রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

হুমকির মুখে শীতলক্ষ্যা পারের জাহাজ তৈরী শিল্প

শ্রমিক সঙ্কটে রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের কোল ঘেষে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় পারে ছোট বড় শতাধিক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেছে আশানুরুপ ভাবে। একই ভাবে জাহাজ তৈরী শিল্প ডকইয়ার্ড সংখ্যাও কম নয়। জেলার গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা শিল্পনগরী খ্যাত রূপগঞ্জের বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় গড়ে ওঠেছে অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড। এক সময়ের জামদানী, মসলিন, মশারী ও পাইকারী কাপড়েরর হাট শিল্প নগরী খ্যাত রূপগঞ্জে এখন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠেছে শতাধিক বাহারী পন্যের শিল্প কারখানা। এসব কারখানা ছাড়িয়ে নদী মাতৃক দেশের নৌ পরিবহন ও মালবাহী যান তৈরী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় নতুন যোগ হয়েছে জাহাজ তৈরী শিল্প। এতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মূক্ত থাকলেও সম্প্রতি শ্রমিক সঙ্কটে ভুগছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনই চিত্র পাওয়া গেছে রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানে।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর ডেমরা থেকে মাত্র ২কিলোমিটার অদূরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পূর্বগ্রাম গ্রামের অবস্থান। এখানকার সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে মেসার্স খাঁন ডকইয়ার্ড। কথা হয় এ কোম্পানীর স্বত্তাধিকারী সফিকুল ইসলাম খান রুজেলর সাথে। তিনি জানান, রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড থেকে বছরে প্রায় দেড় শতাধিক ছোট বড় নৌযান তৈরী হচ্ছে। এসবের মধ্যে কার্গো জাহাজ, লঞ্চ, ট্রলার ইত্যাদি তৈরী হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তিতে। নৌ বিশেষজ্ঞদের দেয়া নকশা অনুসরণ করে এখানকার তৈরী বিশ্ব মানের জাহাজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা এ কাজে ঝুঁকছে না বলে রয়েছে তার হতাশা। তার দাবী রূপগঞ্জের শিল্পকারখানাগুলোতে স্বাধীনভাবে স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করলেও জাহাজ শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে চায় না তারা। ফলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে সহায়ক ভ‚মিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন তিনি। এদিকে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটে চলেছে। ফলে ঠিকাদার ও মানসম্মত শ্রমিকরা এখানে নিরাপদ বোধ করছেন না। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেও চাঁদাবাজি রোধ করা যাচ্ছে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার কায়েতপাড়া, দাউদপুর ও মুড়াপাড়া ইউনিয়ন ও তারাব পৌরসভার রূপসীতে গড়ে তোলা হয়েছে ছোট বড় অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, তাদের বেশির ভাগই দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা তথা ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও রংপুরের শ্রমিক। তাদের মধ্যে রাজধানী ও রংপুর বিভাগের শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। কারণ হিসেবে জানা যায়, সেসব এলাকার লোকজন এ জাহাজ নির্মাণ শিল্প ঝুঁকি জেনেই জীবিকার তাগিদে এ পেশায় রয়ে গেছেন। তবে তাদের মুজুরী ভাগটাও সাধারণ কাজের তুলনায় একটু বেশি। তবু স্থানীয় শ্রমিক আকৃষ্ট করতে পারছেনা এসব ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। ফলে বাইরের জেলার শ্রমিকদের আবাসন সুবিধা ও খোরাকি দিয়ে বেশি খরচ বহন করতে হয় মালিক পক্ষের। ফলে জাহাজ নির্মাণ করতে বাজেটের তুলনায় বেশি খরচ হয়ে যায়। ডকইয়ার্ড মালিকদের দাবী স্থানীয় শ্রমিকদের এ কাজে সংযুক্ত করতে পারলে অর্ধেক খরচেই শ্রমিক সমস্যার সমাধান হতো। তবে স্থানীয় শ্রমিকরা বলেন ভিন্ন কথা।
পূর্বগ্রামের বাসিন্দা বাবর হোসেন খাঁন বলেন, উপজেলার কায়েতপারা ও দাউদপুর এলাকায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করতো। এখন সেখানে তারা যেতে চান না। কারন হিসেবে জানা যায়, এখানে রড কার্টার পদ্ধতি ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে ঠিকাদার কাজ শুরু করলেই সন্ত্রাসীরা তাদের কাছে চাঁদা দাবী করে বসে। তাদের দাবীকৃত চাঁদা না দিলেই মারধরসহ জাহাজে ব্যবহৃত কাচামাল লুটের ঘটনা ঘটে। তাই তারা এটা এড়িয়ে চলেন। হারিন্দা এলাকার ডকইয়ার্ড ঠিকাদার সুলতানুল আরেফীন জুলফিকার বলেন, রূপগঞ্জের শিল্প প্রতিষ্ঠানে এখানকার শ্রমিকরা কাজ করতে চান না এটা দুঃখজনক। তাছাড়া চাঁদাবাজদের মোকাবেলা করেই এখানে ব্যবসা করতে হয়।
শীতলক্ষ্যা পারের পূর্বগ্রাম ছাড়াও ডাক্তারখালী, বড়ালু, মাঝিনা নদীর পার, হরিনা গ্রামের চর, ইছাখালী, দাউদপুরের খাসের চর, মুড়াপাড়ার গঙ্গানগর, দড়িকান্দিসহ বেশ কিছু এলাকায় রূপগঞ্জের সীমনায় রয়েছে ৫০টির অধিক ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মাস্টাং ডকইয়ার্ড, খান ডকইয়ার্ড, ফাহিম ডকইয়ার্ড, শ্যামস, তালহা, আমির, মালেক, ফটিক, মনির, ভাই ভাইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ডকইয়ার্ড শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতিষ্ঠানে শত ফুট থেকে শুরু করে আড়াইশ ফুট কোস্টার বা মালবাহী জাহাজ, সরোঙ্গা, ফেরী, জেটি, পন্টুন, বালুবাহী ট্রলার, বলগ্যাট ও ড্রেজারসহ অত্যাধুনিক নৌযান তৈরী হচ্ছে এখানে। সম্ভাবনাময় এ ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের রয়েছে নানা সংকট ও সমস্যা। এসবের মধ্যে রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য বিশেষ চাপ। যার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ আর রাজউক ও বিআইডবিøউটি-এর অনাপত্তি পত্র ছাড়া ছাড়পত্র প্রদান করছেনা পরিবেশ অধিদপ্তর। এদিকে নদী বিষয়ক মহামান্য হাইকোর্টে বিআইডবিøউটিএ’র একটি রিট পিটিশন থাকায় তারাও অনাপত্তি পত্র দিতে পারছে না। এ কারণে দেখা দিয়েছে জটিলতা। স্থানীয়দের দাবী এ সম্ভাবনাময় শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের আন্তরিক সহযোগী প্রয়োজন। স্থানীয় শ্রমিকদেরও এ কাজে প্রশিক্ষন দিয়ে যুক্ত করতে পারলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জের সীমনায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান জাহাজ নির্মাণ করছে। যা স্থানীয়ভাবে অর্থনৈতিক ভ‚মিকা রাখছে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকা ও আইনি বিষয় মেনেই তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা উচিৎ। সমস্যাগুলো নিয়ে উর্ধ্বতন মহলে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন