মুহাম্মাদ ইবরাহীম খলিল
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর উম্মতে মুহাম্মাদির এক শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহর প্রেমে সিক্ত হওয়া, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত অর্জনের এক বিশেষ সুযোগ রয়েছে এ রাতে। উম্মতে মুহাম্মাদির শ্রেষ্ঠত্বের এক অন্যতম নিদর্শন এ রাত। এ রাতের ফজিলত আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন স্পষ্টভাবে, নাযিল করেছেন স্বতন্ত্র একটি সূরাও। নির্জনে, নিরবে একাগ্রচিত্তে এ রাতে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিল করা সম্ভব। তবে সাধারণ জনগণকে আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদানার্থে মসজিদে আনুষ্ঠানিকভাবে সব রাতে না পারলেও কোন এক রাতে সম্মিলিতভাবে ইবাদত-বন্দেগী করাতে কোন দোষ নেই, বরং উত্তম। নি¤েœ পাঠক সমীপে এ রাতের ফজিলত, আমল সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো।
লাইলাতুল কদরের ফজিলত
কুরআন অবতীর্ণের রাত: মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা কদরের ১ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, “আমি একে (কুরআন) শবে কদরে অবতীর্ণ করেছি ।”
এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী: আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা সুরা কদরের ৩ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, “শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” ইমাম তাবারী রহ. তার তাফসিরে তাবারিতে উল্লেখ করেন, “লাইলাতুল কদরের আমল হাজার মাসের আমলের চেয়েও উত্তম যার মধ্যে অন্য কোন কদরের রাত নেই ”(তাফসিরে তাবারি )। আর এ বক্তব্যকে ইমাম ইবনে কাসির রহ. তদীয় তাফসির গ্রন্থে সত্যায়ন করেছেন।
বরকতময় রজনী: সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয় আমি ইহা (কুরআন) কে অবর্তীণ করেছি একটি বরকতময় রাতে।” আর এ রাত হল শবে কদর। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, “ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন”। আবার কারো কারো মতে, “আল্লাহ তায়ালা এ বছরে যে সকল বিষয়ে নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন।”
গুনাহ মাফ : রাসূল সা. ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানসহকারে ও সওয়াবের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে (রাত্রি জাগরণ করবে), তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে”।( সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৮০২)
সমস্ত কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত: বরকতময় এ রজনীটি মহান রাব্বুল ইজ্জাত সমস্ত কুমন্ত্রনা, শয়তানি ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্ত রেখেছেন, অকেজো রেখেছেন শয়তানের সমস্ত কাজকে। হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. বলেন, “শয়তান এ রাতে কাউকে ক্ষতি বা রুগ্ন করতে পারে ন, অথবা কোন বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে না এবং কোন যাদুকর তার যাদু কার্যকর করতে পারে না।”
কোন তারিখে শবে কদর?
শবে কদর রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে: রমযান মাসের কোন তারিখে শবে কদর এ ব্যাপারে পবিত্র হাদিস ও তাফসির গ্রন্থসমূহে একাধিক মত পাওয়া যায় । নি¤েœ এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলোÑ
“হযরত উবাদাতা ইবনে সামেত রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, লাইলাতুল কদর হচ্ছে (রমযানের) শেষ দশকে। যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় এ রাতে জাগরণ করবে আল্লাহ তায়ালা তার পূর্বাপর গুনাহ ক্ষমা করবে। আর সে রাত্রিটি বেজোড় রাত্রিতে উনত্রিশ, সাতাশ, পঁচিশ, তেইশ অথবা একুশ তারিখে ” (ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরে ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, কায়রো, খন্ড: ৮ম)।
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, “তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান কর।” আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সা. বলেন, “স্বপ্নে আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হল। কিন্তু আমার এক স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ায় আমি তা ভুলে গিয়েছি। অতএব, তোমরা তা রামাযানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর ” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৮২৫)। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, দু’ ব্যক্তির বিবাদের কারণে রাসূল সা. ভুলে গেছেন।
রমযানের ২৭ তারিখে শবে কদর: ইমাম মুসলিম রহ. তার সহিহ মুসলিম শরিফে উল্লেখ করেন, “হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. রাসূল সা. হতে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই উহা (শবে কদর) রমযানের সাতাশ তারিখ। ( ইমাম মুসলিম রহ., সহিহ মুসলিম, হাদীস নং-২৮৩৪, ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরে ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, কায়রো, খন্ড: ৮ম।) ”
“হযরত মুয়াবিয়া, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এছাড়া আরো অনেক সাহাবী রাসূল সা. হতে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই উহা (শবে কদর) হচ্ছে (রমযানের) ২৭ তারিখে। আর এটা একদল সালফে-সালেহিন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম আবু হানিফা রহ.ও বর্ণনা করেছেন।” (ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরে ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, কায়রো, খন্ড: ৮ম, সূরা কদরের তাফসির অংশ।)।
“ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি উমর রা. কে বললাম, আমি জানি বা ধারণা করি লাইলাতুল কদর কোনটি? উমর রা. বললেন, সেটি কোন রাত? ইবনে আব্বাস রা. বললেন, সেটি (রমযানের) শেষ দশকের সপ্তম রাত।” (ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরে ইবনে কাসির, দারুল হাদিস, কায়রো, খন্ড: ৮ম, সূরা কদরের তাফসির অংশ।)
সমাধান মূলক বক্তব্য: উপরোক্ত বর্ণনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, রমযানের শেষ বেজোড় রাতের যে কোন এক রাত্রিতে শবে কদর। আমাদের দেশে মসজিদসমূহে সাধারণত মানুষকে আমলের প্রতি উৎসাহ দেয়ার উদ্দেশ্যে শবে কদরের ফজিলত বর্ণনা করার মানসে আনুষ্ঠানিকভাবে সাতাশ তারিখে যে শবে কদর পালন করা হয় তাও হাদিস, সালফে-সালেহিন ও মুজাতাহিদ ইমামগণের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। সুতারং একে অসার, ভিত্তিহীন বলার সুযোগ নেই। মূলত জ্ঞানে অপরিপক্ক ব্যক্তিরাই এমন মন্তব্য করে থাকে। তবে শবে কদরকে শুধু একরাতেই নির্দিষ্ট করা ঠিক নয়। বরং, রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোকে শবে কদর মনে করেই ইবাদত-বন্দেগী করা উচিত। সম্ভব হলে শেষ দশদিন মসজিদে ইতেকাফ করে ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে চেষ্টা করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের এ রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন