বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী বিশ্ব

সউদী নেতৃত্বে কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে

| প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি নিউ আরব
কাতারের প্রতিবেশীরা তিন বছর আগে দেয়া হুমকি বাস্তবায়ন করেছে। তারা ছোট্ট উপসাগরীয় দেশটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।  ফলে সম্পদ সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে কূটনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ আশংকা করছেন যে সউদী নেতৃত্বে কাতারের বিরুদ্ধে এ অবরোধের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় ইরানের প্রতি বৈরিতার জন্য আরব দেশগুলোর সমালোচনা করে কাতারের আমিরের নামে প্রচারিত মন্তব্যের কারণে এ সংকটের সৃষ্টি হয় যা দোহা বলছে ভুয়া এবং এফবিআইও তা নিশ্চিত করেছে যে সেটা হচ্ছে হ্যাকের ফল। তবে কিছু সময়ের জন্য হলেও এটা স্পষ্ট হয়েছে যে একটি ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ এ ধরনের অগ্নিকান্ড ঘটাতে পারে।  
সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত  দীর্ঘদিন ধরেই কাতারে আল জাজিরা নেটওয়ার্ক ও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি দোহার সমর্থনকে সমস্যাজনক হিসেবে দেখে আসছে। ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক অভ্যুত্থানকে সউদী আরব স্বাগত জানায়। কাতার মুরসির সমর্থক ছিল। রিয়াদ ও আবুধাবি দোহার স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির প্রতিবাদে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে।
কিছু সংস্কারের পর দোহাকে হিমাগার থেকে ফিরিয়ে আনা হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম সফরে সউদী আরব এসে পৌঁছার অব্যবহিত পর বর্তমান সংকট দেখা দেয়। তার প্রশাসন রিয়াদের সাথে অস্ত্র বিক্রির আলোচনা চালায় এবং এ অঞ্চলে ইরানি হুমকি মোকাবেলা নিয়ে আলোচনা করে।
ঐতিহাসিকভাবে ঐ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের চেয়ে ইরানের সাথে কাতারে ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল। দু’দেশ বিশে^র বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রের অংশীদার। সউদী আরব এক শিয়া ধর্মীয় নেতাকে ফাঁসি দেয়ার পর ক্রুদ্ধ ইরানিরা তেহরানে সউদী দূতাবাসে হামলা করার প্রতিবাদে দোহা তেহরান থেকে তার রাষ্টদূতকে ডেকে পাঠয়, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি।  
সে সময় একটি বিশ্লেষণে বলা হয়, কাতার তার নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এগিয়ে নিতে উভয় উপসাগরীয় শক্তির বিরোধমূলক কর্মসূচি থেকে সরে থাকার ঐতিহ্যবাহী পররাষ্ট্র নীতি কৌশল অনুসরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আজ তেহরান খাদ্যসামগ্রী আমদানির জন্য কাতারকে তার বন্দরগুলোতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে অবরোধে টিকে থাকতে সাহায্য করছে এবং প্রতিবেশীদের আরোপিত আকাশপথের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে কাতারের জাতীয় বিমান সংস্থাকে তার আকাশ ব্যবহার করতে দিয়েছে।
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) অভ্যন্তরীণ বিরোধে তেহরানকে উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্পের ঐতিহাসিক সফরের প্রেক্ষিতে জিসিসির মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করতে এই হ্যাকের পিছনে আসলে তেহরান থাকতে পারে। এফবিআই এ জন্য রাশিয়ানদের দায়ী করেছে।  
অবরোধ প্রত্যাহারে  দোহার সবচেয়ে ভালো আশা হয়ত তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র।  আংকারা ও দোহার মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৌশলগত সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ও কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল সানি একে অপরকে ভাই বলে সম্বোধন করেন এবং কাতার তার মাটিতে তুর্কি সৈন্যদের আমন্ত্রক। সেখানে তুরস্ককে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে দিয়েছে দোহা।
বুধবার তুরস্কের পার্লামেন্ট কাতারের তুর্কি সামরিক ঘাঁটিতে আরো সৈন্য মোতায়েন অনুমোদন করেছে। এর ফলে সেখানে আরো ৩ হাজার তুর্কি সেনা পাঠানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তুরস্ক কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ তুলে নেয়ার এবং বিরোধের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহান জানিয়েছে। উল্লেখ্য, সউদী আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের সাথে তুরস্কের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
অভিন্ন স্বার্থ ও রাজনীতির ভিত্তিতে আংকারা-দোহা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরদোগান মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক এবং তিনি ২০১৩ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও সে জন্য অভ্যুত্থানের নেতা আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির  তীব্র নিন্দা করেন। সউদী আরব আল সিসিকে সমর্থন দেয়।
আংকারা ও দোহা উভয়েই ফিলিস্তিনের হামাস গ্রæপের রাজনৈতিক নেতা খালেদ মাশালকে তাদের দেশে স্বাগত জানিয়েছে।
টুইটারে ট্রাম্প কাতারকে সন্ত্রাসে রাষ্ট্রীয় মদদদাতা বলে নিন্দা করা সত্তে¡ও এবং তার এ মন্তব্য সউদী আরবকে আরো উৎসাহিত ও সংকটকে আরো বৃদ্ধির ঝুঁকি সৃষ্টি করলেও,  এ অঞ্চলে কাতারের সাথে মার্কিন অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৩ সালে কাতার মার্কিন আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি এখন ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের উপর বিমান হামলা চালানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তুরস্কের ইনসারলিক বিমান ঘাঁটির বাইরে এটিই এ অঞ্চলের  মার্কিনিদের ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্পূর্ণ বিমান ঘাঁটি।
দোহার সাথে নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চিত মতপার্থক্য থাকলেও তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে ও বিরোধিতা করার চেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখাই অধিক লাভজনক নীতি।  জানা গেছে, মার্কিন প্রশাসন এ সংকট পরিহারের মধ্যেই তার নিজের স্বার্থের মঙ্গল হবে বলে মনে করায় ট্রাম্প ইতোমধ্যেই দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা শুরু করেছেন।
সিএনএন জানায়, তিনি দু’পক্ষের প্রতিনিধিদেরকেই হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন । সম্ভাব্য হামলার ভয়ে কাতারের সামরিক বাহিনীকে উচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখার প্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
মার্কিন ও তুর্কি  সেনাবাহিনী আসলেই যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া থেকে কাতারের প্রতিবেশীদের বিরত রাখবে। কেউ যদি আসলেই যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ সমর্থন ছাড়া তাদের বিশাল পশ্চিমা সামরিক অস্ত্রভান্ডারের উপর নির্ভর করা কঠিন হবে।
কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের পর তা যদি অব্যাহত থাকে সেক্ষেত্রে  নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে যেহেতু তা ইরান ও তুরস্কের উপর কাতারকে বেশী নির্ভরশীল হতে বাধ্য করবে।
এক্ষেত্রে উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে আর্মেনিয়া-ইরান সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। শক্তিশালী প্রতিবেশী অধ্যুষিত ছোট দেশ আর্মেনিয়া ১৯৯০-এর দশকে ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। নাগরনো কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া আজারবাইজানের সাথে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। ইরানের আশংকা ছিল যে বাকু ইরানের উত্তর পশ্চিমে বিচ্ছিন্নতাবাদী আজেরী আন্দোলন জোরদার করতে পারে।  
আর্মেনিয়া আগে থেকেই খ্রিস্টান প্রধান দেশ। পক্ষান্তরে আজারবাইজান ইরানের মতই শিয়া প্রধান। তা সত্তে¡ও বাকুর চেয়ে ইয়েরেভানের সাথে তেহরানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনেক ভালো।
আর্মেনিয়া জ¦ালানি ও বাণিজ্যের জন্য ইরানের  উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। তার ভূখন্ডের ৮০ শতাংশই দু’ প্রতিবেশী তুরস্ক ও আজারবাইজান ঘিরে রেখেছে। ইরানের সাথে তার মাত্র ২২ মাইল ব্যাপী সীমান্ত আর্মেনিয়ার লাইফ লাইন নামে পরিচিত।    
সউদী ও তাদের মিত্ররা কাতারকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার তাদের বর্তমান নীতিতে অটল থাকে তাহলে রাজনীতি ও মতাদর্শগত ঘনিষ্ঠতার চেয়ে প্রয়োজনের তাগিদে কাতারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন