বেনাপোল অফিস : দেশের প্রধান স্থল বন্দর বেনাপোলে পন্য ও যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে দু’দেশের আমাদনি রফতানি বাণিজ্য। বন্দর থেকে পণ্য খালাসে দীর্ঘ সূত্রতার কারণে প্রায়শই বন্দরটিতে লেগে আছে জট। অথচ, দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দরটি থেকে সরকার বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করলেও বন্দরে চোখে পড়ার মত তেমন একটা উন্নয়ন হয়নি আজো। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় দু’দেশের মধ্যে । বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে বছরে প্রায় ১২ লাখ পাসপোর্ট যাত্রী যাতায়াত করে ভারত-বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বন্দর দিয়ে অত্যন্ত কম সময়ে দ্রæত পণ্য আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। বেনাপোল বন্দরে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য রাখার জন্য ৪০টি শেড রয়েছে। যার অধিকাংশই ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বন্দরের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সব সময়ই বন্দরে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন পণ্য রাখা হচ্ছে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ মালামাল ঝুঁকি নিয়ে রাখা হচ্ছে ঠাসাঠাসি করে। এমনকি অনেকসময় ট্রাক টারমিনালে রাখা হচ্ছে বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ। জায়গা সংকটে সব সময় কয়েক শ’ ভারতীয় ট্রাক মালামাল নিয়ে বন্দরে বা বন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকছে রাস্তার ওপর। সেগুলোর পণ্য রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে।
এদিকে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানিতে গতি বাড়াতে বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রোপোলে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক ইন্টিগ্রেটেড চেকপেস্ট। সেখানে এক হাজার থেকে দেড় হাজার ট্রাক রাখার ব্যবস্থা, পুরো বন্দর এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, রয়েছে উন্নতমানের সড়ক ব্যবস্থা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি ওয়্যার হাউজ, চোরাচালান প্রতিরোধে স্ক্যানিং ব্যবস্থাসহ আরো অনেক আধুনিক ব্যবস্থা। বেনাপোল বন্দরে ওই একই সুবিধা থাকার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা গড়ে তোলা হয়নি। বন্দরটি আজো আটোমেশনরে আওতায় আনা হয়নি। এখনো মান্ধাতার আমলের মতো হাতে লিখে কাজ সারেন বন্দরের কর্মকর্তারা। মালামাল পুড়ে গেলেও হিসেব পাওয়া যায় না ক্ষয়ক্ষতির।
বেনাপোল স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, জায়গা সংকটের কারণে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ, গাড়ি ও ক্যামিকেলসহ শত শত কোটি টাকার পণ্য। নষ্ট হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান। বন্দরের শেডে জায়গা না থাকায় শেডের বাইরে রেল লাইনের পার্শ্বের গর্তে পড়ে আছে ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের গাড়ি। বন্দর অভ্যন্তরে নতুন শেড নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তার উন্নয়নের কাজ চলছে খুবই ধীর গতিতে। সামান্য পানি হলে বন্দরে জমে হাঁটু পানি। বৃষ্টির পানি-কাদায় নষ্ট হয় পণ্য। কাদায় হাঁটা-চলা করাও যায় না। বন্দরে আমদানিকৃত মালামাল লোড-আনলোডের জন্য ভাড়া করা অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট নষ্ট থাকায় বিঘœ ঘটছে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া।বন্দরের ক্রেন ফরক লিফট এর জন্য ৩ জন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়ার দাবি ব্যবসায়ীদের। বন্দরে সিসি ক্যামেরা না থাকায় দেদারছে চুরি হচ্ছে পণ্য। চুরিতে বাধা দিতে গিয়ে সম্প্রতি এক আনসার সদস্য চোর চক্রের হাতে জীবন দিয়েছেন। এরপরও বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বেনাপোল বন্দরে জনবল সঙ্কটের কারণে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। প্রতিটি শেডে দেখা যায়, স্টোরকিপাররা এক-দুইজন করে বাইরের লোক রেখে দিয়েছেন কাজ এগুনোর জন্য। পণ্য চুরির এটিও একটি কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন আমদানিকারকরা। বন্দরের সামনে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের দোকানে। সেখানে বন্দরের আমদানিকৃত পণ্য কিনতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি বেনাপোল স্থলবন্দরে ৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। এই কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। উন্নয়ন কাজে ব্যবহার হচ্ছে পুরাতন আধলা ইট, খোয়া এবং নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী। এডিবির অর্থায়নে এ বন্দরের উন্নয়ন কাজ করছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনিকো লিমিটেড। দুই বছরের মধ্যে তাদের এই কাজ সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। এসব উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে, নতুন দুটি গুদাম, চারটি ওপেন শেড, পানি নিষ্কাশনের ড্রেন, বন্দরের অভ্যন্তরের সড়ক ও ইয়ার্ড নির্মাণ। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানের কাজ হওয়ার কথা। এমন দশা অবাক করেছে তাদের। ৪৫ বছরের পুরনো বিল্ডিং ভেঙে সেখান থেকে ইট নিয়ে নতুন করে শেড তৈরি করলে তা যে কোনো সময় ধসে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সরকার এই বন্দর থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন বন্দরে তেমন একটা উন্নয়ন চোখে পড়েনি। পণ্য খালাসে বিলম্ব ও অর্থনৈতিক ক্ষতিতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরে যানজট, পণ্য জট ও ক্রেন ফরকলিফট সমস্যা দীর্ঘদিনের। বন্দরে অত্যাধুনিক ইক্যুইপমেন্ট’র ব্যবস্থা করতে হবে দ্রæত। বেনাপোল স্থলবন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) আ: রউফ বলেন, বেনাপোল বন্দরে ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। কাজ সম্পন্ন হলে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা থাকবে। সাময়িক কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, কাজ শেষ হলে বন্দরে কোনো সমস্যা থাকবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন