হিমায়িত মৎস্য রপ্তানিখাত হুমকির মুখে : জেনারেটরে চালু কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে
আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রপ্তানি পণ্য চিংড়ি ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোর উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সময় মতো ডেলিভারি না দিতে পারলে বহিঃবিশ্বে মুখ থুবড়ে পড়বে হিমায়িত মৎস্যখাত। তাই জেনারেটরেই চলছে হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া। শুধু এই রপ্তানীখাত-ই নয়; অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঁধা বিদ্যুৎবিভ্রাট। তবে কবে নাগাদ লোডশেডিংয়ের হাত থেকে মুক্তি মিলবে; তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, একটি মুহুর্তও বিদ্যুৎবিহীন চলে না হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। চিংড়ি ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণে গড়ে প্রতিদিন দশ থেকে বারো ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন সচল রাখার প্রানন্তও চেষ্টা চালাচ্ছে কারখানাগুলো। ফলে প্রতি ঘণ্টায় হিমায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়তি জালানি তেল খরচ হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ লিটার। উৎপাদন খরচ বাড়লেও এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ পাবে না প্রতিষ্ঠানগুলো। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শতাধিক ছোট-বড় হিমায়িত চিংড়ি ও মৎস্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের চিংড়ি ও মাছ রপ্তানি হয় বিশ্বের ১৯টি দেশে। কিন্তু অব্যাহত লোডশেডিং ভোগান্তিতে পড়েছে এসব কারখানাগুলো। লোডশেডিংয়ের কারণে মাছের অন্যতম চাহিদা বরফ উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে তাদের। কবে নাগাদ লোডশেডিংয়ের হাত থেকে মুক্তি মিলবে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।
খুলনার আছিয়া সী ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে, পরবর্তীতে আর বায়ার (বিদেশী আমদানীকারকরা) পাবো না। তখন ভোগান্তিতে পড়তে হবে; রপ্তানীকারক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জাতীয় রাজস্ব আয় কমবে; তাতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বাড়তি অর্থ ব্যয়ে জেনারেটর চালিয়ে হলেও উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে হচ্ছে।
আছিয়া সী ফুড লিঃ খুলনার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রদীপ কুমার দে বলেন, সারাদিনে জেনারেটর-ই তো বন্ধ করতে পারছি না। লোডশেডিংয়ের কারণে অতিরিক্ত অর্থ খরচের পাশাপাশি যন্ত্রাংশেও ত্রæটি দেখা দিয়েছে।
শুধুমাত্র হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানই নয়, লোডশেডিংয়ে বরফকলগুলোও পড়েছে বিপাকে। বরফ উৎপাদন করতে পারছে না চাহিদা মতো। পর্যাপ্ত বরফের অভাবে সংগ্রহ করা মাছ সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
রপ্তানীকারকরা বলছেন, সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী এই শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না হলে রপ্তানি বাধাগ্রস্থ হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম হারাবে। তাই দ্রæত এ অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি তাদের।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি কাজি আমিনুল হক বলেন, বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক সভ্যতার একটি মুহুর্ত কল্পনা করা যায় না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, দু-তিনদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। যদি তাই হয়, তাহলে রক্ষা। না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শুধু রপ্তানী নয়; দেশের মানুষ বাঁচানো দায় হয়ে দাড়াবে। অবিলম্বে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে ওজোপাডিকো লিঃ খুলনার তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আবু হাসান বলেন, জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযোগ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। যা মেরামতের কাজ চলছে। তবে কবে নাগাদ ঠিক হবে এই মুহুর্তে বলা যাচ্ছে না।”
ওজোপাডিকো লিমিটেডের সূত্রমতে, গত বুধবার পদ্মার এপাড়ের ২১ জেলায় ওজোপাডিকো ও পল্লী বিদ্যুতে ডে পিক আওয়ারে চাহিদা ছিল ১১৫৭ দশমিক শুণ্য ৮ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ছিল ৮২২ দশমিক শুণ্য ৭ মেগাওয়াট; লোডশেডিং ছিল ৩৩৫ দশমিক ১ মেগাওয়াট। আবার পিক আওয়ারে (সন্ধ্যায়) চাহিদা ছিল ১৬০২ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ছিল ৯৯৬ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, এখানে লোডশেডিং ছিল ৬০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট।
খুলনা মহানগর বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ গত ২৪ মে এক বিবৃতিতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদে দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহ এবং সেই সাথে অব্যাহত লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতম যন্ত্রনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সাথে সরকারকে মুখে বাগাড়ম্বর না চালিয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনের দাবি জানিয়েছেন খুলনা মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্মরণকালের সীমাহীন লোডশেডিং ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মানুষকে। কলকারখানার উৎপাদন শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ব্যবসা বাণিজ্যে সৃষ্টি হয়েছে স্থবিরতা। শ্রমজীবী মানুষের কর্মক্ষমতা কমে গেছে। জ্বর সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছেন সব বয়সী মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। হাসপাতালে আসন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রোগীদের নিরবিচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে বিদ্যুৎ না থাকার কারনে। স্কুল-কলেজে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। অতিষ্ঠ মানুষ বলতে বাধ্য হচ্ছেন, বিদ্যুৎ এখন যায় না, মাঝে মাঝে আসে। বিবৃতিদাতারা হলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম নুরুল ইসলাম দাদুভাই, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর শাখার সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু, কেসিসি’র মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা ও কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন