শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

শিপিং খাতে সুদিন ও চ্যালেঞ্জ

| প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ : বার্ষিক ব্যবসা ২০ হাজার কোটি টাকার : অবকাঠামো বাড়লে সুযোগ অবারিত
শফিউল আলম : দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামে কন্টেইনারবাহী আমদানি-রফতানিমুখী পণ্যসামগ্রী ওঠানামায় ব্যস্ততা এখন বলতে গেলে সারাবছর। সমান কর্মব্যস্ততা বন্দর-শিপিং নির্ভর সবক’টি খাতে। প্রায়ই কার্গোসহ কন্টেইনার জট এবং মাঝেমধ্যে জাহাজজটে অচলদশার মুখে পড়ছে বন্দর। জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেডগুলোর স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা উপচে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহর ও বাইরের বেসরকারি আইসিডিগুলোর (অফডক) ঠাঁই নেই অবস্থা। বন্দরমুখী ও বহির্মুখী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, মুভার, ট্রেলার দিনে-রাতে সারি সারি। চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙর থেকে হরেক পণ্য বোঝাই দেশের বিভিন্ন নৌ-বন্দর, ঘাট অভিমুখী শত শত লাইটার কার্গো জাহাজ, কোস্টার, নৌযান ছুটে চলেছে। শুধুই তাই নয় বন্দর-শিপিং-কাস্টমস নির্ভর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তথা স্টেক হোল্ডার যেমন- স্টিভিডোর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্টস, শিপিং এজেন্টস, মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও), ডেলিভারী পরিবহন প্রভৃতি খাত-উপখাতওয়ারি অপারেশন কর্মচাঞ্চল্য প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সমগ্র এই শিপিং বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তৃত খাতকে ঘিরে বার্ষিক ব্যবসায়ের আকার ২০ হাজার কোটি টাকার। তবে পরোক্ষভাবে তা আরও দ্বিগুণ।
আঙ্কটাড শিপিং রুল ও সুপারিশমালা অনুসারে পৃথিবীর যেকোনো সমুদ্র বন্দরে স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অন্তত ৩০ শতাংশ কন্টেইনার ধারণক্ষমতা বা অবকাঠামো খালি রাখার নিয়ম অনুসরণীয়। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায়ই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কিংবা সমান সমান কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ও মজুদ হচ্ছে। এতে করে সুচারুরূপে বন্দর কার্যক্রম পরিচালনা কখনও কখনও ব্যাহত হচ্ছে। জট কমানোর জন্য বন্দরে কনজেশন সারচার্জও আরোপ করা হচ্ছে অনেক সময়ই। এর পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত পতেঙ্গা বে-টার্মিনাল নির্মাণসহ দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের যুগোপযোগী আধুনিকায়ন এবং  অবকাঠামো সুবিধা বাড়লে শিপিং খাতে অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়ে গেছে।
তবে শিপিং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্দর-শিপিংয়ে কর্মব্যস্ততা, পণ্যের জট, চাপ ও চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই খাতে বিভিন্ন মুখী চ্যালেঞ্জও সামনে এসে গেছে। এরমধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বন্দর সুবিধাসহ সার্বিকভাবে শিপিং সেক্টরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।   
উপরোক্ত চালচিত্র বাংলাদেশে শিপিং বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার সূচক ও প্রমাণ বহন করে। বাণিজ্যের বিশ্বায়নে শিপিং পরিবহনের দিকে ঝোঁক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণটি হলো সমুদ্রপথে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মাদার জাহাজে কিংবা ফিডার জাহাজে পণ্য বিশেষত কন্টেইনার পরিবহনের চাপ ও চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি। তাছাড়া শিপিংযোগে পণ্য পরিবহন ব্যয় সাশ্রয়ী, নিরাপদ, সহজতর। বর্তমানে তুলনামূলক বৃহৎ আকারের জাহাজযোগে বেশি সংখ্যক কন্টেইনার তথা পণ্য পরিবাহিত হচ্ছে বন্দর থেকে বন্দরে। বিশ্বায়নে বাংলাদেশেও শিপিং বাণিজ্যে সুদিনের ঢেউ এসেছে। আর শিপিং খাতে এখন প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশেরও উপরে।
সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনের চাহিদা বৃদ্ধির সমানতালে শিপিং বাণিজ্য-নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। সমগ্র পৃথিবীতে সাগর-মহাসাগর, উপসাগর ও উপকূলীয় নৌ-রুটে অর্থাৎ শিপিংয়ে পণ্যসামগ্রী পরিবহন ব্যাপক সুলভ ও সহজ। এর তুলনায় সড়ক ও রেলপথে পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল, ঝুঁকি ও হরেক ঝামেলাপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি খরচ সাশ্রয় করার জন্য নৌপথ ব্যবহার তথা শিপিংয়ে আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম পরিচালনায় ঝোঁক অনেকাংশে বেড়ে গেছে। দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, এ বন্দরে গত ২০১৬ সালে ৭ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন কার্গো এবং ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। ২০১৬ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং খাতে প্রবৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। আর সাধরণ খোলা কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। বন্দরে জাহাজ গমনাগমনও বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে জাহাজের সংখ্যা ৩০৫টি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৪ টিতে।     
শিপিং বাণিজ্যের মূল দিকটি হচ্ছে কম জ্বালানি ব্যয় করে অধিকতর পরিমাণে কন্টেইনারসহ খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে কন্টেইনার বোঝাই পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া শিপিংসহ নৌপথ সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে বেশ ব্যাপক। তবে সহায়ক পরিকল্পনা, সমন্বয় ও উদ্যোগের অভাবে আরো অবারিত সুযোগ-সম্ভাবনার দুয়ার আটকে আছে।
শিপিংখাত বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এনামুল বাকী বলেন, মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) উপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে জ্বালানি তেল, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, নিত্য ও ভোগ্যপণ্য সামগ্রী যদি আরও বেশি পরিমাণে বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজবহরের জন্য যোগান দেয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের পথ হবে সুগম। দেশের ব্যাপক আয়তনের সমুদ্রসীমা বা মেরিটাইম বাউন্ডারি স্বীকৃত হওয়ার ফলে আন্তঃদেশীয়, আন্তঃমহাদেশীয় এবং দেশের অভ্যন্তরে নৌপথেও জাহাজ, ট্যাংকার, ফিডার জাহাজ, কার্গোজাহাজ, কোস্টার, বার্জ, ফেরিসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড়, মাঝারি আকারের নৌযানের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে জাহাজ নির্মাণ শিল্পখাতে কর্মচাঞ্চল্য আরও ব্যাপক পরিসরে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগ সময়মতো কাজে না লাগালে হাতছাড়া হয়ে যাবে।      
সাম্প্রতিককালে ‘বøু ইকোনমি’ তথা সামুদ্রিক অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, হিসাব-নিকাশ ও পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। অভিজ্ঞ নৌ-প্রকৌশলীরা জানান, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে। সমুদ্র উপকূলীয় নৌপথগুলো সচল করা হলে পণ্য ট্রানজিট ব্যবস্থায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে পণ্য ডেলিভারি পরিবহন দেয়া সম্ভব। একই সাথে শিপিং ও পরিবহন সেক্টরে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের পথ খুলে যাবে। বিস্তার লাভ করবে নতুন নতুন খাত-উপখাত।  
শিপিং বাণিজ্যের বিরাট দ্বার উন্মোচনের জন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথে একটি পুনঃচুক্তি জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ দীর্ঘকালের ঐতিহ্যে লালিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে আকিয়াব (বর্তমান নাম সিটুই) ও রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) বন্দরের সেতুবন্ধন দেড়শ’ বছরেরও বেশিকালের পুরনো। শিপিং সার্কেলে জানা গেছে, নিকটতম এই দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে কোন নবায়ন ক্লজ নেই। এ কারণে সর্বশেষ গত ২০০৮ সালের ২০ মার্চে চুক্তিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। চুক্তিটিতে নবায়ন ক্লজ না থাকায় পুনঃচুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন রয়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট নৌ প্রটোকলটিও নবায়ন করতে হবে। কিন্তু আপাতত দ্বিপাক্ষিক শিপিং এবং স্থল সীমান্ত বাণিজ্যে এ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কোন বাধা নেই। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিপিং পরিবহনের সুযোগ স¤প্রসারণের জন্য ‘কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং’ চুক্তির সাথে ‘নন-কনভেনশনাল ভেসেল শিপিং’ অন্তর্ভূক্ত করা অপরিহার্য। যদিও এ নিয়ে নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jaglur Rahman Khan ২১ জুন, ২০১৭, ৪:০০ এএম says : 0
Shipping sector is a tremendously prospective. Which is Blue Economy growth sector. But the government has no vision & mission indeed. We have to take comprehensive plan to develop shipping sector. It must be able to contribute our economy much more.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন