বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

সুই-সুতায় বদলে গেল ৪৫ হাজার নারীর জীবন

| প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো: সোহেল রানা খান, সাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) থেকে : সামনের রোজার ঈদে ঢাকার বিভিন্ন শো-রুমে সরবরাহ করা হয় জেলার ৪৫ হাজার গ্রামীণ নারীর হাতে কারুকাজ করা প্রায় ৫ লাখ পিস বিভিন্ন ধরনের পাঞ্জাবি ও ফতুয়া।
সারাবছর কাজের চাপ কম থাকলেও শুধু ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়ে যায় মানিকগঞ্জের সুই-সুতা কারুকাজের সঙ্গে জড়িত গৃহবধূদের। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করা পাড়া-মহল্লার স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ও গৃহবধূরা দল বেঁধে বসে দেশের নামিদামি ব্যান্ডের পাঞ্জাবির গলার কারুকাজ করতে দেখা যায় তাদের। গৃহস্থালি কাজ শেষ করে বাড়তি আয়ের জন্য এমন নিখুঁত হাতের কাজ করলেও তাদের অভিযোগ চাহিদা মতো মজুরি পাচ্ছেন না তারা।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সিল্ক, মসলিন ও আদিকর্টন পাঞ্জাবিসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের গলা ও হাতের কারুকাজ করা হচ্ছে। সুই-সুতা দিয়ে হাতের কারুকাজ করছে স্কুল কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ গ্রামীণ গৃহবধূরা।
আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, নকশী ও আড়ং ব্র্যান্ডসহ ছোট বড় অন্তত ৪০টি ব্যান্ডের পাঞ্জাবির কারুকাজ করছেন অসচ্ছল পরিবারের এসব নারী শ্রমিক।
এখানকার নকশাতোলা পাঞ্জাবি-ফতুয়া বিক্রি হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। রফতানি হয় কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে। নামী-দামি শোরুম গুলোতে বাহারি রঙের নজর কাড়া হাতের কাজের পাঞ্জাবি-ফতুয়াগুলো সরবরাহ করা হয় মানিকগঞ্জ থেকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই দশকের বেশি সময় আগে ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু করে সুই-সুতার নকশার কাজ। ব্র্যাক তাদের নিজস্ব সেলস সেন্টার আড়ংয়ের মাধ্যমে নারীদের এই পোশাক বিক্রি করে। এরপর ব্যক্তিগত ও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শুরু হয় পাঞ্জাবির ভরাট কাজ। এভাবেই গত দুই দশকে এই নকশার কাজে ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। শুরুর দিকে কাজটিকে ছোট করে দেখা হলেও বর্তমান সময়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেছে। সময়ের সাথে সাথে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী এই কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
সদর উপজেলার কেওয়ারজানি গ্রামের রাবেয়া সুলতানা জানায়, নকশার আকার অনুয়ায়ী একেকটি পাঞ্জাবিতে ভরাট কাজ করে পাওয়া যায় দুইশ থেকে হাজার টাকা। একেকটি পাঞ্জাবি নকশা করতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। এসব ছাড়াও তারা শাড়ি, থ্রি পিস সেলাইও করে থাকেন। বাড়ির গৃহস্থালি কাজ শেষ করে সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য এ কাজটি করছেন তারা।
একই গ্রামের কলেজছাত্রী লিবিয়া আক্তার জানায়, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি এই কাজ করে থাকেন। আগে এই কাজে সবাই আসতে চাইতো না। এখন দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ায় অনেক শিক্ষিত তরুণীরাও এই কাজ করছেন। প্রতিমাসে চাঁর থেকে পাঁচটি পাঞ্জাবির কারুকাজ করা সম্ভব হয়। এতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ টাকা ব্যয় করা হয় ব্যক্তিগত কাজে।
সদর উপজেলার দিঘী গ্রামের রোখসানা জানায়, তার স্বামী নেই। দুই সন্তান ও মা বাবা নিয়ে তার সংসার। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি তিনি পাঞ্জাবি সেলাইয়ের কাজ করেন। এটি করে তার সংসারে বাড়তি আয় হয়।
স্থানীয় অনেক নারী শ্রমিকরা জানিয়েছে, সুই-সুতা দিয়ে নকশা তৈরির কাজ অনেক পরিশ্রমের। পরিশ্রম অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত মজুরি দিচ্ছে না উদ্যোক্তারা। তাই মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে আবার কয়েক জন মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্র করে শুরু করেছেন এই হ্যান্ডিক্র্যাফটের ব্যবসা। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চলছে এই ভরাটের কাজ। কোথাও টিনের সিট তুলে আবার কোথাও নিজ ঘরে বসেই চলছে সুই সুতার এই নান্দনিক কাজ। অনেকেই সারা বছর এ কাজ না করলেও ঈদকে সামনে রেখে লেগে যান সুই সুতা হাতে। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধুসহ অনেকেই হয়ে যান মৌসুমী কারিগর। এই সময়টি অনেকটা উৎসবে রূপ নেয় এই অঞ্চলে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামি ব্র্যান্ডের শোরুমে বিক্রি হয় মানিকগঞ্জের নকশী করা পাঞ্জাবি। এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে কে-ক্রাফট, অঞ্জনস, বাংলার মেলা, রং, আবর্তনা, আড়ং, অন্যমেলা, ওজি, বাংলার রং, তুলি, শেকড়, ড্রিম ফ্যাশন ওয়্যার, ডাইজেন, নোঙর, ঋতু বৈচিত্র্য, নান্দনিক, দেশ কারুপণ্য, খাদি ঘর, মনোরম , নিপূণ, কুমুদিনীসহ বিভিন্ন শোরুম ও বুটিক হাউজ। ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার করেছেন এসব নারী। একটি পাঞ্জাবিতে সুই-সুতার নকশা করে তারা পান ৩০০-৪৫০ টাকা। একটি পাঞ্জাবির কাজ শেষ করতে তাদের চার-পাঁচ দিন লাগে। প্রতিদিন গড়ে ৬-৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সে হিসেবে তাদের মজুরি খুবই কম।
মির্জাপুর রাজবংশী পাড়ার স্বামী পরিত্যাক্তা সন্ধ্যা রাণী রাজবংশী জানান, ৩টি পাঞ্জাবিতে নকশার কাজ করতে গিয়ে ডিজাইন ভুল হয়েছিল, এর জন্য আমারে কোনো মজুরি দেয়নি। হিন্দু অইলেও প্রত্যেক ঈদে নতুন কাপড় কিনে মুসলমান বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াইতে যাই, কিন্তু এবার আর তা অইলো না।
বাড়ইল গ্রামের ছালমা আক্তার অনেকটা আক্ষেপের সুরে বললেন তার জীবনের করুন কাহিনী। তিন বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর সেলাইয়ের কাজ করে এক ছেলেকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে সে। বাড়িতে এনে পাঞ্জাবির নকশার কাজ করি। ১২ বছরের ছেলে নাইম বায়না ধরছে মা এরকম সুন্দর একটা পাঞ্জাবি আমাকে কিনে দিতে হবে। কিন্তু আমি কেমনে বুঝামু ছেলেরে, এইগুলা অনেক দামি, এগুলা আমাগো মতন মাইনষের জন্য না। কথাগুলো বলতে বলতে তিনি আর অশ্রæ সংবরণ করতে পারলেন না।
ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, হাতের কাজের নকশা করা পাঞ্জাবির ৭০ শতাংশই মানিকগঞ্জ থেকে সরবরাহ করা হয়। ঈদ উপলক্ষে মানিকগঞ্জ থেকে এবার হাতে সেলাই ও নকশা করা এবার প্রায় ৫ লাখ পাঞ্জাবী ও ফতুয়া সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
মানিকগঞ্জ শহরের জননী ক্রাফটস এর স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম পরান জানায়, প্রথমদিকে ব্র্যাক এই কাজটি শুরু করলেও এখন অনেক উদ্যোক্তা এই কাজ করছেন। এসব উদ্যোক্তার মাধ্যমে জেলায় প্রায় ৪০ হাজার নারী এখন সুঁই-সুতার কাজ করছেন। তাদের তৈরি এসব পোশাক ঢাকার বিভিন্ন নামিদামি শোরুমে চলে যাচ্ছে। তবে, কাজ অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরি দেয়া হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
সদর উপজেলার জাগির ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানায়, গ্রামীণ এসব নারী নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
susmita ৬ নভেম্বর, ২০২২, ৬:৩২ পিএম says : 0
আমিও এই কাজ করতে চাই কিন্তু কিভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো
Total Reply(0)
susmita ৬ নভেম্বর, ২০২২, ৬:৩২ পিএম says : 0
আমিও এই কাজ করতে চাই কিন্তু কিভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন