মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন
একজন আদর্শ ও চরিত্রবান শিশু একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজ উপহার দিতে পারে। আর একজন সুসন্তানের জন্য একজন আদর্শবান, নেক্কার ও শরিফ মায়ের খুবই প্রয়োজন। একটি শিশু মাতৃগর্ভে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার যাবতীয় অধিকার মায়ের ওপর চলে আসে। মায়ের চিন্তা-ভাবনা, মন-মানসিকতা ও স্বভাব-চরিত্রের প্রভাব শিশুর ওপর পড়তে শুরু করে। তাই শিশু গর্ভে থাকাকালীন মায়ের জন্য নেক চিন্তা করা, কোরআন তেলাওয়াত করা, সুন্দর দৃশ্য ও সবুজ মনোরম পরিবেশ দেখা।
ভালো পরিবেশে বসবাস করা, সমস্ত খারাপ ধ্যান-ধারণা, খারাপ পরিবেশ থেকে নিজেকে বিরত রাখা মায়ের জন্য খুবই জরুরি। মাতৃকালীন লালন-পালন করার সময়ও মায়ের স্বভাব-চরিত্র শিশুর ওপর ন্যাস্ত থাকে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতা-মাতার ওপর কয়েকটি দায়িত্ব ও কর্তব্য চলে আসে, যা একজন মুসলিম শিশুর ন্যায্য অধিকারও বটে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ডান কানে আজানের শব্দগুলো এবং বাম কানে একামতের শব্দগুলো শুনানোকে সুন্নত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যাতে পৃথিবীতে আগমন করার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুর মনে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব বসে যায়। শিশুর জীবন রক্ষা করার সুব্যবস্থা করা। ইসলামী শরিয়ত জাহেলি যুগের সব কুপ্রথাকে রহিত করে দিয়েছে। জাহেলি যুগে শিশু হত্যা বিশেষ করে কন্যাসন্তান হত্যা তাদের অভ্যাস ছিল। মহান রাব্বুল আলামিন মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর পবিত্র কোরআন নাজিল করার মাধ্যমে জাহেলি যুগের শিশু হত্যার সিস্টেমকে কেয়ামত পর্যন্ত রহিত করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা কোনো প্রাণকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা কর না যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন, কিন্তু ন্যায়ভাবে (কেসাসের বিনিময়)। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারদের ক্ষমতা দান করি। অতএব সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত’ (সূরা বনী ইসরাইল : ৩৩)।
দ্বীনি পরিবেশে সঠিকভাবে শিশুর লালন-পালন করা পিতা-মাতার দায়িত্ব। ঘরে যদি দ্বীনি পরিবেশ থাকে তাহলে দ্বীনি পরিবেশের প্রভাব শিশুর মননে বিকাশ সাধন করে; ফলে দুনিয়াতে সে কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত থাকার আশঙ্কা কম থাকে। ঘরে যদি নামাজ, তালিম ও তেলাওয়াতের পরিবেশ থাকে, তাদের দেখাদেখি শিশুটিও নামাজ, তেলাওয়াত ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। নামাজির মতো সিজদা করতে থাকে। যা দেখে মহান রাব্বুল আলামিন যারপরনাই খুশি হয়ে থাকেন। কিন্তু যদি তা না করে অন্যায় ও অশ্লীল কোনো দৃশ্য শিশুর সামনে পড়ে বা শিশুর সামনে অন্যায় কোনো আচরণ করা হয় তখন এর প্রভাব শিশুর মানসপটে পড়ে যায়। যা সে বড় হলে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করে। যেমন কোনো ঘরে যদি পিতা শিশুর সামনে সিগারেট টানে, তার দেখাদেখি শিশুটিও সিগারেট টানার ভান করে। এক সময় এ শিশুটি বিভিন্ন নেশাদার বস্তু সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যদি শিশুটি বাবার সাথে রিকশায় করে কোথাও যায়, রিকশাওয়ালাকে নামার সময় যদি বলে ‘এই ভাড়া নে’ ব্যবহারটি ঐ কোমলমতি শিশুটির জন্য সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এভাবে একজন শিশুর ভবিষ্যৎ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। শিশুকে মায়া মহব্বতের সঙ্গে লালন-পালন করা, এর প্রভাব শিশুর মধ্যে পড়ে। সে যখন বড় হবে, মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে, মানুষের বিপদাপদে দৌড়ে যাবে। এক কথায় পরোপকারী হবে।
শিশুর ভালো নাম রাখা শিশুর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কেননা শিশুর ভালো নাম তার মন ও ভবিষ্যতে ফুলের মতো জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কোনো ব্যক্তি তার ছেলের নাম ফেরাউন, হামান, কারুন বা নমরুদ রাখে না। কারণ তারা আল্লাহপাকের গজবপ্রাপ্ত। শিশুকে আদব, আমল ও সুশিক্ষা প্রদান করা, বিশেষ করে শিশুকে বুঝিয়ে দেয়া যে তাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী এবং প্রত্যেক কাজে আল্লাহর নামে শুরু করার আদত গড়ে তোলাও শিশুর অধিকার। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সমাজে যদি আদর্শবান শিশু না থাকে তাহলে আদর্শ সমাজ আমরা কোথায় পাব? আজকাল শিশুর চরিত্র নষ্ট হয় কী কাজ করলে তা আমরা হয়তোবা বুঝি না, অথবা বুঝেও খেয়াল করি না। ফলে আমাদের কোমলমতি শিশুদের চরিত্র দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তারা চরিত্রহারা হচ্ছে।
পত্রিকার পাতা উল্টালে দেখা যায়, নেশার টাকা না দেয়ার কারণে বা সম্পদের টানাটানিতে সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যাসহ এ ধরনের বহু সংবাদ ছাপা হচ্ছে। অথবা অনেক সময় দেখা যায় কোমলমতি শিশুদের সামান্যতম কারণে কিছু মানবরূপী দানব মারধর কিংবা হত্যা পর্যন্ত করছে এবং নারীদের প্রতি শ্লীলতাহানীর প্রবণতাও দিনে দিনে বাড়ছে। তাদের কা-কারখানা জাহেল যুগের কুপ্রথাকেও হার মানায়। এহেন ন্যক্কারজনক কাজ দেখে শয়তান পর্যন্ত তাদের কাছে হার মানে। যে দৃশ্যগুলো দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। আকাশ বাতাস পর্যন্ত ভারী হয়ে যায়। কিন্তু এ কোমলমতি শিশুর আর্তচিৎকারে ওই নরপশুর হৃদয়-আত্মা কাঁপে না। সে চরম উল্লাসে শিশুর ওপর নির্যাতন করতে থাকে। আবার অনেকে কোমলমতি শিশুদের অন্যায় কাজে ব্যবহার করছে। এ সবকিছুই হলো কুশিক্ষার ফসল। যারা এ ধরনের কাজে লিপ্ত তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাদের আইনানুগ শাস্তি দেয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে শিশুদের সঙ্গে এমন ন্যক্কারজনক আচরণ করতে কেউ যেন সাহস না পায়।
অথচ শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ জনশক্তি, আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক এবং দেশের কর্ণধার। শিশুই আমাদের আশা ভরসা। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্ব প্রথম দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে হবে। দূর করতে হবে নানা কুসংস্কার। যে শিশু আগামীর নাগরিক, সে শিশুর জীবন যদি অরক্ষিত হয়ে যায় তবে আমাদের গোটা সমাজই বিপন্ন হয়ে পড়বে। অতীত যেমন আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। আমরাও বেঁচে থাকবো ভবিষ্যতের মাঝে। হয়তো ঠিক আমরা নইÑআমাদের কীর্তি আর আমাদের স্বপ্ন। শিশুদের হাতেই জাতির উন্নয়ন সম্ভাবনার চাবিকাঠি তাই শিশুদের গড়ে তুলতে হবে আমাদেরই। শিশুরা জাতির সেরা সম্পদ। আজ যারা শিশু, আগামীকাল হবে তারাই দেশ গড়ার সৈনিক। শিশুকে তার প্রাপ্য পূর্ণ অধিকার দিয়ে গড়ে তুলতে পারলেই সার্থক হবে বাংলাদেশ। কলঙ্ক মুক্ত হবে আমাদের সমাজ। একজন শিশুর যাবতীয় অধিকার নিশ্চিত করা সমাজের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন