অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম : মুসলিম বিশ্বে দুইটি বড়ে আনন্দ উৎসব গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়- যার একটির নাম ঈদুল ফিতর এবং অন্যটির নাম ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর হচ্ছে সিয়াম ভাঙার আনন্দ-উৎসব। এবং ঈদুল আজহা হচ্ছে কুরবানির আনন্দ-উৎসব। এই দুই ঈদেরই গুরুত্ব অপরিসীম, তবে আনন্দ বৈভবের নিরিখে ঈদুল ফিতর সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ উৎসব আছে আমাদের আনন্দ উৎসব এই ঈদ। আনন্দ উৎসব যা প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে ফিরে ফিরে আসে এবং যা নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর পালিত হয়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুয়াজ্জমা হতে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে এসে এখানে স্থাপন করলেন একটি মসজিদ এবং এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন একটি সুখী-সুন্দর সমাজ কাঠামো। তিনি মদীনায় এসে লক্ষ করলেন যে, এখানকার মানুষ প্রতি বছর অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে দুইটি উৎসব পালন করে যাতে কোনো পবিত্রতার বালাই নেই, নেই কোনো পরিচ্ছন্ন মননের ছোঁয়া। অশ্লীল আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, নিরর্থক আমোদ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে এ উৎসব দু’টি নির্দিষ্ট সময়ে মদীনার মানুষ পালন করত। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস রাদিআল্লাহ তা’আলা আন্হু হতে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনাতে এসে দেখলেন যে, তাদের দুইটি উৎসবের দিন রয়েছে। সেই দুইদিন তারা আমোদ-ফুর্তি, খেলাধুলা প্রভৃতি করত। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : এই দুই দিন কিসের জন্য? তারা বলল : এই দুই দিন অন্ধকার যুগে আমরা খেলাধুলা করতাম। এ কথা শুনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : আল্লাহ এই দুই দিনের পরিবর্তে অধিকতর উত্তম দুইটি দিন তোমাদের দিয়েছেন আর তা হচ্ছে ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।
জানা যায়, ইসলাম-পূর্ব যুগে যে দুইটি আনন্দ-উৎসব পালিত হতো তার একটির নাম ছিল নওরোজ ও অন্যটির নাম ছিল মেহেরজান। তদানীন্তন পারস্যে এই দুইটি উৎসবের ব্যাপক প্রভাব ছিল বলে জানা যায়।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওযা সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে আসার প্রায় ১৭ মাস পরে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মুসলমানদের জন্য সিয়াম বা রোজার বিধান দিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : রমাদান মাস, যাতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য দিশারী সত্য পথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের মধ্যে পার্থক্যকারী আল-কুরআন। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে।
৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ শা’বান রমাদান মাসে সিয়াম পালন করার বিধান নাজিল হয়। এরই ১৪-১৫ দিন পর মাহে রমাদানুল মুবারকের আগমন হলে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে রমাদানের সিয়াম পালন করেন। সেই বছর রমাদানের চাঁদ মদীনা মনওয়ারায় এক অনন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার বাস্তব অনুশীলন অনুভবে সমুজ্জ্বল হয়ে উদিত হয়েছিল যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দীর্ঘপথ পেরিয়ে এসে আজও বিশাল মুসলিম দুনিযায় সমানভাবে রয়েছে। এর পূর্বেও সিয়াম পালনের রেওয়াজ মদীনায় ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। তারা মুক্তির দিবস হিসাবে ১০ মুর্হরম আশুরার সিয়াম পালন করত। মদীনায় হিজরত করে এসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আশুরার সিয়াম পালন করেছেন এবং তাঁর নির্দেশে সাহাবায়ে কেরামও আশুরায় এই সিয়াম পালন করেছেন। কিন্তু রমাদানের সিয়াম পালন করার বিধান নাজিল হলে আশুরার সিয়াম ঐচ্ছিক সিয়ামে পরিণত হয় আর রমাদানের সিয়াম বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। যে বছর প্রথম রমাদানের সিয়াম পালিত হয় সেই বছরের সেই রমাদানেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদর। সেই রমাদান শেষেই সর্বপ্রথম মুসলমানদের নিজস্ব আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর পালিত হয় মদীনা মনওয়ারায়। সিয়াম পালনের সেই প্রথম রমাদান মাসটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে সমৃদ্ধ। সেই রমাদান মাসের শেষ দিন প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নতুন এক আনন্দ-উৎসবের ঘোষণা দিলেন। সেটাই ছিল ঈদুল ফিত্রের ঘোষণা। ঈদুল ফিতরের অর্থ সিয়াম ভাঙার আনন্দ-উৎসব।
৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ শাওয়াল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইমামতিতে প্রথম ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তকবিরের সাথে আদায় করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তারপর থেকে প্রতি বছর রমাদান শেষে ঈদুল ফিতর পালিত হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ রমাদান বদর যুদ্ধের বিজয়ের ১৩/১৪ দিন পর মদীনায় সর্বপ্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হয়েছিল আর ৬৩০ খিষ্টাব্দের ২১ রমাদান মক্কা বিজয়ের ৮/৯ দিন পর মক্কা মুয়াজ্জমায় সর্বপ্রথম ঈদুল ফিত্র উদ্যাপিত হয়েছিল। ঈদুল ফিতরের সঙ্গে বিজয়ের যেন একা মহা যোগসূত্র রয়েছে। রমাদান মাসের একমাস ধরে দিবাভাগে সবটুকু সময়ে অর্থাৎ সুবহ্সাদিকের পূর্ব হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকারের পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বিরত রেখে সায়িম বা রোযাদার নফসের সঙ্গে রীতিমতো যে কঠিন যুদ্ধ চালিয়ে যায় তারই বিজয় অনুভব ভাস্বর হয়ে ওঠে ১ শাওয়াল ঈদুল ফিতরের দিনে। একটি হাদীসে আছে যে, সশস্ত্র যুদ্ধ হচ্ছে ছোটো যুদ্ধ আর নফসের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে বড় যুদ্ধ।
যে মানুষ নফ্সকে দমন করতে পারে, ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই কেবল প্রকৃত মানবতা গুণে গুণান্বিত হতে পারে। রমাদান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে সেই বিরাট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়। যে কারণে রমাদানের সিয়াম পালন করার পর ঈদুল ফিতরের আগমন এক বিশেষ অনন্যতা লাভ করেছে। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, লোভ নয়, অহমিকা নয়, কাম নয়, ক্রোধ নয়, সংযমী জীবন, সংযম ও সহিষ্ণু জীবনই প্রকৃত মানুষ্য জীবন। তাই সব মানুষ মিলে এক মহামিলনের বিশ্ব গড়া অনুভব অনুরণিত হয় ঈদুল ফিতরে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন : মানুষ, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩) ঈদুল ফিত্রে এই চেতনার বাস্তব স্ফূরণ ঘটে।
ঈদ পরিচ্চন্ন আনন্দের দিন। আল্লাহ্র মহান দরবারে শুকরিয়া জ্ঞান করার দিন। এই দিনে যাতে গরীব-দুঃখীরা ধনীদের সঙ্গে আনন্দের সমান ভাগীদার হতে পারে সে জন্য গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করার দিন। যাকাত পাবার অধিকারী যারা, ফিত্রা পাবার অধিকারী তারাই। ইসলাম ধনীদের ধন-সম্পদে দরিদ্রের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে দিয়েছে। কুরআন মজীদের ইরশাদ হয়েছে : তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে ভিক্ষুকের এবং বঞ্চিতের। (সূরা যারিয়াত : আয়াত ১৯)। রমাদানের এক মাস সিয়াম পালনের মাধ্যমে সায়িম ধৈর্য, দয়া, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংযম এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে সেই প্রশিক্ষণকে জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের দৃঢ় শপথে বলীয়ান হবার আনন্দ-উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিত্র। এই দিন আনন্দ করবার এবং আনন্দ বিলাবার প্রেরণার উদ্দীপ্ত। এই দিন পারস্পারিক প্রাচুর্য কামনার লক্ষ্যে প্রত্যেকের মুখে প্রাণের গভীর থেকে ঈদ মুবারক উচ্চারিত হয় বার বার।
ঈদ সব মানুষকে একই উঠোনে এনে দাঁড় করায় এবং সকলকে বুকে বুক মিলিয়ে, গলায় গলা মিলিয়ে এক আনন্দ সৌকর্য বিমন্ডিত হৃদয় দেয়া-নেয়ার অনন্য অনুভব জাগিয়ে তোলে। ঈদ কেবল পার্থিব আনন্দ-উৎসব নয়, এ কেবল পার্থিব আমোদ নয়, ঈদ ইবাদতেরও অন্তর্গত। ঈদ মানুষকে আত্মিক উৎকর্য ও পরিতৃপ্তির পথ নির্দেশনা দেয় এবং আল্লাহর জাল্লা শানুহুর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সুপ্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করে। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী অলীয়ে মাদারজাদ হযরত মওলানা শাহ্ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আল্লায়হি বলেছেন : প্রকৃত রোজাদারদের জন্য ঈদ পৃথিবীতে জান্নাতী সুখের নমুনা।
ঈদ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলবার তাকীদে সমুজ্জ্বল। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একটি জাতি-কুরআন মজীদে উল্লেখিত এই অনন্য চেতনার অনুরণন ও স্পন্দন ঈদুল ফিতরে ভাস্বর হয়ে ওঠে। মানুষে মানুষে ঐক্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক সংযমী জীবনের চেতনাই ঈদুল ফিত্রের চেতনা এবং এখানেই নিহিত রয়েছে সিয়াম ভাঙার এই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ বৈভব। ঈদ মুবারক
লেখক : মুফাস্সিরে কুরআন, গবেষক
সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন