শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিশাল বাজেট : চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ

| প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট। এ বাজেটকে অর্থমন্ত্রী নিজে উচ্চাভিলাষী বললেও বাস্তবায়ন অসম্ভব নয় বলে মনে করেন। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ অর্থনীতিবিদদের সার্বিক যে প্রতিক্রিয়া তাতে এর নেতিবাচক দিকই সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে। সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বলেছেন, এ বাজেট লুটপাটের বাজেট। নিজেদের পকেট ভারি করতেই এ বাজেট। বাংলাদেশ কমিউনস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, এ বাজেট গরীব মারার ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বাজেট। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলেছে, ১৫ শতাংশ ভ্যাট হারের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবু আহমেদ বলেছেন বাজেটে বিনিয়োগবান্ধব তেমন কিছু নেই। বাজেট নিয়ে এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি পত্র-পত্রিকাগুলো বাজেটের যে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতেও এবারের বাজেটের নেতিবাচক দিকটিই বেশি ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ বাজেট নিয়ে সরকারি মহল ছাড়া অন্যদের কেউই খুব বেশি খুশি ও আশাবাদী হতে পারছে না। অবশ্য বাজেট ঘোষণার আগেই অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবারের বাজেট হবে চাপাচাপির বাজেট। চাপাচাপি এবারই করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, বাজেটের অর্থ আহরণ ও জোগান দিতে জনগণকে চেপে ধরতে হবে। তাদের পকেট থেকে চাপাচাপি করে পয়সা বের করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী এমন এক সময় বাজেট ঘোষণা করলেন, যখন গ্যাসের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ৯৫০ টাকা হয়ে গেছে।  বাজেটেও ঘোষণা দিয়েছেন ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম আরো বাড়বে। বিদ্যুতের দামও বাড়বে। মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ৫০ টাকা। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সংকটজনক অবস্থায়। চালের মজুদ সর্বকালের সর্বনি¤œ অবস্থায় রয়েছে। এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতিতেই সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা চাপানো হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সাধারণ মানুষের সামনে দুর্দিন রয়েছে। তাদের চিঁড়েচ্যাপ্টা করার যত পন্থা রয়েছে, সবই অবলম্বন করা হবে। বাজেটের আকার যে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, তার ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষকে প্রতি পদে পদে ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হবে। দেয়ার মতো অর্থ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে হলে ভ্যাট, ট্যাক্স দিতেই হবে। এ থেকে মুক্ত থাকার কোনো উপায় নেই। সবচেয়ে বেশি এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শিকার হবে সাধারণ ও দরিদ্র মানুষ। অথচ সরকার কথায় কথায় দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে থাকে। দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি বিরাট অংশই যদি সরকার ভ্যাটের মাধ্যমে কেটে নিয়ে যায়, তবে তাদের দারিদ্র্য মোচন হবে কিভাবে? বলা যায়, এবারের বাজেটের মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণীকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষের সঞ্চয় বলতে এখন কিছু থাকবে না। ব্যাংকে অর্থ রাখলে সেখানে লাভের পরিবর্তে তাদের লোকসান গুনতে হবে। ১ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখলে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হবে, পাশাপাশি ব্যাংকের দেয়া মুনাফার উপর শতকরা ১৫ ভাগ হারে কর ও ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ কাটার পর দেখা যাবে, ১ লাখ টাকায় লাভ দূরে থাক, তা কমে ৯৮-৯৯ হাজার টাকা হয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী যে চাপাচাপির বাজেট বলেছেন, এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, তিনি যতভাবে সম্ভব সাধারণ মানুষকে চেপে ধরেছেন। এর মাধ্যমে যে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে, এ দিকটি তিনি মোটেও বিবেচনায় নেননি। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট বিনিয়োগ ও বেকার সমস্যা। বেশ কয়েক বছর ধরে  বেসরকারি বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। এ ব্যাপারে সরকারের তেমন উদ্বেগ আছে বলেও মনে হয় না। থাকলে বিনিয়োগ খরা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যেত। এবারের বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকে গেছে। বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, গ্যাস-বিদ্যুত সংযোগের অভাব, অবকাঠামো ও সুশাসনের অভাবÑ এসব ব্যাপারে যে ধরনের সংস্কার ও উৎসাহমূলক পদক্ষেপ দরকার, তা বাজেটে নেই। এতে দেশে বিনিয়োগের যে ঋণাত্মক পরিস্থিতি চলছে, তা অব্যাহতই থেকে যাবে। সরকার এদিকে মনোযোগ না দিয়ে কেবল জনগণের পকেট কেটে কীভাবে রাজস্ব আদায় করা যায়, সেদিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। জনগণ যাবে কোথায়? ভ্যাট-ট্যাক্স তাদের দিতেই হবে। জনগণের পকেটের দিকে সরকারের এই অপদৃষ্টি বেশ কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবারের বাজেটের মাধ্যমে তা প্রসারিত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগের সাথে কর্মসংস্থানের বিষয়টি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোটি কোটি কর্মক্ষম বেকার। এর সাথে কলকারখানা বন্ধ হয়ে নতুন বেকারের সংখ্যা যুক্ত হচ্ছে। এদের কর্মসংস্থানের জন্য এবারের বাজেটে তেমন কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ফলে দেশে আগামীতে বেকারের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কল্পনাও করা যায় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কোন স্তরে পৌঁছবে, তা এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাটে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, জিনিসপত্রের উপর ভ্যাট বসবে, দাম বাড়বে নাÑএমন কথা কেউ শুনেছে কিনা, আমাদের জানা নেই।
বড় অংকের বাজেট ঘোষণা করা কোনো কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। এবারের বাজেট যদি ৫ লাখ কোটি টাকাও ঘোষণা করা হতো, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। যে কোনো অংকের বাজেট ঘোষণা করা যেতেই পারে। মূল বিষয় হচ্ছে, লক্ষ্য অনুযায়ী বাজেট বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে কিনা। আমরা দেখেছি, কোনো বাজেটেরই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না এবং কোনো বাজেটই তার কাক্সিক্ষত মাত্রায় লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এবারের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও বিশ্লেষকদের শঙ্কা রয়েছে। তবে বাজেটে সাধারণ মানুষের উপর চাপাচাপির যেসব বিষয় থাকে, সরকার সেগুলো ঠিকই বাস্তবায়ন করে। মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলার যত রকমের পদক্ষেপ আছে তা নিতে দ্বিধা করে না। অন্যদিকে বাজেটের আকার বৃদ্ধির অর্থ এর আয়ের ক্ষেত্র বৃদ্ধি করা। এই আয় বৃদ্ধি করতে গিয়েই সাধারণ মানুষের পকেটে এখন সরকারের হাত পড়েছে। বাজেটে বড় বড় প্রকল্পকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিক এসব প্রকল্পে ইতোমধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, আরও ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রকল্প মানেই বরাদ্দ এবং বরাদ্দ মানেই অনিয়ম ও দুর্নীতির দিগন্ত প্রসারিত করা। আবার শুধু বাজেট প্রণয়ন করলেই হয় না, তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাও থাকতে হয়। সুন্দর সুন্দর প্রতিশ্রæতি দিয়ে এক বছরের মধ্যে রাতারাতি সব পরিবর্তন করে ফেলা এক প্রকার অসম্ভব। স্বপ্নের ফানুস উড়ানো এক ধরনের প্রবঞ্চণার শামিল। কাজেই অতি উচ্চাভিলাষী হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে চাপে ফেলার বাজেট কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমরা মনে করি, সাধারণ মানুষের সমস্যা হয়, বাজেটে এমন প্রস্তাবগুলো পুনঃবিবেচনা করা হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় অন্তরায় হয়ে রয়েছে, সেগুলো দূর করার কার্যকর প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে পারে, বাজেটকে এমনভাবে সংশোধন ও পরিমার্জন করা উচিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন