মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

আজ অশেষ কৃতজ্ঞতায় তাঁকে স্মরণ করছি

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী : বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি, সাবেক ধর্ম ও ত্রাণমন্ত্রী, মসজিদে গাউছুল আজম ও দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) ছিলেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বিচক্ষণ রাজনীতিক এবং এক মহান ব্যক্তিত্ব। তার দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ছিল বিরল। আমাদের মহানবী (সা.)-এর পর আর কোন নবী আসবেন না। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন জারি থাকবে। আর আল্লাহ তাঁর দ্বীন জারি রাখবেন হক্কানী ও মোহাক্কেক আলেমদের মাধ্যমে। মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) তাঁদেরই একজন। বর্ণাঢ্য, গতিশীল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী দেশের এই কৃতী সন্তান আমৃত্যু দেশ ও জনগণের খেদমতে নিবেদিত ছিলেন।
মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) একজন পীর খান্দানের লোক। তাঁর পিতা হযরত মাওলানা শাহ্ ইয়াছীন (রহ.) ও নানা উভয়ই ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে জামান হযরত মাওলানা আবুবকর সিদ্দীক (রহ.)-এর খলিফা। মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) এই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রক্ষা করে গেছেন। তাঁর বড় ভাই মাওলানা আব্দুস সালাম (রহ.)ও আজীবন তরিকত ও তাসাউফের খিদমত করে গেছেন।
মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) এদেশের সকল পর্যায়ের আলেম-উলামাদের ঐক্যবদ্ধ করতে চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে সকল স্তরের আলেম, পীর-মাশায়েখের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে আমার পীর ও মুর্শিদ আলেমকুল শিরোমণি শামসুল ওলামা, রঈসুল কুররা, ফখরুল মুহাদ্দেসীন ও মুফাসসিরীন, সিলেট তথা বাংলাদেশের গৌরব হযরত আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলার (রহ.)।
প্রখ্যাত আলেম, মোহাক্কেক মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বহুসংখ্যক মসজিদ-মাদরাসা এবং দৈনিক ইনকিলাব ইসলামী অঙ্গনে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতি ও শিক্ষক নেতৃত্বসহ সকল ক্ষেত্রে নজর ও বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কয়েকবার বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন। জাতীয় দুর্যোগ মূহূর্তে নানাভাবে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) মাদরাসা শিক্ষাসহ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। ১৯৬২ সনে মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) ইস্ট পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৭ সন পর্যন্ত আইনসভার সদস্য ছিলেন। জুলাই ১৯৬২ থেকে মার্চ ১৯৬৫ পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান এসেম্বলির পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মে, বোধ-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনায় ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তার গতিশীল নেতৃত্ব, সৃজনশীল চিন্তা-চেতনা, ক্ষুরধার লেখনী ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় ইসলামী আন্দোলন নব উদ্যম ও গতিশীলতা পেয়েছে যা নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় মানুষরা যখন একটি মুখপত্রের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভব করছিল, তখনই মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) ইনকিলাব প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে, যার গতিবেগ এখনও সমানভাবে অব্যাহত রয়েছে। এই পত্রিকাটির মাধ্যমে সমস্ত বাতিল মুখ থুবড়ে পড়েছে। অন্যদিকে এই পত্রিকা আলেম সমাজকে করেছে ঐক্যবদ্ধ। পত্রিকায় তিনি বাংলাদেশের সেরা সেরা কবি, লেখক, গবেষক ও সাহিত্যিকদের সমাবেশ ঘটান, যা এখনও অব্যাহত আছে।
মাওলানা মান্নান সাহেব ছিলেন বাংলাদেশ ‘ফেডারেশন অব টিচারস অ্যাসোসিয়েশন অব নন গভার্নমেন্ট স্কুল, কলেজ অ্যান্ড মাদরাসা’-এর আহ্বায়ক (১৯৭৮)। ১৯৮২ সনের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। মাওলানা এম এ মান্নান নির্বাচিত হন সেক্রেটারি জেনারেল। আলীয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মাদরাসা শিক্ষা উন্নয়ন ও শিক্ষকদের কল্যাণে মাওলানা আবদুল মান্নানের (রহ.) অবদান উপমহাদেশে অতুলনীয়। তিনি মাদরাসা শিক্ষকদের  সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়নে আজীবন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন নিরহংকার ব্যক্তিত্ব ও নেতা। তাঁর জীবনের সর্ব প্রধান পেশা ও নেশা ছিল আলীয়া নিসাবের মাদরাসার সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। তিনি মাদরাসা শিক্ষকদের সকল দাবি-দাওয়া আদায় করতে সমর্থ হন। বিশেষত: স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে বৈষম্য দুর করত: মাদরাসা শিক্ষক এবং স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর এ অবদান মাদরাসা শিক্ষকগণ কস্মিনকালেত্ত ভুলতে পারবেন না।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষক সমিতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শিক্ষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন তার তুলনা বিরল। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। পরম করুণাময় আল্লাহ্তায়ালা মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) মাদরাসা শিক্ষায় চিরস্মরণীয় অবদানের জন্য পরকালে যথাযথ জাযায়ে খায়ের নসিব করুন। দেশের অসংখ্য স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার অধিকার বঞ্চিত হাজার হাজার শিক্ষকের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুকাল। তিনি আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ ও শিক্ষক সমাজের শ্রদ্ধেয় পথিকৃৎ ছিলেন। তাদের পক্ষ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত ঈসালে সওয়াব মরহুমের কাছে পৌঁছতে থাকবে।
বর্তমানে তাঁর সুযোগ্য পুত্র বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে তাঁর দেখানো পথের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। বাহাউদ্দীন সাহেবও তাঁর পিতার ন্যায় সকল সিলসিলার পীর-মাশায়েখের দরবার ও খানকা, হক্কানী উলামায়েকেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা সৃষ্টি করে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামী তাহজিব-তামদ্দুনের সম্মৃদ্ধি সাধনের লক্ষ্যে অবিরাম তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বতর্মান সরকারের আমলে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতৃত্বে মাদরাসা শিক্ষা প্রসারে এবং এই শিক্ষার সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ আলেমসহ-শিক্ষকদের সুবিধার্থে পৃথক মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবী পূরণ হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের ছেলেমেয়েদের মত মাদরাসায় অধ্যয়নরত এবতেদায়ী পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথক বৃত্তি প্রদানের শুভসূচনা হতে যাচ্ছে। মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.)-এর আজীবনের স্বপ্ন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি, যা জমিয়তের সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক বাহাউদ্দিন সাহেবের আপ্রাণ চেষ্টার ফল।
আল্লাহ যেন এ মহান খ্যাতিমান ব্যক্তির মকবুলিয়ত বৃদ্ধি করে দেন। তাঁর অনুসারী, উত্তরাধিকারী এবং খিদমতসমূহকে আল্লাহ পাক কায়েম ও দায়েম রাখেন। এদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন এবং এদের কবুল করেন। অসংখ্য আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ ও সর্বস্তরের মানুষের নয়নমণি মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.)-এর রূহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ মরহুমকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন এবং দৈনিক ইনকিলাব ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি প্রদান করেন। আমীন।
লেখক : পীর ও ইসলামী চিন্তাবিদ, লন্ডন প্রবাসী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন