জামালউদ্দিন বারী
সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর পশ্চিমা সমর্থিত বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত কোণঠাসা হয়ে সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা জায়গাগুলো হাতছাড়া হতে শুরু করার প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা ও মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। পাঁচ বছর ধরে চলমান এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহত এবং অর্ধকোটির বেশি মানুষ আহত, পঙ্গু ও গৃহহীন হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং সীমান্তে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইয়েমেন থেকে অভিবাসন প্রত্যাশী লাখ লাখ মানুষের চাপ পশ্চিমা মিডিয়ায় ইউরোপীয় রিফিউজি ক্রাইসিস হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়ার দায় মূলত পশ্চিমাদের। এ কারণেই এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, উদ্বাস্তুরা সরাসরি নিজেদের দাবি নিয়েই ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো লাখ লাখ উদ্বাস্তুর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ইউরোপীয় নেতাদের প্রতি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তা অগ্রাহ্য করার নৈতিক শক্তি পশ্চিমা নেতাদের নেই। ইউরোপীয় নেতারা সিরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তারা কি সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রের লিগ্যাসি তৈরি করছেন? তাদের এই ষড়যন্ত্রের নতুন টার্গেট সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রকে আবারও বিখ-িত ও ভাগাভাগি করা। গত মাসে মিউনিখে সিরিয়া সরকার, বিদ্রোহী পক্ষ এবং তাদের সমর্থক বিশ্বশক্তির প্রতিনিধিদের মধ্যে যখন একটি সম্ভাব্য শান্তি আলোচনা চলছিল, তখন ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা অযাচিতভাবেই সেখানে উপস্থিত হন। সেখানে গিয়ে তিনি সিরিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জায়নবাদি ফর্মূলা হিসেবে কোনো রাখঢাক না রেখেই সিরিয়াকে বিভক্ত করার পক্ষে মত দেন। শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে জন কেরি তার কথিত ‘প্লান-বি’ বাস্তবায়ন করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে ইসরাইলি জায়নবাদি ফর্মূলা বাস্তবায়নেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। অটোমান সা¤্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে বিশ্বে মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবকে দুর্বল করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে কোনো মুসলমান দেশ যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষ্যেই মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ করার পশ্চিমা নীলনকশাটি শত বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯১৬ সালের মে মাসে ব্রিটিশ এবং ফরাসি নেতারা মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রকে পূর্ব-পশ্চিমে দুই ভাগ করে একটি গোপন সমঝোতা চুক্তি করেছিল। ইতিহাসে এই চুক্তিটি সাইক পিকো এগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত। এর পরের ইতিহাস সচেতন পাঠকের জানা। অটোমান সা¤্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইন্ধন দিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ এলাকাকে তুর্কি সা¤্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বালফোর ডিক্লারেশনের আওতায় ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে কয়েকটি রাজবংশ বা ডায়নেস্টির অধীনে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ছিল সেই এগ্রিমেন্টের মূল লক্ষ্য। সাইক পিকো এগ্রিমেন্টের শত বছর পূর্ণ হওয়ার আগে থেকেই পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তাদের পুরনো পরিকল্পনার সম্ভাব্য রদবদল ও বাস্তবায়নের হিসাব-নিকাশ কষে আরেকটি বিদ্রোহ ও যুদ্ধ পরিকল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করে।
প্রায় আটশ বছরের অটোমান শাসন ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ইসলামের নতুন জাগরণের সম্ভাবনা ক্রমে জোরালো হয়ে উঠেছিল। একদিকে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, অন্যদিকে জার্মান অ্যাম্পায়ারের উচ্চাভিলাষ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্যান-ইসলামিজম বিকাশের সম্ভাবনার মধ্যেই ব্রিটিশ ও ফরাসিরা নিজেদের ইম্পেরিয়াল ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। উসমানীয় খেলাফতের প্রতি আরবের বিভিন্ন অংশের গভর্নর ও স্থানীয় সামন্ত পরিবারগুলোর অসন্তোষ, অনাস্থা ও উচ্চাভিলাষকে কাজে লাগিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধের ডামাডোলে উসমানীয় খেলাফতবিরোধী বিদ্রোহ সৃষ্টি করে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী লক্ষ্য চরিতার্থ করা হয়। উসমানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে ইসলামবিরোধী আচরণ ও ভাবধারার অভিযোগ তোলা হলেও বিদ্রোহের ডাক দেয়া সে সময়ের আরব নেতারা আরব জাতীয়তাবাদসহ নানা স্থানীয় ও আঞ্চলিক বিষয়াদি যুক্ত করে প্রকারান্তরে মধ্যপ্রাচ্যকে খ- খ- প্রদেশ ও স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত করে ফেলেন। সে সময়ের আরব নেতারা ভাষা, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে কোরআনিক অনুশাসনের ভিত্তিতে ইসলামের সর্বজনীন ঐক্যের ডাক দিলে সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের অনেক বড় সম্ভাবনা ছিল। এসব সম্ভাবনাকে ডুবিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট, গোয়েন্দা এবং সেনা কর্মকর্তারা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের যে বীজ বপন করেছিল তা বিষবৃক্ষে পরিণত হয়ে এখনো বিশ্বশান্তির সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে বিরাজ করছে। মক্কার গর্ভনর শরীফ হোসেনের বিদ্রোহ, হেজাজ, ইয়েমেন, দামাস্কাস, আলেপ্পো, কায়রোতে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ব্রিটিশদের সমর্থন পেয়ে উসমানীয় খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ তছনছ করে দেয়। সে সময় ব্রিটিশ কূটনীতিক হেনরি ম্যাকমোহন, লরেন্স অব আরাবিয়া খ্যাত টি.ই. লরেন্স, মার্কসাইক,ফ্রান্সিস জর্জ পিকো ব্রিটিশ ও ফরাসি গোয়েন্দা ও কূটনীতিকরা কীভাবে আরবদের বন্ধু সেজে আরব সমাজে মিশে উসমানীয় সা¤্রাজ্যের পতনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল তা এখন আরব ইতিহাসের অংশ। শত বছর পেরিয়ে এসে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের প্রণীত সেই ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় অংশই যেন মধ্যপ্রাচ্যে এখন বাস্তবায়িত হতে চলেছে। জায়নবাদি ইসরাইল এবং তার পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই ষড়যন্ত্রের নাটকে এখন নতুন কুশীলব হিসেবে যুক্ত হয়েছে। তবে এবারের মধ্যপ্রাচ্য থিয়েটারে রাশিয়ার ভূমিকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনো নানা রকমের হাইপোথিসিসে ঘুরপাক খাচ্ছে। শত বছর আগে মধ্যপাচ্যের ভাগাভাগিতে রাশিয়া ছিল অন্যতম সুবিধাভোগী অংর্শিদার ১৯১৬-১৭ সালের আরব রিভল্টের পশ্চিমা অপারেটিভসরা ইউরোপের ইতিহাসে জাতীয় বীর হিসেবে ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি লাভ করলেও পক্ষান্তরে আরবদের বহুধা বিভক্ত ও দুর্বল করতে যেসব আরব নেতা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের হাতে অভাবনীয় সাফল্য তুলে দিয়েছিলেন আরবরা কখনো তাদের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশের সুযোগ পায়নি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ আসলে কী চায়, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তারা যে সেক্যুলারিজমের চেয়ে ইসলাম এবং রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে গণতন্ত্রকেই বেছে নিতে চায়, আরব, পারস্য ও মিসরের মুসলমানরা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই তারা তার প্রমাণ দিয়েছে। তবে পশ্চিমারা তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও সমর্থনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে সব সময় মধ্যপ্রাচ্যে জনগণের গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটকে ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের বশংবদ ফেরাউনি রাজতন্ত্র ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রকেই মদদ দিয়ে আসছে।
আরব যুবসমাজ শত বছর ধরে অরওয়েলিয়ান এনিমেল ফার্মে বেড়ে উঠছে। এখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা অথবা ইসলামী খেলাফতের চর্চা যেন ইনহেরেন্টলি নিষিদ্ধ। তারা যখনই সুযোগ পায় তখনই যেন ফুঁসে উঠতে চায়। পাঁচ বছর আগে তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল সেখানে আরব যুবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তৎপরতা শুধু আরব শাসকদেরই বিচলিত করেনি, তাদের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদেরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। জেসমিন বিপ্লব বা আরব বষন্ত যে নামেই ডাকা হোক, তা আমাদেরকে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার আরব রিভল্টের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের ২০১০-১১ সালের আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রে কোনো ইতিবাচক ফসল না উঠলেও পশ্চিমাদের ডিস্টাবিলাইজেশন ফর্মুলা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্র ব্যবসায় এবং কমমূল্যে তেল কেনার সুযোগ নিয়ে তাদের পতনশীল ও দেউলিয়া অর্থনীতি অনেকটা চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯১৬ সালে যখন আরবের বিশাল জনগোষ্ঠী প্যান-ইসলামিজমে বিশ্বাসী হয়ে উঠছিল, তখন অন্য একটি শ্রেণীর মধ্যে আরব জাতীয়তাবাদের ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা। আবার পশ্চিমা ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ইয়াং তুর্কিরা সেক্যুলার গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা পোষণ করছিল। পশ্চিমারা এই প্রত্যেক গ্রুপকেই যার যার মতো উসকে দিয়ে প্রথমে উসমানীয় খিলাফতের বন্ধন ও শক্তিকে শিথিল করেছে। অতঃপর এই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ হাসিলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। সিরিয়া, ইরাকসহ এখনকার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিনিদের ‘প্লান-বি’ পরিকল্পনা এখন প্রায়শ আলোচনায় উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গ্যারেথ পোর্টার, রামজি বারৌদ, আয়ান সিনক্লেয়ার, রবার্ট ফিস্কসহ মুক্তবুদ্ধির পশ্চিমা কলামিস্টদের লেখায় মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক বিভাজন এবং সাম্প্রতিক সা¤্রাজ্যবাদী তৎপরতার মধ্যে একটি ধারাবাহিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা যদি ১৯১৫-১৭ সালে সংঘটিত আরব বিদ্রোহ এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরবর্তী ১০০ বছরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহকে সাইক-পিকোর প্রণীত এগ্রিমেন্টকে সামগ্রিক অর্থে ‘প্লান-এ’ ধরি, তবে এর দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘প্লান-বি’ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন চলছে বলে ধরে নেয়া যায়। গ্যারেথ পোর্টার তার এক নিবন্ধে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, পেন্টাগনের বড় কর্তারা ‘প্লান বি’-র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন, ‘প্লান বি ইজ অ্যাকচুয়াল্লি মোর অ্যান আইডিয়া দ্যান স্পেসিফিক কোর্স অব অ্যাকশন’। অর্থাৎ ‘প্লান বি’ যতটা না একটি নির্দিষ্ট কর্মকৌশল, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে একটা নীতিগত ধারণা। এই আইডিয়ার কোনো স্বচ্ছতা বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। আরব বসন্তের প্রথম ঝড়ে তিউনিসিয়ায় জইন উদ্দিন বেন আলীর দুই যুগের স্বৈরশাসনের পতন হয়, মিসরে হোসনি মোবারকের পতনের পরেই পশ্চিমারা এখানে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই বাঁধভাঙা ঢেউকে কাজে লাগিয়ে আরব বিশ্বের অবাধ্য স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনায়কদের রিজাইম চেঞ্জ করতে গিয়ে আরব বসন্তের হাওয়াকে সেদিকে প্রবাহিত করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনের মধ্য দিয়ে এর বড় ধরনের সাফল্য আসে। তারই ধারাবাহিকতায় সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত করতে সেখানে বহুপাক্ষিক শক্তির সমাবেশ ঘটানো হয়। সিরিয়ান বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে আল-কায়েদার আল নুসরা ফ্রন্ট এমনকি আইএসের মতো গ্রুপের উত্থানের পেছনে পশ্চিমা এবং ইসরাইলিদের পৃষ্ঠপোষকতার পেছনে দূরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে ‘প্লান বি’। আগেই বলা হয়েছে, এই পরিকল্পনা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। ন্যাটো বাহিনীর সহায়তা ও হস্তক্ষেপে সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফিকে হত্যা করা হলেও সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। একইভাবে সিরিয়ায় বাশারকেও ক্ষমতাচ্যুত করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাশিয়া না এলে এতদিনে হয়তো সিরিয়াও আইএসসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যেত। মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার শেষে প্লান বি অনুসারে সেখানে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘাত নিরসনের অজুহাত দেখিয়ে আরও কিছু পশ্চিমা পুতুল শাসক বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে পশ্চিমাদের।
এক শতাব্দী আগে প্রথম মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তি ও উসমানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ আরব বিশ্বকে বহুভাগে বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরব ভূমি দখল করে ইহুদিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। তবে অস্বাভাবিক ও অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের উপযোগী রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করেনি। এটি যেমন ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফসল, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের লাঠিয়াল হিসেবেই নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করছে। যে আরবদের জায়গাজমি, বাড়িঘর দখল করে, উদ্বাস্তু করে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেসব আরব ফিলিস্তিন এবং তাদের সহমর্মী আরব প্রতিবেশী মুসলমানদের অস্ত্রের জোরে দাবিয়ে রাখার মাধ্যমেই ইসরাইল তার অস্তিত্ব ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে চাইছে। ইঙ্গ-মার্কিনিরা শর্তহীনভাবে নিজেদের অর্থ, অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তিগত সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ সমর্থন দিয়ে ইসরাইলকে অজেয় শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। গত এক দশকে ইসরাইলের সেই ‘অজেয় শক্তির’ ধারণায় অনেকটা চির ধরেছে। সিরিয়া, ইরাক, ইরান, মিসর, সউদি আরব বা অন্য কোনো রাষ্ট্রশক্তি নয়, লেবাননের হেজবুল্লা মিলিশিয়া এবং ফিলিস্তিনের হামাসের কাছে গত এক দশকে অন্তত দুবার নাকানি-চুবানি খেয়ে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি করে ঘরে ফিরতে হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অজেয় শক্তি ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)-কে। ইসরাইল এবং পশ্চিমা পুতুল শাসকরা যখন মধ্যপ্রাচ্যের মূলশক্তির কাছে পরাজিত হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যায়, পশ্চিমারা তখনই যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির আন্তর্জাতিক প্রস্তাব গ্রহণ করে থাকে। সাতষট্টি সালে ব্যাপক সামরিক সহযোগিতা দিয়ে ইসরাইলকে আবারও বিশাল আরব ভূমি দখলে নেয়ার সুযোগ করে দেয় ইঙ্গ-মার্কিনিরা। সেই ভূমি পুনরুদ্ধারে ১৯৭৩ সালে আরব শক্তি যখন সফলতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, তখনই পশ্চিমারা আবারও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানতে বাধ্য করলেও পূর্ব জেরুজালেমসহ সাতষট্টি সালে দখল করা আরব ভূমি ছেড়ে দিতে তাদেরকে বাধ্য করেনি। জায়নবাদি ইহুদিরা পুরো আরব বিশ্বকে নিজেদের দখলে নিয়ে বাইবেলে বর্ণিত ‘প্রমিজড ল্যান্ড’র আদলে গ্রেটার ইসরাইল বাস্তবায়নের যে গোপন পরিকল্পনা করেছিল, সরাসরি দখলবাজি না করেও মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ ও জাতিগত সহিংসতা উসকে দিয়ে, ডিস্টাবিলাইজেশন ও বলকানাইজেশনের মাধ্যমে অনেকগুলো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও বশংবদ শাসকশ্রেণী সৃষ্টি করে তারই প্রাথমিক যাত্রা শুরু করতে চাইছে। নাইন-ইলেভেনের পর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা নিজেদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অস্তিত্বের সংকটে পড়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল আকসা পুনরুদ্ধারে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কথা অনেকটা ভুলতে বসেছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে এভাবে আরও এক শতাব্দী ঠেকিয়ে রাখার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বের মুসলমানদের ‘দৌড়ের উপর’ রাখতে পারলে মন্দ কি? সম্ভবত এটিই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইসরাইলি ও মার্কিনিদের প্লান বি।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন