আবদুল আউয়াল ঠাকুর : গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য গোটা জাতি যখন গভীরভাবে উদগ্রীব হয়ে আছে ঠিক সে সময়ে উপজেলা নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। নির্বাচন যেখানে মানুষের প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যম সেখানে নির্বাচনের আগেই বিশিষ্টজনরা মন্তব্য করেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে হতাশা সৃষ্টি হবে। অসন্তোষ দেখা দেবে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে। তারা মনে করছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের। কিন্তু প্রশাসন স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে আর নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে। তারা আরও মনে করছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় নেই। এটি আমাদের জন্য একটি অশুভ সংকেত। এই বাস্তবতায় দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অভিযোগ করছে, বাধার কারণে তাদের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কথার সত্যতা মেলে প্রকাশিত রিপোর্টেও। বলা হয়েছে, ভোটের আগেই সরকারদলীয় বহু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এটাও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নজিরবিহীন ঘটনা। নানা বাধা পেরিয়ে যারা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পেরেছেন তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে হুমকি দিচ্ছেন সরকারি দলের কেউ কেউ। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে এই বলে যে, প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে বাড়িঘরে আগুন জ্বলবে। লাশ পড়ে থাকবে পথেঘাটে। থাকবে না বাড়ির হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, মহিষও। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণ। কার্যত বিরোধীদের মাঠে নামাই সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ভোটের আগেই নির্বাচনের পরিবেশ ও ফলাফল নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপি এসবই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে নির্বাচন চাওয়ার চেয়ে নির্বাচনবিমুখ থাকাই এখন বেহতের।
জনগণের মধ্যে নির্বাচন ভাবনায় নানা প্রসঙ্গ রয়েছে। যে সময় চলছে তাতে হয়তো সবার অবস্থা এক নয়। হওয়ার কথাও নয়। সরকারের সঙ্গে যাদের নানাভাবে সম্পর্ক রয়েছে তাদের হাতে হয়তো কিছু পয়সাকড়ি রয়েছে। যারা দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত তাদেরও হয়তো দিনকাল খারাপ নয়। কিন্তু যারা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চাচ্ছেন তাদের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মাস শেষে বেতনের ওপর যাদের একান্ত নির্ভরশীলতা তাদের যে অংশ বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত তাদের মধ্যে পদপদবি যাই থাক মাস শেষে কতজন বেতনভাতা পাচ্ছেন তা এখন অনেকটাই গবেষণার ব্যাপার। চাকরি করে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। সাধারণভাবে এখন পর্যন্ত গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে সবদিক থেকেই কিছু লক্ষণীয় ব্যতিক্রম রয়েছে। শহরের মানুষের টিকে থাকার সঙ্গে আর্থিক সঙ্গতির সম্পর্ক আর গ্রামের মানুষের সম্পর্ক এক নয়। গ্রামের মানুষের নিয়মিত বাসাভাড়া দিতে হয় না। খাদ্য তালিকা নিয়েও তাদের মাথাব্যথা কম। ঘরে চাল থাকলে শাকসবজি জুটিয়ে খেয়ে নিতে পারে। তেমনিভাবে গ্রামের মানুষের জীবনাচারেও রয়েছে ভিন্নতা। তাদের মধ্যে শত্রুতা-বৈরিতা কখনই এতটা মারাত্মক আকার ধারণ করে না যা পরস্পরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেয় বা দিতে পারে। এর অবশ্য একটি বড় কারণ প্রায় প্রতিদিনই তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয় বা করতে হয়। সাধারণভাবে মনে করা হয়, বাড়িগুলো আলাদা হলেও সব মিলেই যেন একটা বাড়ি। বিপদে-আপদে তারা একে অন্যের হয়ে কাজ করে থাকে। সে কারণে গ্রামীণ জনপদে স্থানীয় প্রতিনিধিদের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এসব নির্বাচন যে সবসময়ই নির্বিঘœ হয় সে কথা বলা যাবে না। আবার এ কারণে বড় ধরনের সমস্যা হয় তাও ঠিক নয়। সাধারণভাবে এতদিন পর্যন্ত দলীয় ভিত্তিতে না হওয়ার কারণে যেসব বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থীরা ভোটে দাঁড়িয়েছেন তার সঙ্গে নানা বিষয়ের সম্পর্ক রয়েছে। আবার এসব নির্বাচন যে একেবারে নির্দলীয় হয়েছে তাও যেমনি সত্যি নয়, তেমনি দলীয়ভাবে হয়েছে তাও সঠিক নয়। সবমিলে এক ধরনের ঐক্য ও সমঝোতাই এসব নির্বাচনের মূল কথা। এ ধরনের নির্বাচনে রাতে মশাল জ্বালিয়ে প্রার্থীদের ভোট চাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা যেমনি সচল থাকে তেমনি বাড়ি বাড়ি যাওয়া, পান-বিড়ি-সিগারেট-শাড়ি-লুঙ্গির আলোচনাও রয়েছে। সব মিলে এক ভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ যাবৎকাল। এবার তার ব্যতিক্রম ঘটতে যাচ্ছে। এসব প্রাসঙ্গিকতায় গ্রামীণ সম্পর্কে বোঝাতে একটি পুরনো প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলছি। যে সময়ের কথা বলছি সেটি সবারই বিবেচনায় থাকার কথা। তখনও গ্রামগঞ্জ মানেই খাল-বিলে পানি। কাঁচা রাস্তা। বাঁশের চাড় এসব আর কি। শহরের সঙ্গে গ্রামের সরাসরি যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না। এখন এ অবস্থা ভাবাই যায় না। সে সময়ে একটি নির্বাচনী কেন্দ্রে নির্বাচনের দিন একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তার কিছু বন্ধু নিয়ে প্রকাশ্য পিস্তল উঁচিয়ে ভোটের ক্যাম্পেইন করতে গেলে কেন্দ্রে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্তরা অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেও প্রকশ্যে কিছু বলেননি। একটি ভোট কেন্দ্র থেকে অন্য ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাঠে নামার পরই দেখা গেল প্রতিপক্ষের সমর্থকরা বড় বড় বাঁশ নিয়ে এমন তাড়া করল যে জীবন নিয়ে টানাটানি। এ ঘটনায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও যেমনি ঘটেনি, তেমনি নির্বাচনেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি। আবার নির্বাচনী ফলাফলের পরও এ নিয়ে ভিন্ন কিছু হয়নি। এটাই গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এবার নির্বাচনের আগেই যেভাবে জয় দিয়ে শুরু হয়েছে তাতে আলামত খুব ভালো মনে হচ্ছে না। কারণ একদিকে জাতীয় নির্বাচনের মতো জনগণ ভোট দিতে পারছে না, অন্যদিকে পারস্পরিক বোঝাপাড়ার সংকট থেকেই গেল। একটি অগ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের পর যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা সামনে রেখে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে জনপ্রিয়তা প্রমাণের এই প্রবণতা কার্যত সমস্যা আরও বাড়াচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসছে বলে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার যথার্থই বলেছেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে ভোটের আগে যে হানাহানি শুরু হয়েছে তা ক্রমশ বাড়বে।
এ বাস্তবতাতেই সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকা বাদ দিয়ে সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদে ২২ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে শুরু হতে যাচ্ছে নির্বাচন। প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন শেষ হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ধাপের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও শেষ হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী প্রথম ধাপে ৭৩৮ ইউপিতে ভোট গ্রহণ ২২ মার্চ। দ্বিতীয় ধাপে ৬৭২ ইউপিতে ভোট গ্রহণ আগামী ৩১ মার্চ। ইতোমধ্যেই এ নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা স্থান করে নিয়েছে। বলা হচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীদের অংশগ্রহণের আগ্রহ কমেছে। দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন হওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অন্যদিকে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকা নিয়ে শঙ্কাও প্রার্থী কমে যাওয়ার কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মামলার আসামিরাও রয়েছেন। স্কুলের গ-ি পার হননি এমন প্রার্থীরাও রয়েছেন। এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজেদের স্বাধীন সত্তাকে ভুলে গিয়ে সরকারের (নির্বাহী বিভাগ) ইচ্ছা পালন করছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও নির্বাচনটি তৃণমূল পর্যায়ের হওয়ার কারণে এর প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহের কোনো কমতি কোনোকালেও ছিল না। এখন তো অবস্থা এই যে, সরকারবিরোধী মনোনয়ন প্রার্থীদের অনেকাংশকেই দৌড়ের ওপর রাখা হয়েছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীরা দাঁড়াতেই সাহস পাননি। বিরোধী প্রার্থীর বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দিতেও দেয়া হয়নি। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য ক্ষমতাসীনদের চাপের মুখে আছেন বিএনপির কিছু প্রার্থী। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও এ চাপ মোকাবিলা করছেন। নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা অভিনব কৌশল অবলম্বন করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় এক দফা বাধার পর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপি প্রার্থীদের অনেকেই এখন নতুন ধরনের চাপে রয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এসব লাঘবে যে নির্বাচন কমিশনের জোরদার ভূমিকা পালনের কথা ছিল তারা এসব আমলে নিচ্ছে বলে মনে হওয়ার কোনো আলামত নেই। মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য প্রার্থীকে হুমকি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের পক্ষপাতিত্ব ও মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও ইসির সচিব বলেছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই অভিযোগে কার বিরুদ্ধে কখন ও কী অপরাধ তা উল্লেখ করতে হবে। তার কথা আর বর্তমান সময়ের একশ্রেণির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের কথায় কোনো পার্থক্য নেই। দেখা যাচ্ছে, অপরাধের সঙ্গে যখন সরকারদলীয় কারও নাম সম্পৃক্ত থাকে তখন নানা বাহানার কথা শোনা যায়। এমন অভিযোগ খোদ দায়িত্বশীলরাই করেছেন যে, থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অপদস্থ করে দলীয় নেতা-কর্মীরা গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে কিন্তু জঙ্গি, সন্ত্রাসী বা অন্য কোনো গুরুতর ধারায় অভিযোগ এনে কাউকে আটক করা হয়নি। আবার এটাও সত্যি যে, অপরাধ কখন কোথায় কীভাবে ঘটে তার বিবরণ সঠিক না হওয়ার কারণে মামলা ঠিকমতো এগোতে পারে না। আলোচ্য ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সচিব যা বলেছেন তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাচ্ছেন না বা এটা হয়তো তার এজেন্ডা নয় বরং তার বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে দায় এড়ানো। সচিব দাবি করছেন, এখন পর্যন্ত ইসি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পায়নি। বাস্তবতা তো এই যে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের তার উচিত নির্বাচন আক্রান্ত হতে পারে এ ধরনের যে কোনো অভিযোগ শোনার পর অভিযুক্তদের শনাক্ত করণে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া। তার পরিবর্তে তাদের কথায় নির্বাচন ভ-ুলকারীরাই যে আরও উৎসাহিত হবে সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। এসব কারণেই নির্বাচন যে প্রহসনে পরিণত হতে পারে সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এদেশে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচন শুরু হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। শুরু থেকেই এসব নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, সে সময়টা ছিল পরাধীনতার আমল। তখন ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থ পাকাপোক্ত করতে এক ধরনের তোশামোদকারী তৈরি করতে নানা প্রক্রিয়ার অনুসরণ করত। সে কারণে তাদের নানা ধরনের বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধাও দিয়ে থাকত। সে মানসিকতা থেকেই তারা তৃণমূল নেতৃত্ব বাছাই করত। এর নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পরবর্তীতেও ছিল। এখনো গ্রামে-গঞ্জে গেলে এমন উদাহরণ বিরল নয় যে সরকারি নানা অনুদান মূলত মেম্বার-চেয়ারম্যানরাই মেরে খেয়েছে। এমনকি রিলিপের টাকা সমবায়ের টাকাও মেরে খাওয়ার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। এসব অপরাধে কখনই উল্লিখিতদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন নজির পাওয়া ভার। একবার একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির গম মেরে খাওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছিল। মামলাটি শেষ পর্যন্ত উচ্চতর আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। গম মেরে খাওয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও মামলায় চেয়ারম্যানের কোনো সাজা হয়নি। শুনেছি, বলা হয়েছেÑ আলোচ্য ক্ষেত্রে গম পাচার হওয়াটাই কেবলমাত্র অপরাধ। তাই কাজ হলো কি মেরে দিল এটা কোনো বিষয় নয়। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে বলা যায়, স্বাধীনতার পর স্থানীয় পরিষদকে অনেকটা গণমুখী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেজন্য সংবিধানেও কিছু কথা বলা আছে। দেখা যাচ্ছে, উপজেলা পরিষদই তাদের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না, সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ এবং যারা কার্যত নানা বিবেচনায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন তাদের গণমুখী হওয়াটা কাঁঠালের আমসত্ত্বর মতোই। এ বিবেচনায় অতীতের আলোকে এবারের দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে দেখলে বলতে হবে জনগণের যেটুকু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বাস্তবতা ছিল তাও এবার বিদূরিত হলো। কারণ হয়তো দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত ভোটেরই প্রয়োজন হবে না।
২০১৪ সালে অগ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বিএনপির অবস্থা হয়েছে, না বললে বাপে হারাম খায়, বললে মায়ে মার খায়-এর মতো। নির্বাচনের সুষ্ঠুতা দাবি করলে হতে হচ্ছে জঙ্গি আর মেনে নিলে তার অর্থ হচ্ছে দেশ ও জনগণের ক্ষতি মেনে নেয়া। ইতিপূর্বে সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। এবারও ত্রিশঙ্কু বাস্তবতা। শেষ ভরসা জনগণই। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা জাতীয় এবং স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, অতীতে ছোটখাটো সংঘর্ষ ছাড়া এ ধরনের নির্বাচনে কখনো বড় ধরনের কোনো বিপত্তি হয়নি। সম্ভবত রাজনৈতিক ব্যানারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিধায় এবারই জাতীয় নির্বাচনের তিক্ত বিষয়গুলোর অবতারণা হতে যাচ্ছে। অগ্রহণযোগ্য প্রবণতার বিস্তৃতি ঘটতে যাচ্ছে তৃণমূল পর্যন্ত। এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে গ্রামে-গঞ্জে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিই নন, তারা গ্রাম-গঞ্জে সালিশ মধ্যস্থতাকারীও। স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ মেটাতে তাদের আন্তরিকতার কোনো জুড়ি নেই। এবার অধিকাংশ প্রার্থী ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে সেক্ষেত্রে ভিন্নতর সমস্যার গন্ধ রয়েছে।
যাই হোক, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে হয়তো অন্য কোনো প্রশ্নের জন্ম হতো না। এখন তো মনে হচ্ছে, দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অথবা নিরঙ্কুশ বিজয় দেখাতে যা করা হচ্ছে তাতে বিদ্বেষের আগুন তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। তার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা হয়তো এক্ষুণি বলা কষ্টকর। তবে ভয়াবহ হতে বাধ্য। এটা সবারই মনে রাখা দরকার, প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস দূষিত করা যত সহজ তা পুনরায় বিশুদ্ধ করা ততটা সহজ নয়। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনসাধারণের মনে যে আস্থা ও বিশ্বাসটুকু ছিল তা পরিপূর্ণরূপে ভেঙে গেলে বোধকরি কারও জন্যই মঙ্গলকর হবে না।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন