মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ট্রাম্পের আত্মঘাতি রাজনীতি এবং সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতা

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারনার অন্যতম মটো ছিল ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। এই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাক্যবন্ধের মানে যদি হয় এখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ব্যবসায় বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বেশী মনোযোগ দেবে, নাগরিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তায় বেশী বিনিয়োগ করবে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বর্হিবিশ্বের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না, বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে; তাহলে এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে মার্কিন জনগনের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিল বলেই ট্রাম্পের নির্বাচনী অ্যাডভাইজাররা এই শ্লোগানটি বেছে নিয়ে মার্কিন জনগনকে প্রলুব্ধ করে সফল হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে লিবারেল মার্কিন জনগনের মধ্যে যত সংক্ষোভই থাকুক না কেন, এতসব বিতর্কিত অবস্থানের পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার চমক বিশ্ববাসির জন্য ভাববার বিষয়। তবে আমেরিকা ফার্স্ট শ্লোগানের অন্তরালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এখন বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বসেছে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির শুরু থেকেই তা ক্রমশ স্পষ্ট হতে প্রথম করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে আসীন হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনিক সিদ্ধান্তটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু প্রত্যাশিত, অনেক সময় ও কাঠখড় পুড়িয়ে অর্জন করা টিপিপি(ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ) বহুপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাড়ানোর ফাইলে সই করা। এটি তার নির্বাচনী অঙ্গিকার ছিল, ঠিক একইভাবে ট্রাম্প তার নির্বাচনের আগে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুগুলোর সাথে দ্বিমত পোষন করে প্রথাবিরোধি বক্তব্য দিয়ে গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। গত সপ্তায় প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকর্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে বিশ্বকে হতবাক করলেন। ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্তে দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাভক্ষতি কি হবে তা তাৎক্ষনিত বলে দেয়া সম্ভব না হলেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় যে, ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নেতৃত্বের স্থানটিকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে দেয়া নেতৃত্বের স্থানটি কিন্তু শুন্য থাকছেনা। টিপিপি এবং প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকর্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাড়ানোর ফলে এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্বের স্থানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক বৈরি প্রতিপক্ষ চীনের জন্য নতুন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরী করছে। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চীনা নেতারা কোন সময়ক্ষেপন করছেননা। প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষনার সাথে সাথেই এই ইস্যুতে প্রথমবারের মত চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি অভূতপূর্ব বোঝাপড়ার সুত্রপাত হতে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন নতুন প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উভয়পক্ষ নিবিড়ভাবে কাজ করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ হচ্ছে। অর্থাৎ চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বোঝাপড়া সৃষ্টি হচ্ছে, যা; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে অভিন্ন স্বার্থে সম্মিলিত প্রয়াসে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি নব্য প্রত্যয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্যারিস এগ্রিমেন্ট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হঠতে ট্রাম্পের হঠকারি সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এনবিসি টিভিতে আন্দ্রে মিশেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ট্রাম্প আমেরিকা ফার্স্ট শ্লোগান দিয়ে আমেরিকাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে শুরু করেছেন। তার ভাষায় ‘পুট আমেরিকা লাস্ট’। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এগিয়ে চলা ১৯৬ জাতির ক্লাইমেট এগ্রিমেন্ট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘটনাকে ‘অ্যাবডিকেশন অব আমেরিকান লিডারশিপ’ এবং ‘শেইমফুল মোমেন্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ২০১৫ সালের প্যারিস অ্যাকর্ড থেকে সরে যাওয়া নয়, এর মানে হচ্ছে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে কিউটো প্রটোকল থেকে শুরু হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি ও অঙ্গিকার থেকে সরে দাড়ানো। সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরির ভাষায়, ‘হি হ্যাজ মেইড আজ অ্যান এনভায়রণমেন্টাল পেরিয়াহ ইন দি ওয়ার্ল্ড’ অ্যান্ড আই থিঙ্ক ইট ইজ ওয়ান অব দ্য মোস্ট সেল্ফ ডেস্ট্রাকটিভ মোভ্স আই হ্যাভ এভার সিন বাই অ্যানি প্রেসিডেন্ট ইন মাই লাইফটাইম’। তবে দীর্ঘ প্রায় তিনদশকের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনে যে এগ্রিমেন্ট চুড়ান্ত হয়েছিল তা’ কার্যকর হয়েছিল ২০১৬সালের নভেম্বর থেকে। চুক্তির শর্ত অনুসারে এটি কার্যকর হওয়ার তিন বছরের মধ্যে তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের আগে এ চুক্তির বাইরে যেতে পারবেনা। ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুন:নির্বাচিত হতে না পারলে নতুন প্রেসিডেন্ট এসে কি সিদ্ধান্ত নেন প্যারিস এগ্রিমেন্টের পরিনতির জন্য হয়তো সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপসহ কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ’মিকা নিয়ে যে বিতর্ক ও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে তা যদি শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত বিচারিক ও প্রশাসনিক মাত্রা লাভ করে, তাহলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ইমপিচ্ড হওয়ার পর হয়তো এ ধরনের অভিযোগে ট্রাম্পই হতে পারেন ইমপিচ বা বরখাস্ত হওয়া দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট। রাশিয়ার সাথে গোপণ সম্পর্ক ইস্যুতে সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার মাইকেল ফ্লিন বরখাস্ত হওয়ার পর তার এবং ট্রাম্পের কথিত রাশিয়ান কানেকশান এবং নির্বাচনে তার প্রভাব সম্পর্কে এফবিআই ডিরেক্টর জেমস কোমির তদন্ত কাজ বন্ধের নির্দেশ এবং শেষ পর্যন্ত কোমিকে বরখাস্ত করার ঘটনাটি অনেক দূর গড়াতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এবং বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যহত করার করার অভিযোগে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেসম্যানরাই প্রথম তার অপসারনের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জাস্টিন আমাশ মনে করেন তদন্তকাজে বিরত রাখতে বা ব্যাহত করতে কোমিকে বাধ্য করার অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে তা ট্রাম্পের জন্য অভিসংশনের যোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে সিএনএন কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আরেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান কার্লোস কারবেলো বলেন, কোমিকে তদন্তকাজে বাধাদিয়ে বিচার বাধাগ্রস্ত বা প্রভাবিত করার অভিযোগ যদি সত্য হয়, তা নিক্সন এবং বিল ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে যে রকম অভিসংশন প্রক্রিয়া গৃহিত হয়েছিল, ট্রাম্পের বেলায়ও তেমনটা হতে পারে।
এখনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি মূলত ট্রাম্পের বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে ঘিরে আবর্তিত হলেও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রভাবে বিশ্বরাজনীতির ইউনিপোলার নেতৃত্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ছিটকে পড়তে শুরু করেছে। ট্রাম্পের রিপাবলিকান পূর্বসুরী জর্জ বুশ ‘ওয়ার অন টেরর’ শুরু করার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার এবং ইউনিপোলার শক্তি হিসেবে তার পতন ত্বরান্বিত হতে থাকে। আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসনে শত শত বিলিয়ন ডলারের ব্যয় ও সীমাহীন রক্তপাতের মধ্য দিয়ে  একদিকে পুরো বিশ্বকে আরো সন্ত্রস্ত, রক্তাক্ত ও অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে এসব যুদ্ধায়োজনে কোথায় মার্কিনীদের সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত না হওয়ায় বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিনীদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, অনাস্থা ও ঘৃনা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমস্যা নিরসনে মার্কিনীদের সামরিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ধারনা তৈরী হয়েছে। জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের মত বিশ্বফোরামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার  আধিপত্য বজায় রাখলেও প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে ভুল নীতির কারণে তা এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে সাত দশক ধরে শর্তহীনভাবে সমর্থন ও সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা এবং ফিলিস্তিনী ও আরবদের উপর ইসরাইলের ধারাবাহিক আগ্রাসন, বর্বর হামলা ও অবৈধ বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখার পরও মার্কিন প্রভাবিত বিশ্বসম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততার মধ্যে হেজবুল্লাহ ও হামাসের হাতে বিশ্বের অজেয় সামরিক শক্তির দাবীদার ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্স(আইডিএফ)’র  বার বার মার খাওয়ার বাস্তবতা থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইল তাদের আগ্রাসি মানোভাবে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বিশ্বসংস্থাগুলোকে শান্তি, শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার ও সার্বজনীন নিরাপত্তার বিষয়ে পক্ষপাতহীন কাজে লাগানোর উদ্যোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনো নেয়নি। ওরা সব সময়ই জায়নবাদি ইসরাইল, কর্পোরেট মুনাফাবাজ ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের(এমআইসি) স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। যে ওয়ার ইকোনমিকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থার নীল নকশা গ্রহন করেছিল আজকের দুনিয়া তারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে। এখানে তাদের সেই নীল নকশা বিশ্বকে যেমন চরমভাবে অনিরাপদ, অস্থিতিশীল ও রক্তাক্ত করে তুলেছে, এই নীতি তাদের জন্যও বুমেরাং হয়ে নিজেদের উপর ফিরে এসেছে। জনগনের ইচ্ছা ও আকাঙ্খাকে অগ্রাহ্য করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নিজেদের বশংবদ লোকদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে সামরিক আগ্রাসন, গৃহযুদ্ধ, গোয়েন্দা তৎপরতায় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ছড়িয়ে তারা অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে চাইলেও তা এখন আর সম্ভব হচ্ছেনা। আমেরিকা ফার্ষ্ট শ্লোগান তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন জনগনের কাছে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, এখন তিনি তার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বসম্প্রদায়ের সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগগুলো থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাডিশনাল, আদর্শিক ও অবিচ্ছেদ্য মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথেও মার্কিনীদের গাঁটছড়া ভেঙ্গে যেতে বসেছে। সাংহাই কো-অপারেশন, ব্রিকস’র মত নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ফোরামের মধ্য দিয়ে চীন, রাশিয়া, ইরান, মধ্যএশিয়াসহ বিশ্বের সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো যখন নতুন ট্রিলিয়ন ডলারের সম্ভাবনাময় উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন একদিকে আগ্রাসী অন্যদিকে আত্মকেন্দ্রিক, রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। টিপিপি ও ক্লাইমেট এগ্রিমেন্ট থেকে পিছিয়ে যাওয়া, মুসলমান দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা জারির মধ্য দিয়েই তার প্রমান দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্যবাদি ধনলিপ্সু নীতি বিসর্জন দিতে না পারলেও বিশ্বায়ন ও ক্লাইমেট চেঞ্জ’র মত গুরুত্বপূর্ন আন্তর্জাতিক ইস্যু থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অন্যদিকে চীন এবং রাশিয়া ক্রমাগত তাদের ঐক্য সংহতি এবং নানাক্ষেত্রে পার্টনারশিপ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা ইস্যুতে নিজেদের প্রভাব ও পুঁিজর বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। গেøাবাল ওয়ার্মিং এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ’র ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বসম্প্রদায় যখন নতুন করে এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল নির্ধারনের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের নতুন পথরেখায় মিলিত হতে সচেষ্ট রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন তার সব দরোজা জানালা বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে। ওয়ার ইকোনমির উপর জোর দিতে গিয়ে মার্কিনীরা তাদের ট্রাডিশনাল বানিজ্যিক সক্ষমতা খুইয়েছে। মার্কিনীদের বাজেট ঘাটতি বিশ্বের যে কোন দেশের চাইতে অনেক বেশী। তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমানও সমগ্র বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে অনেক বেশী। আর এই ঋণের এক বড় অংশই তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দি রাষ্ট্র চীনের কাছে। চীন-মার্কিন সম্পর্কের পারস্পরিক নির্ভরতা এবং প্রতিদ্বন্দিতা পুঁজিবাদি বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের হিসাব নিকাশকে একটি সরল ভারসাম্যে প্রতিস্থাপিত করেছে। একদিকে চীনের কাছে আমেরিকার টিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং আমেরিকার বিনিয়োগ এবং কনজিউমার সার্ভিস চীনের উপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে চীনের বিনিয়োগ ও বিশাল জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের স্বার্থেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গতিশীলতা চীনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়। অর্থনীতির এই সরল ভারসাম্যের ভেতর থেকেও চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদি দুনিয়ার দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের নেতৃত্বের দ্বন্দে লিপ্ত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত ভুল নেতৃত্বের কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভার, বিশালত্ব ও ঔজ্জ্বল্য হারাতে বসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র বৃটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তিগুলোকে সাথে নিয়ে এতদিন পুঁজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে সক্ষম হলেও এখন চীন-রাশিয়ার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কাছে মার্কিন নেতৃত্ব অনেকটা খেলো হয়ে পড়ছে। রাশিয়া ও ইরানের সমর প্রযুক্তির ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা, দক্ষিন চীন সাগরে আধিপত্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অথবা পরমানবিক শক্তিধর উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলা কোন ক্ষেত্রেই কৌশলগত সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারছে না ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন উত্তর কোরিয়াকে ভয় দেখাতে প্রথমবারের মত এন্টি আইসিবিএম বা আন্ত:মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল বিদ্ধংসি ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে, তখন উত্তর কোরিয়ার নেতারা দাবী করছে, তাদের পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র হামলা ঠেকানোর সক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তারা মার্কিন ভূ-খন্ডে বৃষ্টির মত পরমাণু বোমা হামলার হুমকি দিয়েছে।
মার্কিনীদের অব্যাহত হুমকির মুখে গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ১০টি ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপন করেছে উত্তর কোরিয়া। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-খন্ডে উত্তর কোরিয়ার  পারমানবিক বোমা হামলা চালানোর মত সক্ষমতা আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তবে এই বিশ্বায়নের যুগে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে ক্ষেপনাস্ত্র প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অন্তত এক দশক এগিয়ে আছে। সম্প্রতি রাশিয়া  সাড়ে ৪ হাজার মাইলের বেশী গতি সম্পন্ন  হাইপারসনিক জিরকন মিসাইল টেস্টের মধ্য দিয়ে মিসাইল প্রযুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহুদূর এগিয়ে থাকার প্রমান পাওয়া যায়। এ ধরনের প্রযুক্তি সক্ষমতা অর্জনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কমপক্ষে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল পুরো মধ্যপ্রাচ্যের আরবদের উপর ছড়ি ঘোরাতে পারে, তাহলে রাশিয়া বা চীনের প্রযুক্তি নিয়ে উত্তর কোরিয়া, ইরানের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে হিজবুল্লাহ, হামাস  আমেরিকা বা ইসরাইলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করলে খুব বিষ্মিত হওয়ার কিছু আছে কি? কারণ দেশ কাল পাত্র ভেদে শক্তি,নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ভারসাম্য ভেঙ্গে দেয়ার ন্যাক্কার জনক উদাহরণগুলো আমেরিকাই প্রথম সৃষ্টি করেছে। জায়নবাদি  এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মত বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বহীন শক্তির পেছনে ছুটতে ছুটতে চীন ও রাশিয়ার মত শক্ত প্রতিপক্ষ থেকে অনেক এগিয়ে থেকেও পেছনে পড়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পরমানু প্রকল্প প্রশ্নে অনেক হম্বিতম্বি শেষে ইসরাইলকে নাখোশ করেই আলোচনার টেবিলে বসে সমঝোতা করতে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। এমনকি সিরিয়া প্রশ্নেও হোঁচট খেয়ে তাদেরকে আলোচনায় বসতে হচ্ছে। এখন কোরীয় সমস্যা সমাধানেও চীন ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে মার্কিনীদের প্রতি আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে।        
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন