শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

মওলানা ভাসানী : আমাদের জাতিসত্তার অম্লান বাতিঘর

মোস্তফা জামাল হায়দার | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজ ২২ জানুয়ারি ২০১৬ সাল। আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে মওলানা ভাসানী নয় মাস নির্বাসনকাল কাটিয়ে এইদিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রত্যাবর্তন খুব একটা বর্ণাঢ্য আনন্দমুখর ঘটনার প্রতিচ্ছবি ছিল না। তবু বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির একজন উৎসুক গবেষকের দৃষ্টিতে এই দিনটি কম গুরুত্ববহ নয় যা এর অতীত এবং পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা নির্ভুল সাক্ষ্য বহন করে।
ঘোর অন্ধকার অমানিশার দুর্যোগে দিশেহারা একজন নাবিক যেমনিভাবে অতিদূর থেকে একটি বাতিঘরের আলোকচ্ছটা অনুসরণ করে অভীষ্ট লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলে, ঠিক তেমনি একটি দেশ ও জাতির সুদীর্ঘ যাত্রাপথে কোন কোন তিমিরবিনাশী মহামানব উজ্জ্বল বাতিঘরের মত সকল প্রতিকূলতা ও সংকটের মাঝে সঠিক পথনির্দেশনা ও আশার আলো সঞ্চার করেন। আমাদের জাতীয় জীবনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তেমনি এক মহামানব। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার শেষ অর্ধশতাব্দীকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী আরো তিন দশকব্যাপী এক বিশাল মহীরুহের মত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এই ভূখ-ের মানুষের সকল দুর্যোগ ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বরাভয় ও ছায়াদান করেছেন যিনি তাঁর নাম মওলানা ভাসানী।
মওলানা ভাসানী সম্মন্ধে লিখতে বসে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙারের একটি কথাই বারবার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন “পূর্ববাংলার মানুষ, বিশেষ করে সেখানকার প্রগতিশীল বামপন্থীরা সত্যিই বড় ভাগ্যবান। তারা মওলানা ভাসানীর মত একজন মহান নেতার সর্বাত্মক সহযোগিতা ও অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন” (আমাদের দেশের সিপিবি নেতা হায়দার আকবর খান রনোর একটি নিবন্ধ থেকে সংগৃহীত)। বাস্তবিকই গণচীনের মহান জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সান-ইয়াৎ-সেনের সঙ্গে যিনি সহজেই তুলনীয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মওলানা ভাসানী সৃষ্ট একটি চমৎকার অনুকূল পরিবেশ এদেশের বামপন্থীরা কাজে লাগাতে পারেনি। এক দিকে নিজেদের অন্তর্কলহ, অপরদিকে ভুল তাত্ত্বিক শুচিবাইগ্রস্ততা এবং সর্বোপরি অন্ধঅনুকরণ ও দাস্যমনা শিবিরপূজা তাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে তারা মওলানা ভাসানীর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। যথাসময়ে যথাযোগ্যভাবে মওলানা ভাসানীর ব্যাপক প্রভাব ও জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তির আকাক্সক্ষাকে তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তথা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা করার যে ঐতিহাসিক সুযোগ ও দায়িত্ব এদেশের বামপন্থী শক্তির উপর অর্পিত হয়েছিল তারা সেটা পালন করতে শোচনীয় রূপে ব্যর্থ হয়। একথা কে না জানে যে পাকিস্তানী এককেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, জুলুম, নির্যতনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সর্বপ্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাদের উদ্দেশে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন থেকে ১৯৫৬ সালেই তিনি আস্সালামু আলাইকুম জানান। অনেকেই সেদিন মওলানা ভাসানীকে ভারতের চর বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেননি। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকারের জন্য মওলানা ভাসানীর দাবীর প্রত্যুত্তরে সেদিন তারা এমন কথাও বলেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮% স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়ে গেছে। পরম পরিতাপ ও বেদনার সাথে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল যে স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকারের সেই পতাকা একসময় মওলানা ভাসানী ও তাঁর সহযোগীদের হাতছাড়া হয়ে গেল। বেদনাক্লিষ্ট কণ্ঠে আজ তাই উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হয় কবিগুরুর কালজয়ী সেই প্রার্থনা : তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শক্তি। আমি মনে করি বামপন্থী প্রগতিশীল মহলের উপলব্ধিগত ভুলের কারণে সেদিন শ্রেণী সংগ্রামের প্রশ্নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় প্রশ্নকে অবহেলা করা হয়েছে। অথচ এই উভয় দ্বন্দ্বের সমন্বয় সাধন করে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অগ্রভাগে থাকাটাই ছিল বামপন্থী প্রগতিশীল শিবিরের সেদিনের কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং চারু মজমদারের বিকৃত মতাদর্শের অন্ধ অনুকরণের মানসে এদেশের বামপন্থী প্রগতিশীল মহলের একটা বিরাট অংশ শ্রেণী শত্রুর রক্তে হাত রঞ্জিত করে খাঁটি বিপ্লবী হবার উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলেন।
অপরদিকে ৬-দফা আন্দোলন তখন অনেকটা ¤্রয়িমাণ হয়ে পড়েছে। আন্দোলন কিছুতেই দানা বেঁধে উঠতে পারছিল না। সারাদেশে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে কবরের নিস্তব্ধতা চাপিয়ে দিয়েছে। ঠিক এমনি একটি মুহূর্তে মওলানা ভাসানী দৃপ্তপদভারে সম্মুখে এগিয়ে এলেন। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর। বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। সারাদেশে তখন চলছে এক চরম রাজনৈতিক স্থবিরতা, হতাশা ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। এরই মাঝে মওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভা থেকে ঘোষণা করলেন লাটভবন ঘেরাও করার কথা। সভাশেষে হাজার হাজার মানুষ সঙ্গে নিয়ে মওলানা ভাসানী লাটভবন (বর্তমান বঙ্গভবন) অভিমুখে ধেয়ে চললেন এবং পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে প্রচ- সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো। সেখান থেকে ফিরে এসে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং মোনাজাতের মধ্যেই ছোটখাটো একটি বক্তৃতা করে পরদিন ৭ ডিসেম্বর সর্বাত্মক হরতালের ঘোষণা দিলেন। সে হরতাল অত্যন্ত সফলভাবে পালিত হয় এবং সেই সঙ্গে বেজে ওঠে স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহীর পতনের প্রথম ঘণ্টাধ্বনি।
সকল স্থবিরতা, সকল নৈরাশ্য ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে তারপর কেবলই চলতে থাকে জনতার বিজয় অভিযান। ছাত্রদের ১১-দফা ও আওয়ামী লীগের ৬-দফা আন্দোলন পায় এক নতুন গতিবেগ। আমরা যারা সেদিনের ১১-দফা ছাত্র আন্দোলনের অগ্রসারিতে ছিলাম, অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছি কীভাবে মওলানা ভাসানীর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে সমগ্র জাতি গা ঝাড়া দিয়ে যেন জেগে উঠল। তিমিরবিনাশী এক মহামানব একটি জাতিকে নতুন সূর্যের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করলেন। এর পরের ইতিহাস হরিষে-বিষাদে মেশানো বিশাল এক কাব্যগাথা। একদিকে আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছে গেল, অপরদিকে বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তি দিন দিন আন্দোলনের রেসে পিছিয়ে পড়তে থাকল।
১৯৬৯ সালের প্রথম থেকেই শুরু হয় অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় ভরপুর রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ। ৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেন ১১-দফা ঐতিহাসিক দলিলে যা ১০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা হয় এক বিশাল ছাত্রসভায়। উল্লেখ্য ১১-দফা দাবিনামার মধ্যে আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে সন্নিবেশিত করা হয় যথাযথভাবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এরপর আর বলার কিছু থাকল না যে ৬-দফা ছাড়া অন্য কোনো যৌথ আন্দোলনে তারা আসবে না। অপরদিকে উভয় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচি অনুসারে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতার কিছু দাবি সম্বলিত করে এবং সর্বোপরি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিসহ যুদ্ধজোটবিরোধী দাবি সন্নিবেশিত করে রচিত হয়েছিল ১১-দফা ঐতিহাসিক কর্মসূচি। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যাপক সমাবেশ ও শোভাযাত্রা শহরকে প্রকম্পিত করে তোলে। এমনি এক শোভাযাত্রায় ২০ জানুয়ারি শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি এবং একই সাথে কৃষক আন্দোলনের অগ্রসৈনিক মওলানা ভাসানীর ¯েœহধন্য আসাদুজ্জামান। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি ভাসানী আহূত হাট হরতাল সফল করতে নরসিংদী জিলার হাতিরদিয়ায় গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। আসাদের মৃত্যুতে সারাদেশে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। আর তাতে ঘৃতাহুতি পড়ল যখন ২৪ জানুয়ারি নবকুমার হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর পুলিশের গুলিবর্ষণে মৃত্যুবরণ করে। পরবর্তী পরিস্থিতি হয়ে উঠল অভাবনীয়। প্রশাসনযন্ত্র সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হল। ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা দারুণ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে মওলানা ভাসানী একের পর এক জনসভা করে চলেছেন। তাঁর কণ্ঠ থেকে বজ্রনির্ঘোষ বাণী উদগিরণ হচ্ছে : কেউ খাবে আর কেউ খাবে না; তা হবে না, তা হবে না। জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো ; স্বৈরাচারের তখতে তাউস, পুড়িয়ে ফেল পুড়িয়ে ফেল। কার্যত আগুন জ্বলছিল বিভিন্ন স্থানে। সরকারের মন্ত্রীদের বাসভবনে, আগরতলা মামলার বিচারকদের বাসভবনে ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন জ্বলতে থাকে।
১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভা থেকে ঘোষণা করলেন অবিলম্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে যদি মুক্তি দেয়া না হয় তাহলে ক্যান্টনমেন্টের প্রাচীর ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করে আনব। ইতিমধ্যে আইয়ুব খান বেতার ভাষণে সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। মওলানা ভাসানী সরাসরি সে বৈঠকের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। আওয়ামী লীগ নেতারাও মুজিবকে ছাড়া গোলটেবিলে যোগদান করতে অস্বীকার করেন। সরকার কিছুটা নতি স্বীকার করে শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিলে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাইল। কিন্তু বাদ সাধল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা বললাম, মুজিব কেবলমাত্র পরিপূর্ণ মুক্তমানব হিসেবেই গোলটেবিলে যেতে পারে। অন্যথায় আমরা তার প্রচ- বিরোধিতা করবো। আমার মনে পড়ে এ সময় তখনকার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁর আগামসীহ লেনের বাড়িতে আমাদের ডেকে পাঠান। সাইফুদ্দিন মানিক, তোফায়েল আহমদ, মাহবুবুল হক দোলন এবং আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম এবং শেখ মুজিবকে প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের ব্যাপারে বাধাপ্রদান না করার যৌক্তিকতা ও সারবত্তা সম্বন্ধে অনেক কথা শুনে ফিরে এসেছিলাম। আমরা কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসিনি। ইতিহাসের অবধারিত গতি সেদিন কেউ রোধ করতে পারেনি।
এই সময়টাতে মওলানা ভাসানী সারা পশ্চিম পাকিস্তানে অসংখ্য জনসভা করে আইয়ুব শাহীর পতনের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে চললেন। সারাটি সফরকালে তিনি সর্বত্র দারুণভাবে সমর্থিত ও সমাদৃত হন। বিরোধিতাকারী শক্তিও যে একেবারেই ছিল না- তা বলা চলে না। পাঞ্জাবের শাহীওয়ালে তাঁর উপরে হামলা করে উগ্রপন্থী মৌলবাদীরা। কিন্তু আম জনতার রুদ্ররোষে তারাই শেষে পর্যুদস্ত হয়। লাহোরে পৌঁছে মওলানা ভাসানী বললেন, তিনি প্রেস কনফারেন্স করবেন। তাঁর সফরসঙ্গীরা আপত্তি জানিয়ে বললেন, এই মুহূর্তে প্রেসের মুখোমুখি হওয়া তাঁর জন্য সঠিক হবে না। কারণ সারাদেশে তথা সারা বিশ্বে সহিংসতার অবতাররূপে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা অবশ্যই তাঁকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে চাইবে এবং তাঁর জবাব দেয়া দুরূহ হবে। গর্জে উঠে মওলানা ভাসানী বললেন, প্রেস কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় তাঁর জানা আছে। ভাবতে অবাক লাগে, সেদিন কী আশ্চর্য বিচক্ষণতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাথে মহাকবি ইকবালের একটি শের উদ্ধৃত করে তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন তিনি। শেরটি নি¤œরূপ ঃ
জিস্ ক্ষেত সে দাহকান কো মুয়াচ্ছার না হো রোটি
উস্ ক্ষেত কি হর খোসায়ে গান্দাম কো জ্বালা দো, জ্বালা দো।
(যে মাঠের ফসল থেকে কৃষকের খাদ্য মেলে না,
সে মাঠের সকল শস্যকনায় আগুন জ্বালিয়ে দাও, জ্বালিয়ে দাও।)
সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, প্রতিবাদ ও প্রতিঘাতের এই রাজনৈতিক শিক্ষা তো আমি তোমাদের মহান কবি আল্লামা ইকবালের কাছ থেকে লাভ করেছি। জালিম আর মজলুম, শোষক আর শোষিত, লুটেরা আর লুণ্ঠিত মানুষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হতে পারে না। সে মিথ্যা স্তোকবাক্যের রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না।
১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দীর্ঘ সফর শেষ করে ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দরে এসে নামলেন। এক বিশাল অভ্যর্থনা তাঁর জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ন্যাপ, শ্রমিক ফেডারেশন, কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়নসহ সর্বস্তরের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাঁকে পুষ্পমাল্য দিয়ে স্বাগত জানায়। বিশেষ করে টঙ্গীর হাজার হাজার শ্রমিক লাল টুপি মাথায় দিয়ে, লাল পতাকা হাতে নিয়ে তাদের প্রিয় নেতা কাজী জাফর আহমদ ও হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে সারা বিমানবন্দর ছেয়ে ফেলে। আমার মনে পড়ে একটা খোলা ট্রাকের ছাদে মজবুত একখানা চেয়ার শক্ত করে বেঁধে মওলানা সাহেবকে বসিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে অগ্রসর হলাম। তাঁর একপাশে মাহবুবউল্লাহ আরেক পাশে দ-ায়মান ছিলাম আমি। শহীদ মিনারের অনির্ধারিত জনসভায় মওলানা সাহেব ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, আইয়ুবের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেব না। এই মুহূর্তে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। আইয়ুবের শাসনতন্ত্র মানি না, মানব না। ঐ শাসনতন্ত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলব। বাস্তবে আমরা দেখলাম আইয়ুবের অধীনে নির্বাচন আর হল না। পরদিন ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করলেন। সারাদেশে সামরিক শাসন জারি হলো। জেনারেল ইয়াহিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন।
নতুন করে সামরিক শাসন জারি হবার পর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দু’টি বছর শ্বাসরুদ্ধকর অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনায় ভরপুর, যার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কুশীলব ছিল এদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ। সেসবের বিশদ বিবরণ দেয়া এই ছোট্ট প্রবন্ধে সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলা একান্ত প্রয়োজন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক বিধি ঘোষণা এবং তারই আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্র্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, উপদ্রুত অঞ্চল সফর শেষে পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীর অবিস্মরণীয় বক্তৃতা যেখানে তিনি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে, বাংলার এই মহাসংকটে ‘ওরা কেউ আসেনি’, অতঃপর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পিছনে মওলানা ভাসানীর নীরব সমর্থন ও আশীর্বাদÑ এসবই ইতিহাসের পাতায় নির্ভুলভাবে রেকর্ডভুক্ত করে রাখার দায়িত্ব ভাসানী অনুসারী এদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের।     
একাত্তর সালের নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানা ভাসানীকে কার্যত অন্তরীণ রেখে যে সকল কর্মকা- চলেছে সে ক্ষেত্রে তিনি ও তাঁর অনুসারীদের দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে যথাযোগ্য অবদান রাখতে দেয়া হয়নি। তবুও সকল প্রতিকূলতা, সকল হয়রানি ও বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে তাঁর অনুসারীরা ২ জুন, কোলকাতার উত্তর বেলেঘাটার একটি স্কুল ভবনে মিলিত হয়ে গঠন করেন ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’। দিনাজপুরের প্রবীণ ন্যাপ নেতা শ্রী বরদাভূষণ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভাসানী ন্যাপ, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলার সমন্বয় কমিটি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন-বাশার গ্রুপ) কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ, হাতিয়ার গ্রুপ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশন ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ। সেই সময়টিতে ভাসানীকে সামনে রেখে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ ভাসানী তখন অন্তরীণ। তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছে তাও জানা নেই। এদতসত্ত্বেও তাঁর অনুসারীরা দেশের মুক্তি সংগ্রামে সংঘবদ্ধ হয়েছে- এটি অনেকের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হয়ে প্রেরণা জুগিয়েছিল। কোলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও ফলাও করে খবরটি ছাপা হয়েছিল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী তখনকার ব্যাপক দুর্নীতি, বেপরোয়া লুটপাট, রিলিফ চুরি, কম্বল চুরি, অবাধ চোরাকারবার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদের আওয়াজ তোলেন। শুধু তাই নয়, সেদিন যখন সকল বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার আশু লক্ষ্যে ঢালাওভাবে নকশাল নামে আখ্যায়িত করে বামপন্থী দেশপ্রেমিক শক্তিকে নিশ্চিহৃ করার অশুভ তৎপরতা শুরু হয়, মওলানা ভাসানী তা চ্যালেঞ্জ করে তীব্র প্রতিবাদী আওয়াজ উত্থাপন করেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যখন ঘোষণা এলÑ যে নকশাল দেখামাত্র গুলি করা হবে, তখন মওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ কণ্ঠে তার প্রতিবাদ করে বলেন, নকশাল কারো কপালে লেখা থাকে না। সরকারি এই ঘোষণা প্রচ- নৈতিকতা ও মানবতাবিরোধী। দেশে নৈরাজ্য ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরই কেবল জন্ম দেবে এ ধরনের ঘোষণা ও কর্মকা-। রক্ষীবাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাসের কবলে নিপতিত শত শত বামপন্থী যুবকর্মী যখন গৃহছাড়া, আশ্রয়হারা একমাত্র মওলানা ভাসানীই তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন।
আর অন্যদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি বজ্রনির্ঘোষে প্রতিবাদী আওয়াজ উচ্চারণ করেন। ভারত-বাংলার অভিন্ন নদী গঙ্গার পানি একতরফাভাবে ভারত কর্তৃক প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করে বিশ্ববিবেককে সমূলে নাড়া দিলেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধীকে লিখিত এক পত্রে তিনি বললেন, শ্রী মতিলাল নেহেরুর পৌত্রী ও জওহর লাল নেহেরুর কন্যা হিসাবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল আপনি সবসময়ই বঞ্চিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে সবক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। ফারাক্কা সম্পর্কে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সফর করে আমাদের কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে যে সমূহ ক্ষতি হচ্ছে তা নিরূপণ করুন এবং একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা থেকে বিরত থাকুন।  
এরপর ঘটনাপ্রবাহ আরও বহুদূর গড়িয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে শুধু যে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে তাই নয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে ব্রহ্মপুত্রের পানিও প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদিকে তিস্তার পানি বণ্টন প্রস্তাব কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ রেখে নানা কৌশল ও অজুহাতে আনুষ্ঠানিক চুক্তিনামা স্বাক্ষর করা ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু মৌখিক আশ্বাসের বানী শোনানো হচ্ছে যে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে হানিকর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হবে না।
কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কোথায় সেই বুলন্দ আওয়াজ? পল্টন ময়দান থেকে কে আজ ‘খামোস’ বলে রণহুংকার দেবে? কে আজ জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের অনুকূল একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জান-কসম লড়াইয়ের ঘোষণা দেবে? আর কতকাল একজন ভাসানীর জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে, আমি জানি না। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, মওলানা ভাসানী আজ আমাদের মাঝে নেই। আমাদের জাতীয় চেতনা ও সমগ্র জাতিসত্তার অম্লান বাতিঘরখানি আজ মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জাতির এই মহাসংকটে মওলানা ভাসানীর অভাব আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করছি।
লেখক: বিশিষ্ট রাজনীতিক
E-mail: mjhaider.delta@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন