মিঞা মুজিবুর রহমান
দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বিশ্বে বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে। এতে বাংলাদেশের স্থান ১২তম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় বেকারত্ব বৃদ্ধি অনিবার্য হয়ে উঠছে।
বর্তমানে যুব বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১০-এ এই সম্পর্কে আরেকটি জরিপ করেছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তখন সেখানে দেখানো হয় ১৫ থেকে ২৯ বছরের যুবকদের মধ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ বেকার। দেশে যুব শ্রমশক্তির সংখ্যা ২ কোটি ২৭ লাখ। বিবিএসের জরিপ মতে, দেশের মোট বেকার শ্রমশক্তির মধ্যে যুবশক্তির বেকারত্ব হলো ৭০ শতাংশ। যুব বেকারত্বের এ চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের জাতীয় প্রয়াস যতখানি একে কর্মসৃজন করে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রয়াস ততটাই পিছিয়ে। খবরে প্রকাশ, অনেক অর্থনীতিবিদ শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন ক্রমবর্ধমান এ যুব বেকারত্বের কারণ হিসেবে। তাদের মতে, বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যুব শক্তি হরেক ধরনের সনদ পেয়ে থাকে সত্য, কিন্তু অর্জিত শিক্ষা বা জ্ঞান কর্মসংস্থানে কোন কাজে লাগছে না। বর্তমান শিক্ষা যুবশক্তির অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে তাকে দক্ষ করে তুলতে মোটেই সাহায্য করে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে শিক্ষিতের হার দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। বেকারত্ব বৃদ্ধির বিষয়টি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তেও স্বীকার করা হয়েছে। তাদের মতে, গত এক দশকে বেকারত্ব বেড়েছে এক দশমিক ছয় শতাংশ। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমেছে দুই শতাংশ।
বাংলাদেশে প্রতিবছর শ্রমবাজারে ঢুকছে ২৭ লাখ মানুষ। সরকারি বা বেসরকারি খাতে তাদের মধ্যে এক লাখ ৮৬ হাজার মানুষকে কাজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বাদবাকিদের জন্য বেকারত্ব অনিবার্য হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া যে কোনো বিবেচনায় দুর্ভাগ্যজনক। কারণ বাংলাদেশকে বলা হয় অমিত সম্ভাবনার দেশ। শ্রমের দাম কম হওয়ায় এবং ১৬ কোটি মানুষের একটি বিশাল বাজার থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের হার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না। অবকাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থা রাখতে পারছেন না। দেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও প্রভাবিত হচ্ছে। তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
কর্মসৃজনের প্রধান উৎস বেসরকারি বিনিয়োগ। বেসরকারি বিনিয়োগ এখনও জিডিপির ১৯ শতাংশের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। এছাড়া যেখানে যেটুকু বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে তাও খুব একটা কর্মসৃজনমুখী নয়। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি ও বেকারত্বের বিবেচনায় যে ধরনের প্রযুক্তিমুখী বিনিয়োগ হওয়া দরকার, তা হচ্ছে না। বরং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে, আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের কারণে নতুন কর্মসংস্থান না হয়ে চলমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রকেও সঙ্কুচিত করে ফেলছে। যেখানে কর্মসৃজন কম হয়, অতি মুনাফার প্রত্যাশায় দেখা গেছে সেখানেই বেসরকারি বিনিয়োগ সর্বোচ্চ আকৃষ্ট হচ্ছে।
মূলত এটি দেখার দায়িত্ব সার্বিক অর্থেই পরিকল্পনা কমিশনের। কিন্তু তারা সেটি করছে না কিংবা করতে পারছে না। ফলে আমাদের শিল্পনীতি রয়েছে, বাণিজ্যনীতি রয়েছে, কিন্তু বিনিয়োগ নীতি নেই। প্রযুক্তির বিকাশকে কোন পর্যন্ত আমরা টেনে নিয়ে যেতে পারব সে সম্পর্কে জাতীয় নীতি থাকা দরকার। সেই সঙ্গে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। রাজনীতি যদি সহিংস হয়, দেশে যদি সাংবাৎসরিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হবে কেন। আর এ বিনিয়োগ প্রত্যাশিত না হলে কর্মসৃজন হবে কীভাবে? এ প্রশ্নগুলোরই উত্তর আমাদের জাতীয় পর্যায়ে খোঁজা দরকার। এ সমস্যার সমাধান করা দরকার।
আইএলওর প্রতিবেদন মতে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ছিল চার দশমিক ৩৩ শতাংশ। যা এক বছর আগে ছিল চার দশমিক ২০ শতাংশ। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য নানা আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। স্থিতিশীলতার জন্য এটিকে প্রত্যক্ষ হুমকি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এ হুমকির মোকাবিলায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। বেকারত্ব থেকে রেহাই পাওয়ার এটিই প্রকৃষ্ট পথ।
ষ লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মিডিয়া অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন