মুফতী পিয়ার মাহমুদ
ইতিকাফ অত্যন্ত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। যদি এটি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় আদায় করা হয়, তাহলে তার ফযীলত ও মর্যাদা তুলনাহীন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে [বায়তুল্লাহকে] পবিত্র কর তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’ (সূরা বাকারা/১২৫) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জন জলীলুল কদর ও বড় মাপের নবীকে বায়তুল্লাহ পুন:নিমার্ণের পর পরই ইতিকাফকারীদের জন্য তা পবিত্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর দ্বারাই মূলত ইতিকাফের গুরুত্ব ও মহত্ব আন্দায করা যায়। আরও আন্দায করা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল দ্বারা। তিনি মদীনায় আগমনের পর অন্য অনেক আমল মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দিলেও মৃত্যু পর্যন্ত ইতিকাফের আমল কোন সময় ছাড়েননি। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্য পর্যন্ত রমাযানের শেষ দশকের ইতিকাফ করেছেন। এরপর তার পূণ্যবতী জীবন সঙ্গিনীগণও ইতিকাফ করেছেন। [বুখারী: হাদীস, ২০২৬; মসলিম: হাদীস, ১১৭২] সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইতিকাফকারী সর্ব প্রকার পাপ হতে মুক্ত থাকে এবং অন্যরা বাইরে আমল করে যে নেকী লাভ করে সে ইতিকাফে থেকে বাইরের আমলগুলো না করেও সেই পরিমাণ নেকী লাভ করে। [ইবনে মাজা: ১৭৮১] উক্ত হাদীসে ইতিকাফের দুটি বড় ফায়দার কথা বর্ণিত হয়েছে। ১. যাবতীয় পাপ হতে মুক্ত থাকা। বাইরে থাকলে হয়তো বা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আশংকা ছিল; কিন্তু ইতিকাফের দরুন তা থেকে রক্ষা তো পেলই ২. অধিকন্তু না করেও অনেক নেক আমল; যেমন জানাজায় শরীক হওয়া, রুগীর সেবা করা ইত্যাদির নেকী মুফতে পেয়ে গেল। ইতিকাফকারী যেহেতু ইতিকাফে থাকার কারণে বাইরের অনেক পূণ্যের কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে না, তাই ধারণা হতে পারে যে, সে অনেক পূণ্যের কাজ থেকে বঞ্চিত হলো। এ জন্য পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীবের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন যে, না করেও সে এ সব আমলের সওয়াব প্রাপ্ত হবে। সুবহানাল্লাহ! কি অপূর্ব সুযোগ। ইতিকাফ না করে বাইরে থাকলে হয়তো সে এই আমলগুলো নাও করতে পরতো, কিন্তু এখন ইতিকাফের বদৌলতে সেই আমলগুলোর সওয়াবও পেয়ে গেলো। অপর বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. মসজিদে নববীতে ইতিকাফ অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে গেলন। তাকে দেখে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, ব্যাপার কি? তোমাকে খুব বিষণœ ও চিন্তাকিøষ্ট মনে হচ্ছে । তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাত ভাই! হাঁ, নিশ্চয় আমি চিন্তিত ও পেরেশান। কারণ জনৈক ব্যক্তির কাছে আমি ঋণী। এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজার দিকে ইশারা করে বললেন, ঐ কবর ওয়ালার ইজ্জতের শপথ, সেই ঋণ আদায়ের সামর্থ আমার নেই। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তোমার জন্য তার কাছে সুপারিশ করব? লোকটি বললেন, আপনি যা ভাল মনে করেন। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. তৎক্ষণাত জুতা পরে মসজিদের বাহিরে এলেন। এটি দেখে লোকটি বললেন, হযরত, আপনি হয়তো ইতিকাফের কথা ভুুলে গেছেন। তিনি বললেন, না; ভুলি নাই। (তখন তার চোখ বেয়ে অশ্রæ ঝরছিল) বেশি দিনের কথা নয়, (মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওজার দিকে ইশারা করে বললেন) আমি এই কবরওয়ালার নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজ মুসলিম ভাইয়ের কোন হাজত পুরণার্থে রওনা হয় এবং তাতে সে চেষ্টা করে, তা তার দশ বছর ইতিকাফ করার চেয়েও উত্তম হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতিকাফ করে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন, যার দূরত¦ আকাশ ও জমীনের মধ্যবর্তী স্থান হতেও বেশি। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী: ৩৬৭৯] একদিন ইতিকাফের এই পরিমাণ সওয়াব হলে দশ বছর ইতিকাফের কি পরিমাণ সওয়াব হবে? এক বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে, তার এই ইতিকাফ নেকী ও শ্রেষ্টত্বের বিবেচনায় দুটি হজ¦ ও দুটি ওমরার সমপর্যায়ের হবে। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮০, ৩৬৮১] অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইতিকাফকারী প্রতিদিন একটি করে হজে¦র সওয়াব পায়। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮২] এই বিশাল ফযীলত ও বরকতপর্ণ ইবাদত ইতিকাফের তাৎপর্য ও মর্মকথা হলো, অন্তরকে সকল কিছু থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সাথে জুড়ানো। দুনিয়ার সকল কর্ম ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে একমাত্র আল্লাহর জন্য ব্যস্ত হওয়া। পার্থিব সকল সর্ম্পক ছিন্ন করে কেবল মাত্র তাঁরই সাথে সর্ম্পক স্থাপন করা। শয়নে-স্বপনে শুধু তাঁরই যিকর-ফিকর ও ইশক-মহব্বতে আপাদ মস্তক ডুবে থাকা। এভাবে ইতিকাফ করতে পারলে পওয়া যাবে ইতিকাফের প্রকৃত স্বাদ ও মজা এবং সৃষ্টি হবে মহান প্রভুর সাথে গভীর ও প্রকৃত ইশক-মুহব্বত এবং অর্জিত হবে ইতিকাফের বর্ণিত ফাযায়েল। এই মুহাব্বাত উপকারে আসবে নির্জন কবরেও, যেখানে তাঁর মুহাব্বত ছাড়া অন্য কোন মুহাব্বত কাজে আসবে না। ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর সাথে বান্দার সর্ম্পক সুগভীর ও সুনিবিড় করা। কেননা রোযার মাধ্যেমে প্রবৃত্তিকে দমন করে নফসকে শরীআহ পরিপালনের উপযুক্ত করা হয়। এভাবে রোযা রেখে যখন বিশ দিন অতিবহিত হলো , নফস যেন রুহানী চিকিৎসার একটি কোর্স সম্পন্ন করে ফেলল। এখন আল্লাহ তাআলা বান্দা থেকে চাচ্ছেন যে, আমার বান্দা দুনিয়ার সকল কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আমার দরবারে চলে আসুক। আমি ব্যতিত অন্য কারো সাথে কোন তাআল্লুক বা সর্ম্পক না রাখুক। [ফাযায়িলে রামাযান: ৫১] এই ইতিকাফের অনেক হিকমত ও উপকারিতাও রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখ করলাম। ১. ইতিকাফের সবচে বড় হিকমত ও উপকারিতা হলো, ইতিকাফ করলে শবে কদরের মত মহিমময় রাত নছীব হয়। কেননা হাদিসের ভাষ্য মতে শবে কদর রমাযানের শেষ দশকেই হয়। যেমন এক হাদীসে আছে- সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রা. বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযান মাসের প্রথম দশকে ইতিকাফ করেন। অতপর দি¦তীয় দশকেও ইতিকাফ করেন। এরপর তুর্কী তাবু হতে মাথা মুবারক বের করে নবীজী বললেন, আমি কেবল শবে কদরের তালাশেই প্রথম ও শেষ দশকে ইতিকাফ করেছিলাম। অনন্তর আমাকে বলা হলো, উহা রমাযানের শেষ দশকে। সুতরাং যে কেউ আমার সাথে ইতিকাফ করে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। উক্ত রাত আমাকে দেখানো হয়েছিল কিন্ত আমি তা ভুলে গিয়েছি। তবে তার আলামত এই যে, আমি আমাকে সেই রাতের সকালে পানি ও কাদা মাটির মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি। কাজেই তোমরা শবে কদরকে রমাযানের শেষ দশকে তালাশ কর। [বুখারী: হাদীস,২০২৭] উক্ত হাদীসের ভাষ্য মতে, শবে কদর শেষ দশকে হয়। আর ইতিকাফও শেষ দশকেই করা হয়, তাই ইতিকাফকারীর শবে কদর পাওয়াটা অনেকটাই নিশ্চত। ২. শয়তান মানুষের চির শত্রæ। সর্বদা সে মানুষের দীনের ক্ষতি সাধনের চেষ্টায় লিপ্ত। ইতিকাফের নিয়তে আল্লাহর ঘর মসজিদে প্রবেশ করলে সে আল্লাহর যিম্মায় চলে আসে। ফলে সে ভয়ংকর শত্রæ শয়তানের চক্রান্ত ও ক্ষতি থেকে নিরাপদ হয়ে যায়। ৩. ইতিকাফে বসলে বাহিরে থাকলে যে গুনাহগুলো সংগঠিত হত তা হতে নিরাপদ থাকা যায়। ৪. হাদীসে কুদসীতে আছে- ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার অর্ধ হাত নিকটে আসে আমি তার এক হাত নিকটবর্তী হই আর যে আমার এক হাত নিকটবর্তী হয় আমি তার দুই হাত নিকটবর্তী হই আর যে আমার দিকে হেটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’ তো ইতিকাফকরী শুধু আল্লাহর নিকটবতীই হয় নাই; বরং সে তো বাড়ি-ঘর ছেড়ে আল্লাহর দরবারে এসে উপস্থিত হয়। সুতরাং এখন চিন্তা করুন, ইতিকাফকারী আল্লাহর কত নিকটবর্তী এবং দয়ালু আল্লাহ তার উপর কি পরিমাণ মেহেরবান? ৫. ইতিকাফকারী ফেরেস্তাদের মত হয়ে যায়। কেননা ফেরেস্তারা যেভাবে সর্বদা আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণে মশগুল থাকেন, ইতিকাফকারীও সেভাবে দুনিয়ার যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সর্বদা আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণে মশগুল থাকেন। ৬. এক হাদীসে আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ নামাযের অপেক্ষায় থাকে ততক্ষণ নামাযের সওয়াব পেতে থাকে।’ [বুখারী: হাদীস, ৬৫৯; মুসলিম: হাদীস; ২৭৫] ইতিকাফে এই ফযীলতও লাভ হয়। ৭. মুমিন বান্দা যতক্ষণ ইতিকাফে থাকে ততক্ষণ সে ইবাদতের সওয়াব পেতে থাকে। চাই সে চুপ থাকুক বা শুয়ে থাকুক কিংবা নিজের কোন কাজ করুক, সর্বদায় সে ইবাদতের সুওয়াব পেতে থাকে। [রমাযান কিয়া হায়: ১৪৬] পাঠক, এই হলো ইতিকাফের ফযীলত, গুরুত্ব ও মর্যদা। এত বিপুল পূণ্যের সমাহার সত্তেও আত্মবিস্মৃত মুসলিম উম্মাহ আজ ইতিকাফ থেকে সর্ম্পূণ উদাসিন। রামাযানের শেষ দশকের পূর্ব মুহুর্তে ইতিকাফের জন্য হন্যে হয়ে খুজতে থাকে কোন হুজুর বা বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি কিংবা কোন ভাড়াটে লোককে। সর্বশেষ ইমাম-মুআজ্জিনের আর খাদেমের উপর কঠিন চাপ। নিজে দশ দিন ইতিকাফে বসার কল্পনাও দূরহ মনে হয়। দশ দিন তো অনেক পরের কথা ; নামাযের সময় মসজিদে প্রবেশ কালে ইতিকাফের নিয়ত করে নিবে ,এই কাজটি কতজন মুসলমানে করে? কেবল ধর্মীয় ব্যাপারেই মসলিম উম্মাহর এই বেহাল অবস্থা। নতুবা প্রার্থিব কোন বিষয়ে এর শত ভাগের এক ভাগ লাভ দেখলেও তা অর্জনের জন্য এমন কোন পন্থা নেই যা অবলম্বন করবে না। সামান্য কিছু অর্থের জন্য মাসের পর মাস বাড়ির বাইরে থাকলে কিংবা বছরের পর বছর প্রবাস জীবন কাটালে তা গায়েই লাগেনা। যত কষ্ট আর সমস্যা কেবল দীনের কাজের বেলায়। শেষকথা হলো, ইতিকাফের আজমত, বড়ত্ব ও মর্যাদার কথা হৃদয়ে জাগ্রত করে অন্তত দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য মসজিদে প্রবেশ কালে ইতিকাফের নিয়ত করা উচিৎ। এতে যতক্ষণ মসজিদে থাকবে, একেবারে নিরব বসে থাকলেও ইতিকাফের সওয়াব পাবে। আর যদি কোন আমল করে তার সওয়াব তো আলাদা থাকবেই। মহামহিম আল্লাহ সকল মুসলিম উম্মাহকে এই মহান আমলটিকে যথাযথ কদর করার তাওফিক দান করুন। উল্লেখ্য, ২০ শে রমযানের সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ দেখার পূর্ব পযর্ন্ত পুরুষের জন্য মসজিদে আর নারীর জন্য নিজ গৃহের নামাযের নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। এটি হলো সুন্নাত ইতিকাফ। এ ছাড়াও ইতিকাফের আরও দুটি প্রকার রয়েছে- ১.ওয়াজিব ইতিকাফ। ইতিকাফের মান্নত করলে তাকে ওয়াজিব ইতিকাফ বলে। যে কয় দিনের মান্নত করবে রোযাসহ সে কয় দিনের ইতিকাফ আদায় করা ওয়াজিব। ২. নফল ইতিকাফ। যার কোন সময় সীমা নেই। সারা জীবনের নিয়ত করলেও জায়িয আছে আবার এক মিনিট বা তারচে’ কম সময়ের নিয়ত করলেও জায়িয আছে। [রদ্দুল মুহতার: ২/১৭৭-১৭৮]
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন