সৈয়দ ইবনে রহমত : রহমতপুর, রাঙ্গামাটির সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। গ্রামের পূর্বপ্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে পাহাড়। সেখানে বন্য পশু-পাখির আড্ডা। সময় সময় লোকালয়ে নেমে আসে হাতি আর শুকরের দল। জমির ফসল নষ্ট করে, ঘরবাড়িও ভেঙে তছনছ করে। কখনো অতর্কিত আক্রমণ করে কেড়ে নেয় অসহায় গামবাসীর প্রাণ। এসব সহ্য করেই এখানে বাস করে ৪০-৪২টি পরিবার। এ গ্রামেরই মানুষ আদম আলী। সহজ-সরল হলেও সাহসী মানুষ হিসেবে তার সুনাম আছে। হাতি তাড়াতে তার জুড়ি মেলা ভার। হিংস্র হাতির সামনে মশাল হাতে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় আদম আলী। তার সাহসিকতায় নিমিষেই উল্টো পথ ধরে হাতির পাল। অবাক হয়ে লোকজন বলাবলি করে,
-আল্লা, কইলজা একখান দিছে আদম আলীরে। ঢর-ভয় বইলা তার কিছু নাই।
আদম আলীর সামান্য চাষের জমি আছে, কিন্তু তাতে বছরের অর্ধেকও চলে না। তাই পাহাড় থেকে কাঠ কেটেই সংসারের খরচ চালায়। সাহসী হলেও সে নির্বিবাদী মানুষ, কোনো মেল-দরবার পছন্দ করে না। চাষবাস আর কাঠ কেটে কোনোরকমে সংসার চলে, এ নিয়েই সে তৃপ্ত।
এই আদম আলীর সাথে সখ্য গড়ে ওঠে জুয়েলের। এর পেছনে অবশ্য একটা ছোট্ট ঘটনাও আছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে স্কুলে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বিষয় ছিল, ‘আমার দেখা একজন মুক্তিযোদ্ধা’। এলাকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে কি না জানত না জুয়েল। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। তবে কয়েকজন পরামর্শ দিয়েছিল, রচনা লিখতে আবার মুক্তিযোদ্ধা লাগে নাকি? ব্যাকরণ বইয়ের পেছনেই তো এরকম রচনা থাকে। সেখান থেকে একটা ঘটনা লিখে দিলেই তো হলো। বন্ধুদের কথা ভালো লাগেনি তার, সে লিখবে কিন্তু নকল ঘটনা লিখবে না। এক সময় সে বাবার কাছ থেকেই জানতে পারে যে, পাশের গ্রামের আদম আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা।
পরের দিন সকালেই জুয়েল ছুটে যায় আদম আলীর বাড়ি, রহমতপুর।
সালাম দিয়ে প্রশ্ন করেÑ
-কাকু, আপনি নাকি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন?
-হ, বাজান; যুদ্ধ তো করছিলাম। তোমারে কইল কেডা?
-আব্বার কাছে শুনছি।
-ঠিকই হুনছ। কিন্তু তুমি যুদ্ধের খবর নিতাছ কি জন্যে?
এভাবেই শুরু হয় তাদের সখ্য। সময় পেলেই জুয়েল আসে আদম আলীর কাছে। যুদ্ধের গল্প শুনে, পাহাড়-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার গল্প। তারপর ট্রেনিং, ট্রেনিং ক্যাম্পে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার কথা। দেশে এসে কত ভয়ঙ্কর অপারেশন করেছেন তার কথা, যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া আরো কত ঘটনার কথা বলে যায় আদম আলী।
স্কুলের গÐি পেরিয়ে জুয়েল ভর্তি হয় কলেজে। বাড়িতে এলেও হাতে সময় বেশি থাকে না। তাই অনেকদিন দেখা হয় না তাদের। বছর খানেক পর জুয়েল বাড়ি এসে শুনে, আদম আলীর বড় ছেলে আকবর আলী ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে। ছেলে মরার পর থেকে তারও খুব অসুখ। খবর শুনেই আদম আলীকে দেখতে যায় জুয়েল। বিছানায় পড়ে আছে মানুষটা। তার পাশেই শুয়ে আছে ছোট ছেলে সাহেব আলী। তারও অসুখ। প্রতি রাতেই জ্বর আসে।
আদম আলীর সুঠাম শরীরটা আর নেই। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
-কাকু, আপনার কী হয়েছে?
-বাজান, অসুখ তেমন কিছু না। কবিরাজ কইছে অর্শ্ব রোগ। রোগডা তো অনেক আগেই হইছিল।
-ডাক্তারের কাছে যান নাই?
-আকবরের চিকিৎসা করতে গিয়েই জমিডা বন্ধক দিছি। শরীরে জোর নাই। অনেক দিন ধইরা পাহাড়েও যাইতে পারি না। হাতে কোনো টেকাপয়সা নাই। কবিরাজ ওষুধ দিছে। ভালো অইয়া যাইব।
-টাকা পয়সা নাই বইলা কি চিকিৎসা হবে না? থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়।
-নারে বাজান, মুক্তিযোদ্ধা অইয়া কোনো সাহায্য নিতে আমারে কইও না। জীবনে কোনোদিন কারো কাছে হাত পাতি নাই। তবু কয়দিন আগে একবার গেছিলাম। গিয়া দেহি, মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসে বইয়া রইছে কয়জন। এর মধ্যে যে আমার মায়েরে আগুন দিয়ে পুড়াইয়া মারছিল, সেই রাজাকারও আছে। হুনলাম কেমনে কেমনে জানি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও যোগাড় করছে। আমি যুদ্ধ করছি। ওসমানি সাব আমারে সার্টিফিকেট দিছে। যে অফিসে রাজাকাররা বইয়া থাকে ওই অফিসে আমি আর যামু না। আল্লায় আমারে এমনেই বালা করব।
কথাগুলো বলতে বলতে শক্ত হয়ে ওঠে আদম আলীর চোয়াল। চোখ দুটোও জ্বলে উঠে। কিছুতেই রাজি হয় না জুয়েলের কথায়।
কলেজে ক্লাস চলছিল, তাই জুয়েলকে চলে যেতে হয়। তিন মাস পর এসে শুনে, সব শেষ। আদম আলী আর নেই। কবিরাজের চিকিৎসা বাঁচাতে পারেনি তাকে। ছেলে আর স্বামী হারিয়ে স্ত্রীও এলাকা ছেড়েছে।
পরদিন ভোরে জুয়েল হাজির হয় আদম আলীর শূন্য ভিটায়। ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে কিছু নেই। তবে বাঁশের তৈরি মাচাটা রয়ে গেছে। চালের উপর একটা লাউয়ের গাছ। কয়েকটা লাউ ধরে আছে। উত্তর দিকে কয়েকটা কবর। এর কোনো একটাতে শুয়ে আছে আদম আলী। কবরের পাশে দাঁড়াতেই মনের পর্দায় ভাসতে থাকে আদম আলীর বলে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ।
১৬-১৭ বছরের টগবগে তরুণ আদম আলী, ৭১ সালে যোগ দেয় স্বাধীনতার যুদ্ধে। আর সেই অপরাধেই তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় রাজাকাররা। ঘরের আগুনে পুড়ে মারা যায় পঙ্গু মা। বাবাকে অকথ্য নির্যাতন করে, মরে গেছে ভেবে ফেলে যায়। দেশ স্বাধীন হলে বুক ভরা আশা নিয়ে ফিরে আসে আদম আলী। যুদ্ধ থেকে এসে কে কী পেয়েছে তা জানা নেই তার, তবে সে পেয়েছে শূন্য ভিটায় মুমূর্ষু বাবাকে। টাকাপয়সা নেই, নেই খাবারের ব্যবস্থা। তবু একমাত্র অবলম্বন বাবাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করার পরও বাঁচানো সম্ভব হয় না। এরপর শুরু হয় আদম আলী ছন্নছাড়া জীবন। এক সময় গ্রামের মুরুব্বিরা বিয়ে করিয়ে দেয়। ঘরে আসে নতুন বউ। কিন্তু খাবে কী? ভিটা ছাড়া তো কিছুই নেই। বাধ্য হয়েই পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। একসময় সন্তান আসে, বাবার সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হয় আকবর আলী। সংসারে নতুন মুখ এলেও আয় বাড়ে না। এর মাঝেই খবর আসে, সরকার চাকমা দেশে লোক নিচ্ছে। সেখানে গেলে টিনের ঘর, জমি আর হালের গরুও পাওয়া যাবে।
অজানার পথে পাড়ি জমায় আদম আলী। এক সময় পৌঁছে যায় রাঙ্গামাটি। সে একা নয়, আরো অনেক মানুষ। অনাহার-অর্ধাহার, মশা, ম্যালেরিয়া আর ডায়রিয়ার সাথে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। পথঘাট কিছুই নেই, শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ভয়ে অনেকেই পালাতে চায়। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আর্মি-পুলিশে আটকায়। অবশেষে পাহাড় এবং ড্যাবা মিলিয়ে দুই একর করে জমি দেয়া হয়। সবটাই জঙ্গল। তবু দমে না আদম আলী। শান্তিবাহিনী, বন্য প্রাণী আর অসুখ-বিসুখ সব ভয় ত্যাগ করে শুরু করে নতুন লড়াই। রাত-দিন জঙ্গল কেটে আবাদ করে। জন্ম হয় সাহেব আলী ও কুহিনূরের, আকবর আলীও বড় হতে থাকে। সন্তানদের ঘিরে তৈরি হয় আদম আলীর স্বপ্ন।
সেই স্বপ্ন আজ মিশে গেছে কবরগুলোর ওই লাল মাটির সাথে। যে মানুষটি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছে, জয় করেছে পাহাড়ের সব প্রতিক‚লতা, সেই মানুষটিই সামান্য অর্থের অভাবে হারিয়েছে দুই সন্তান। হয়তো এ অভিমানে, নিজেও হার মেনেছে অর্শ্ব রোগের কাছে। একজন সাহসী যোদ্ধার কী করুণ পরিণতি! আর ভাবতে পারে না জুয়েল। ভিজে আসে তার দু’চোখ। ধিক্কার দিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে, আদম আলীরা কি এভাবে হেরে যাওয়ার জন্যই স্বাধীন করেছিল এই দেশ?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন