপার মিলস প্রতি টন কাগজ ৭৯,০০০ টাকায় বিক্রি করে। কাগজ বিক্রির জন্য কেপিএম-এর ২,০৪৬ জন ডিলার রয়েছে।
প্রায় সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা মিলের কাছে ঠিকাদার ও কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পাওনা রয়েছে। বর্তমানে মিলে চিপার হাউজ এবং বাঁশ কেন্দ্রে ৪০ কোটি টাকার বেশী মূল্যের বাঁশ ও নরম কাঠ (পাল্পউড) জাতীয় কাঁচামাল মজুদ রয়েছে। অব্যাহত সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় কাঁচামালের মজুদের পরিমান আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ কর্তৃপক্ষ মজুদকৃত কাঁচামালের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। এতে কাঁচামাল সমূহ রোদে শুকিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে গুনগতমান নষ্ট হচ্ছে। এদিকে কর্তৃপক্ষের কোন দৃষ্টি নেই। বিদেশ থেকে ক্রয়কৃত পাল্প দিয়ে মিলের একাংশ চালু রেখেছে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কাচাঁমাল দিয়ে উৎপাদিত কাগজ বাংলাদেশে যে কোন কাগজকলের চেয়ে গুনগতমান শ্রেষ্ট। বর্তমানে কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজ চাহিদা প্রচুর কিন্তু সরবরাহ নেই। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. প্রকৌশলী এম এম আব্দুল কাদের বলেন, ঠিকাদারদের বকেয়া পরিশোধ না পর্যন্ত মিলের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বিদেশী পাল্পের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সাড়ে ৫শ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ ও ৫০ কোটি টাকার নগদ তহবিল দিলে আবারও পুরোদমে মিল চালু করা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন